সৃজনশস্যে বঙ্গবন্ধু
সূচনা ভাষ্য :
পৃথিবীর ইতিহাসে এক অমর মহাকাব্যের নাম বঙ্গবন্ধু। বাইগার আর মধুমতীর জলে সিক্ত হয়ে যে খোকা একদিন কেঁদে উঠেছিলো টুঙ্গীপাড়ায় সেই খোকাই সময়ের নদীর ¯্রােতে বেড়ে উঠে হয়ে যায় সকলের বঙ্গবন্ধু। ঊনিশশো ঊনসত্তর সালের উত্তাল দিনগুলোতে, চারদিকে যখন আগুনের ফুলকিতে তিলে তিলে মাতৃগর্ভে তৈরি হচ্ছিল মুক্তি, তখনই চট্টগ্রামের সন্তান ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাকের দেওয়া উপাধিতে ইতিহাসের খ্যাতিমান খোকা নিমিষেই হয়ে উঠে সকলের ‘বঙ্গবন্ধু’। তোফায়েল আহমদের করিৎ কর্মে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে টেকনাফ হতে তেঁতুলিয়া ছাপিয়ে হিমালয়-আন্দিজ। বাইগার-মধুমতীর ¯্রােত মিশে যায় সুদূর হাডসন আর টেমসের ¯্রােতে। একজন শেখ মুজিব অবিরল ¯্রােতে বঙ্গবন্ধু হয়ে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে পৌঁছে যান আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের কূলে। পৃথিবীর আরেক কীর্তিমান ক্যাস্ট্রোর কাছে বঙ্গবন্ধুই হয়ে উঠেন হিমালয়ের প্রতীক। সাত মার্চের অনবদ্য ভাষণে নিউইয়র্কের নিউজ উইক ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনিই হয়ে উঠেন পৃথিবীর প্রথম 'পোয়েট অব পলিটিক্স'। লেলিন ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ নেই যার নাম বঙ্গবন্ধুর সমান উচ্চতায় স্বনিত হতে পারে। তাই মুজিব কেবল একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস নয়, মুজিব মানেই পৃথিবীর বহমান প্রেরণা, মুজিব মানেই পৃথিবীর অদ্বিতীয় বজ্রকণ্ঠ।
শাহাদাত বরণের আগে ও পরে মুজিবকে নিয়ে সৃজনে-মননে ঘটেছে বিপ্লব। এই সৃজন বিপ্লবের শস্যরূপে আমরা পেয়েছি প্রায় পঞ্চাশের অধিক মুজিবাশ্রয়ী গল্প, পেয়েছি অজ¯্র কবিতা, উপন্যাস ও গান। পেয়েছি নাটক, চলচ্চিত্র ও কাব্যনাট্য। ছড়া ও শিশুতোষ সাহিত্যে মুজিবের জীবন এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। গানে-প্রবন্ধে মুজিব ছড়িয়ে পড়েছেন মননশীল জগৎ হতে বিনোদন ও দেশাত্মবোধের অপ্রতিম সাম্রাজ্যে। প্রতিদিন আজও মুজিবকে নিয়ে নতুন কিছু না কিছু কেউ না কেউ সৃষ্টি করে চলেছেন। মুজিব আজ এক অনন্য সৃজন-বিপ্লবের নাম। মুজিবকে নিরন্তর সৃজনশস্যে আবিষ্কারের প্রয়াস আজ বর্ণিলভাবে বহমান।
কথা সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু :
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রায় পঞ্চাশটির মতো গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল প্রথম উদিত হন রাঙা অরুণ হয়ে তাঁর ছোটগল্প 'আত্মহত্যা'য়। ঊনিশশো ছিয়াত্তর সালে লেখা এই গল্পে তিনি রূপকের আশ্রয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা উদ্গীরণ করেছেন। সোহেলির স্বামী একজন মেজর, যে কিনা একজন নৃশংস খুনিও বটে। বঙ্গবন্ধুর খুনের সাথে জড়িত এই মেজর। খুনি স্বামীকে স্পর্শ করতে ঘৃণাবোধ করা স্ত্রী সোহেলি বারবার নিজেকে পরিষ্কার রাখতে কলের জলে হাতমুখ ধুয়ে নিতে আমরা দেখি। কিন্তু তারপরেও খুনির প্রতি তীব্র ঘৃণায় এক সময় স্ত্রী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। স্বামীর দূতাবাসের চাকরি সূত্রে মরুর দেশে এসে স্ত্রী সোহেলির আত্মদহনে আত্মহননের এই মর্মন্তুদ কাহিনী সে সময় অর্থাৎ ঊনিশশো সাতাত্তর সালের তেসরা নভেম্বরে আলোড়ন তুলেছিলো সাহিত্য জগতে। এমনি ভাবে পরবর্তীতে তাঁর আরো অন্যান্য গল্প 'ইতিহাসের কণ্ঠস্বর', 'কান্না', 'নিহত ঘুম' ইত্যাদিতে উঠে আসে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর এক বড় শুভকাক্সক্ষী কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান। তাঁর গল্প 'দুই সখী'তে তিনি ফুটিয়ে তোলেন বঙ্গবন্ধুর অসময়োচিত নৃশংস হত্যাকা-ের কথা। