এ কালের ঈশপের গল্প
অনেকদিন যাবতই শ^শুর বাড়ির সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না নেকবর আলীর। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে আগামাথা বেরও করতে পারছে না কিছু। একটা কারণ অবশ্য তার জানা, আর সেটি হলো শ^শুর পক্ষের এখন অনেক টাকা। টাকার গরমে শ^শুর বাড়ির লোকজনের ভাষা-ব্যবহার পাল্টে গেছে। কথা বলছে যেমন ইচ্ছে। নেকবর আলী একবার শ^শুর বাড়ি বেড়াতে গেলে বড় সম্বন্দি তার চোখের উপর চোখ রেখে বলেই দিলো, ‘শ^শুর বাড়ি আমাদেরও আছে। কিন্তু একদিনের জন্যে শ^শুর বাড়ি গিয়ে থাকিনি। বেহায়ার মতো দুই-চারদিন পড়ে থাকার তো প্রশ্নই আসে না।’
‘আপনার শ^শুর বাড়িতো বাড়ির কাছেই। তার উপর আপনি ছিলেন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। এখন বনেছেন ব্যবসায়ী। এসব মানুষের বেড়ানোর ফুসরৎ কোথায়? তাছাড়া বেড়াতে গেলে খয়-খরচা করতে হয়। সেই অভ্যাসতো আপনার নেই।’ কথাগুলো মনে এসেছিলো নেকবর আলীর। কিন্তু মুখ দিয়ে বের করেনি। এই সম্বন্দিরও এখন অনেক টাকা। জবাব দিলে সামনাসামনি আরো কিছু অপমানজনক কথা বলে ফেলবে হয়তো। সেজন্যে কিছুই বলেনি নেকবর আলী।
পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায় নেকবর আলীর।
নেকবর আলী যখন বিয়ে করে তখন তার শ^শুরদের অবস্থা ছিলো খুবই করুণ। মুলির বেড়ার ছোট্ট দু রুমের ঘর, তাতে শ^শুর-শাশুড়ি-শালা-সম্বন্দি-শালী সকলে মিলে গিজগিজ করে থাকে। এর ভেতরেই বেড়াতে এসে তাকেও কুঁজো হয়ে মাথা গুঁজতে হতো। গোসল গা ধুতে হতো জোয়ার-ভাটার ময়লা অথবা বদ্ধ পানিতে। পায়খানা করতে হলে যেতে হতো দূরে। বসতে হতো কাকের ঠ্যাং-এর মতো। ঝুলন্ত টংয়ে (পায়খানা/টাট্টিগাছ) বসতে উঠতেই পা কাঁপতো নেকবর আলীর। বর্ষা মৌসুমে বিয়ে হওয়ার কারণে প্রথমদিন পায়খানা করতে গিয়ে বড়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিলো নেকবর আলীকে। কোমর পানি ভেঙে তাকে উঠতে হয়েছিলো টং ঘরে। টং ঘরটিতে উঠতেই সেটি ভূমিকম্পে ঘর দোলার মতো দুলছিলো অনবরত। বড় ভয় পেয়েছিলেন নেকবর আলী। যদি পা ফসকে নিচে পড়ে যায়! ভাঙাচোরা রাস্তা, নড়বড়ে সাঁকোÑএসব পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়েছিলো। বিয়ের দিন বরযাত্রী হিসেবে যারা এসেছিলো তারা কষে গাল দিয়েছিলো নেকবর আলীকে, ‘শ^শুর বাড়ি করার আর জায়গা পেলে না। এখানে মানুষ আসে?’
নতুন বউয়ের সাথে রাতেই শোয়া নিয়ে হতো আরেক ঝামেলা। শালা-সম্বন্দির সাথে একরুমে শুতো নেকবর আলী। ভেতরের রুমে শুতো তার স্ত্রী। নেকবর আলীর ঘুম আসতো না। বিছানায় ছটপট করতো। রাত নিশীথ হলে ভেতরের রুমে গিয়ে সারিবদ্ধ পা বাঁচিয়ে চুরিসারে বউয়ের আঁচল টানতো। তারপর বউকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়তো। ছোট্ট পাকঘরে মাটিতে শুইয়ে তরলীকরণের কাজটা সারতে হতো কোনোভাবে। কখনো কখনো তাতেও বাধা পড়তো। মুখবদ্ধ অবস্থার মধ্যেই হঠাৎ দেখা গেলো কেউ একজন কুপি জে¦লে বাইরে এসেছে। টের পেয়ে নেকবর আলীর স্ত্রী অন্যত্র সরে যেতো। নেকবর আলী বউয়ের পিছ ছাড়তো না। নারিকেল গাছ অথবা অন্য কোনো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়েই কাজটা সারতো। জোয়ান বয়স, কী আর করা!
নেকবর আলীর শ^শুরদের মুলির বেড়া দেয়া সেই ছোট্ট দুই রুমের ঘর এখন অনেক বড় হয়েছে। হয়েছে পাকাও। ঘরের ভেতরেই এখন পায়খানা ও গোসল করা যায়। দুই সম্বন্দি বিদেশ গেছে। তারাই করেছে এসব। তাদের কল্যাণে অন্য দুই ভাইয়েরও ভাগ্য খুলেছে। তাদেরও ঘর-দোরে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ বিদেশগমনের ব্যাপারে বাড়ির দুই ভাইয়ের এতোটুকু অবদান ছিলো না। তাদের স্ত্রীরা বাঁকা চোখে গলা ফুলিয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য! ওই ভাবীদের গলায়ই দেবররা
ঝুলিয়েছে সোনার গয়না। নেকবর আলী মনে করতে চেষ্টা করে তার স্ত্রী ছোট ভাইয়ের বিদেশগমনের সময় নিজের মাটির ব্যাংক ভেঙে ভাইকে টাকা দিয়ে বলেছিলো, তাকে যেনো টাকার বদলে সোনার হার দেয়া হয়। কিন্তু সে হার আর তার স্ত্রী পিয়ারা বেগমের পাওয়া হয়নি। সে বছর বিদেশী সম্বন্দিরা তাদের ভাবীদের গলায়-কানে সোনা দিয়ে ভরিয়েছে, সে বছরই নাম কুড়ানোর জন্যে তারা দূরের-কাছের আত্মীয়দের হার বিলিয়েছে। কিন্তু ভুলে গেছে মাটির ব্যাংক ভেঙে টাকা দেয়া বোনের কথা। অনেক পরে অবশ্য মায়ের আবদার রাখতে গিয়ে চুলের মতো সরু চেইন একটি দিয়েছে পেয়ারা বেগমকে। কিন্তু সেটি পরা দুঃসাধ্য, ছিঁড়ে যায় যায় অবস্থা। এখন তো সেসব নিয়ে কথা বলাও দুষ্কর। বললে বিপত্তি ঘটবে। বাড়ির এবং বিদেশী সম্বন্দিদের কথা আর ব্যবহারের এখন যে ছিরি!
ক’বছর আগে বিদেশী সেজো সম্বন্দির বিয়ের সময়ের কথাই বলা যাক। বিয়েতে বেশ কিছু অপমানজনক ঘটনা ঘটেছিলো। অনুষ্ঠানের দিন এ ঘরের ও ঘরের ছোট ভাগনারা খাবার প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়ালেই একজন একজন করে তাদের তাড়িয়ে দিতে থাকে। একবার এক ভাগনাকে এমনভাবে ধাওয়া দিলো, যাকে বলে কুত্তা ধাওয়া। ধাওয়া খেয়ে ভাগনাটা প্যান্ডেলের ধাওয়ায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো। এর আগে কনে বাড়ি যাওয়া নিয়ে ঘটে আরেক বিপত্তি। বড় সম্বন্দির ব্যবসায়ী পারসন, মেজো সম্বন্দির তেলাইধরা লোকজন সবাইকে নিতে গিয়ে পরে এক এক করে বোনের জামাইদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হলো। সবচাইতে খারাপ দৃশ্যটি ছিলো এই যে, দূর থেকে আসা নেকবর আলীর নিজস্ব মেহমানদেরও গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এসব কারণে মন খারাপ ছিলো নেকবর আলীর। এর মধ্যেই ঘটলো আরেক কুটকা-। নেকবর আলী বিয়ে বাড়ির মেহমানদের উপহারসামগ্রী বুঝে নেয়ার দায়িত্ব পালন করছিলো। খাওয়ার সময় করে উঠতে পারছিলো না। আছর গড়িয়ে গেলে নেকবর আলী প্লেটে সামান্য ক’টা ভাত হাতে নিয়ে খেতে থাকলে মেজো সম্বন্দি ছিঃ ছিঃ করে উঠলো। বললেন, এতো মানুষের সামনে ভাত খাচ্ছেন। লজ্জা করে না। ছিঃ!
বাড়িভর্তি মানুষের সামনেই ঘটনাটা ঘটলো। নেকবর আলী আর স্থির থাকতে পারলো না। প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। বললো, আছর গড়িয়ে গেছে ভাত খাবো না কি হাওয়া খাবো! আপনাদেরইতো উচিৎ ছিলো আমাকে খাওয়ার সুযোগ করে দেয়া। নেকবর আলী আরো বললো, বিয়ে বাড়িতে বোনের জামাইদের কী উপোষ দেয়ার নিয়ম আছে? আমরা কি মেহমান না? আমরা কি উপহার নিয়ে আসিনি? সোনার আংটি দেইনি?
ক্ষেপে গেলেন মেজো সম্বন্দি।
হৈ-হল্লা চিৎকার হলো কতোক্ষণ। কিন্তু নেকবর আলী দমেনি। আচ্ছামতো কথা শুনিয়ে দিয়েছে। নেকবর আলীর সাথে শ^শুর পক্ষের টাকার ব্যবধান তখনও খুব বেশি ছিলো না। তাই সেদিন শক্ত কথা হজম করতে হয়েছে তাদের। নেকবর আলী বড় এবং মেজো সম্বন্দি দুটোকেই হাড়ে হাড়ে চিনে। বজ্জাতের হাড্ডি একেকটা। এখন শ^শুর-শাশুড়ি আর বিদেশী ভাইদের পা চাটা শুরু করেছে। ভাইদের টাকা খাটিয়ে বড় সম্বন্দি এখন বড় ব্যবসায়ী বনেছে আর মেজোটা বনেছে ধান্ধাবাজ। ধান্ধাবাজি করে সংসার চালাচ্ছে। পা চেটে ছেলেকে পাঠিয়েছে বিদেশ। অথচ নেকবর আলী নিজ চোখে দেখেছে মেজো সম্বন্দির ঘরে অহরহ মাছ মাংসের উৎসব গেছে কিন্তু আপন মা-বাবা আর এখনকার বিদেশী ভাইদের একটু তরকারি দেয়নি কখনো। আর বড়টা সবসময়ই কানাবগির মতো একচোখা হয়ে পাশ ফিরে হেঁটেছে। যে বিষয়টি নেকবর আলীর এখনও বিশেষভাবে মনে গেঁথে আছে, তা হলো, বিদ্যুৎ আসার পর দুই ছেলের ঘরে গরগর করে পাখা চলেছে। এমনটি চলেছে বছরের পর বছর। এদিকে বাপ-মা গরমে সিদ্ধ হয়েছে। নেকবর আলীর শাশুড়ি সুন্দর মানুষ। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেছে যে, শাশুড়ি ঘামে ভিজে জবজবে আর লাল হয়ে গেছে। পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে কতদিন বলেছে, ‘কবে একটু ফ্যানের বাতাস খামু।’ নেকবর আলী পরেরবারই শ^শুর-শাশুড়ির জন্যে টেবিল ফ্যান কিনে নিয়ে আসে।
টেবিল ফ্যান দেখে বড় সম্বন্দি আর মেজো সম্বন্দি গরুর মতো হেসেছে।
নেকবর আলীর এখন মনে হচ্ছে এই হা করে হাসা সম্বন্দি আর শ^শুরদের তার আগেই চেনা উচিৎ ছিলো। এরা যে একদিন তার সাথেও খারাপ ব্যবহার করবে তা আগেই ভাবা দরকার ছিলো। কেননা তার সামনেইতো অনেকবার তার শালী-জ্যাঠালিকে কাঁদিয়েছিলো এরা।
একদিনের স্মৃতি এখনও নেকবর আলী মন থেকে মুছতে পারছে না। নেকবর আলীর বড় জ্যাঠালির অবস্থা তখন খুব খারাপ। গাঙে জমি-জমা সব নিয়ে গেছে। ভিটাটুকু আছে মাত্র, যেকোনো সময় তাও গাঙের পেটে চলে যাবে ভাব। এ সময়ই বড় ভায়রার বাতের ব্যামো ধরেছে। খুবই খারাপ অবস্থা। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। বড় ভায়রা তখন তাদের জমি-জমা গিলে খাওয়া মেঘনা নদীতে মাছ ধরে। একদিন মাছ না ধরতে পারলে উপোষ থাকার মতো অবস্থা। জ্যাঠালি এসে বাবা-ভাইদের কাছে কেঁদেকুটে বলছে, ‘বাবা ও, ভাই ও আমার স্বামীকে বাঁচান। বাতের কারণে সে কাজ করতে পারছে না। ডাক্তার বলেছে, জরুরিভাবে কয়টা ইনজেকশন না দিলে চিরদিনের মতো সে পঙ্গু হয়ে যাবে।’
নেকবর আলীর স্পষ্ট মনে আছে তখন ছিলো বিকেলবেলা। শ^শুরের মুলির বেড়া দেয়া ছোট্ট চৌ-চালা ঘরের দক্ষিণ ওটায় বসে বাপ-ভাইয়ের হাতে-পায়ে ধরে বড় জ্যাঠালি কান্নাকাটি করছিলো। ওই কান্নাকাটির মধ্যেই একসময় মেজো সম্বন্দি বলে উঠলেন, ‘এখানে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ হবে না। তোর স্বামী বাঁচলে বাঁচবে না হলে মরে যাবে। আর মরে গেলে তুই সোজা আমাদের বাড়ি চলে আসবি। আমরা তোকে খাওয়াবো। কিন্তু সাবধান, আসার সময় ওই হারামজাদার (বালের জামাইর) কুত্তার ছা (ছেলেপুলে) একটারেও আনবি না।’ শুনে বড় জ্যাঠালি কান্না আরও বাড়িয়ে দিলেন। কান্নার মধ্যেই তিনি চলে যেতে উদ্যত হলেন। নেকবর আলীর শাশুড়ি মেয়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে মেজো বউকে বললো, বৌমা, শাফিয়াতো চলে যাচ্ছে। মেয়েটাতো কিছু খেলোও না। আমার ঘরেতো ভাত নাই, ক’টা ভাত থাকলে ওরে খাইতে দাও।
মেজো সম্বন্দির বউ নেকবর আলীর চোখের দিকে তাকিয়ে শাশুড়িকে ঝাঁপটা মেরে বললো, ‘আপনার ঝি, জামাইদের ব্যাপারে আমাকে কিছু কইয়েন না আম্মা। ওইসব নাটক আপনিই সামলান। আমারে কইয়া কোনো লাভ হইবো না।’
নেকবর আলী কী করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। দৌড়ে গিয়ে বড় জ্যাঠালির পথ আগলে দাঁড়ালো। বললো, আপনি কি পাগল হইছেন? কোথায় যাবেন আপনি?
বাড়িতে।
একটু পরেইতো সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাছাড়া আপনার কাছেতো কোনো টাকা-পয়সাও নাই। আপনি কীভাবে যাবেন?
‘পায়ে হাঁইটাই যামু। আমার স্বামীরেতো বাঁচাইতে অইবো’। জ্যাঠালি কাঁদছেন আর আঁচল দিয়ে চোখের পানি, নাকের পানি মুছছেন। এক পর্যায়ে নেকবর আলী বলে উঠলো, দাঁড়ান, আমিও যাবো আপনার সাথে।
নেকবর আলী জ্যাঠালিকে ৭ মাইল দূরে রিক্সায় করে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে।
নেকবর আলী এখন এসব কথা ভাবে আর মনে মনে হাসে। সেই জ্যাঠালি আর বড় ভায়রার সাথেই এখন তার শ^শুর-সম্বন্দিদের গলায় গলায় ভাব। বড় ভায়রার দু ছেলেও এখন বিদেশে। ভালো টাকা-পয়সা। নেকবর আলী মনে মনে ভাবে, টাকাই কি সব! টাকাই কি তবে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক মজবুত করে অথবা আগলা করে দেয়?
দুই.
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায় নেকবর আলী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল সোয়া পাঁচটা বাজে। গত ক’দিন যাবৎ নেকবর আলীর ভালো ঘুম হচ্ছে না। শ^শুর বাড়ির লোকজন একের পর এক কীসব জালিয়াতি কথাবার্তা বলে চলেছে। শুনে ঘেন্নায়-নেকবর আলীর গা গুলিয়ে যাচ্ছে। টাকা হয়েছে বলেই মানুষ এভাবে বদলে যাবে? হজ¦ করা শ^শুর, সে-ও অবলীলায় মিথ্যা কথা বলবে?
শীতের সকাল। বাহিরে হালকা কুয়াশা। আজ একটু শীত করছে। গত ক’দিন ভ্যাপসা গরম গেছে। সে হিসেবে আজ ভালো ঘুম হওয়ার কথা খাকলেও রাতে তেমন ঘুম হলো না। নেকবর আলী উত্তরের জানালায় দাঁড়িয়ে নদীর দৃশ্য দেখে। ডাকাতিয়ায় এখন ভাটার টান। ক’দিন আগেও এ নদীতে ছিলো পাড় উপচানো পানি। নেকবর আলী লক্ষ্য করলো, প্রবল ভাটার তোড়ে কচুরীপানা খড়কুটো সব ছুটে চলছে বড় নদীর মোহনার দিকে।
‘ও দয়াল কও তো দেখি একবার
ভাঙা নায়ে উজান ভাটায় কেমনে হই পার।’
গানটি কানে আসতেই নেকবর আলী পশ্চিম দিকে তাকালো। একদল মাঝি প্রবল ভাটায় জোরসে দাঁড় বাইছে আর গান গাইছে। হঠাৎই নেকবর আলীর মন উদাস হয়ে উঠতে চাইলো কিন্তু হলো না। তার চোখ আটকে থাকলো দক্ষিণ ঘাটে বাঁধা বালিশূন্য অলস কটি বালুর ট্রলারের ওপর।
গত শনিবারের শ^শুরের বলা কথাগুলো কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছে না নেকবর আলী। ‘রাস্তার পাশের জমিন কেনার টাকা আপনি দেন নাই, আমি দিছি। আমি তখন রুজি করি নাই? আমার পোলারা কি বিদেশ থাইক্যা তখন টাকা-পয়সা পাঠায় না’?
‘আপনার টাকায় কেনা জমিন হইলে জমিনের দলিল আমাকে দিলেন কেন?’
‘দিছি, এমনে দেই নাই, রাগের মাথায় দিছি। তখন রাগের মাথায় দিছি অখন ঠা-া মাথায় আমার দলিল আমারে ফিরায়ে দেন।’ চোখমুখ খিঁচিয়ে কথাগুলো বললো নেকবর আলীর শ^শুর। নেকবর আলী তার শ^শুরের পুরনো মুখটি খুঁজতে চেষ্টা করলো মনের আয়নায়। এই মানুষটিই তখন বেড়াতে এলে দু গাল প্রসারিত করে লম্বা হাসিতে ভরিয়ে রাখতেন মুখ। নেকবর আলী তার শ^শুরের রাস্তার পাশের জমিন কেনার সময়ের কথা ভাবে। চৌদ্দ হাজার টাকার চেক আগেই
জমা ছিলো শ^শুরের হাতে। জমিন কিনতে গিয়েছিলো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। তো?
নেকবর আলী শ^শুরের তখনকার অবস্থার কথাও মনে করতে চেষ্টা করে। তার অবস্থা তখনও ভালো ছিলো না। ছেলেরা বিদেশে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু ৮/১০ বছর পর্যন্ত দুই/তিনমাস পরে পরে শুধুমাত্র সংসার খরচের টাকা পাঠাতো। ওই দুই-তিন মাসের মাঝের সময় এর-ওর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার চালাতেন গ্যাপ পূরণের জন্যে। মাঝে মধ্যে নেকবর আলীর কাছ থেকেও টাকা ধার নিতেন। আর ব্যবসা-সেতো কবেই লাটে উঠে গেছে। দুই সম্বন্দি বিদেশ যাওয়ার ৭/৮ বছরের মাথায়ও বাড়ির পাকা লেট্রিনটি নেকবর আলীর টাকায় করাতে হয়েছে। রাস্তার পাসের জমিনতো কেনা হয়েছে তারও আগে।
দাঁতমুখ খিঁচানো এখনকার মুখ আর পুরনো দিনে নেকবর আলীকে দেখে তিনগাল হাসা শ^শুরের চেহারা পাশাপাশি ভেসে উঠতেই নেকবর আলীর মনে পড়লো ঈশপের কাক ও শিয়ালের গল্পের কথা। কাকের মুখের মাংসের টুকরো খাওয়ার লোভে ধূর্ত শিয়াল অবিরাম কাকের মুখের গান শোনার তাগিদ দিতে থাকে। কাকের গানের তারিফ করতে থাকে। প্রশংসা তার সইতে না পেরে বোকা কাক যেই না কা করে উঠলো অমনি মুখ থেকে পড়ে যাওয়া মাংসের টুকরো নিয়ে ধূর্ত শিয়াল জঙ্গলে দিলো দৌড়।
হঠাৎই নেকবর আলী নিজেকে ঈশপের গল্পের বোকা কাক রূপে আবিষ্কার করলো।