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে এমনি ভাবেই রচিত হয় আবু ইসহাকের ‘স্বপ্ন-সংবাদ’, হুমায়ূন আজাদের 'যাদুকরের মৃত্যু', অসীম সাহার 'ভ্রূণ', রাহাত খানের 'দীর্ঘ অশ্রুপাত', সৈয়দ শামসুল হকের 'নেয়ামতকে নিয়ে গল্প নয়' সেলিনা হোসেনের 'ক্রোধ', বিপ্রদাশ বড়ুয়ার 'ফিরে তাকাতেই দেখি', ইমদাদুল হক মিলনের 'নেতা যে রাতে নিহত হলেন', 'রাজার চিঠি' 'মানুষ বড় কাঁদছে', রশীদ হায়দারের 'এ নহে পতন' ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক উপন্যাসে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ্যণীয়। এই ইতিহাস ¯্রষ্টাকে নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত হয়েছে পাঁচটি উপন্যাস। সৈয়দ শামসুল হকের 'দুধের গেলাশে নীল মাছি', হুমায়ূন আহমেদের 'দেয়াল', সেলিনা হোসেনের 'আগস্টের একরাত', আনিসুল হকের 'যারা ভোর এনেছিল' ও 'ঊষার দুয়ারে' । এর বাইরে মোস্তফা কামালের 'জনক জননীর গল্প' উপন্যাসটিতে স্লোগানে জাতির পিতার সরব উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে। সেই চলচ্চিত্রের নাম 'পলাশী থেকে ধানমন্ডি'। এই উপন্যাসের রচয়িতা সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তার। এই চলচ্চিত্রে একটি বৃহৎ ক্যানভাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ধারণ করা হয়েছে যেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
কবিতায় বঙ্গবন্ধু :
বঙ্গবন্ধু তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি। শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়ার আগেই তিনি নায়ক হয়ে উঠে আসেন নির্মলেন্দু গুণের 'হুলিয়া' কবিতায়। ঊনিশশো সাতষট্টি সালের বারো নভেম্বর কবি নির্মলেন্দু গুণ মুজিবকে নিয়ে লেখেন একটি কবিতা 'প্রচ্ছদের জন্য'। ঊনিশশো ঊনসত্তরে লেখা তাঁর 'হুলিয়া' কবিতায় তিনি তুলে আনেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে, "শেখ মুজিব ভুল করছেন নাতো?' এই প্রশ্নের মাধ্যমে। এই অমর চরণে সেদিন তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন শেখ মুজিবের দূরদর্শী নেতৃত্ব গুণের কথা, যিনি ধীরে ধীরে ছয়দফা থেকে ক্রমশ কৌশল গুটিয়ে আনছিলেন দেশের স্বাধীনতার দিকে।
ষাটের দশকে নির্মলেন্দু গুণ ও জসিমউদ্দীনের কবিতায় শেখ মুজিব চিত্রিত হয়ে উঠেছেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে। সৃজনশস্যের চাষী কবিদের কাছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর হতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক হয়ে গিয়েছিল প্রায়। উত্তাল ষাট ও সত্তরের দশক ব্যাপী বিশ্বজুড়ে শোষিত মানুষের মুক্তির প্রতীকে পরিণত হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। পঁচাত্তরের পনর আগস্টের পর দেরিতে হলেও ঊনিশশো সাতাত্তর সালে মুজিব বিরোধী সামরিক শাসনকালে দেশের বৈরী পরিবেশে কবিরা তাঁকে স্মরণ করার সাহস দেখিয়েছেন। পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও শেখ মুজিবের মর্মন্তুদ অনুপস্থিতিকে প্রেরণা হিসেবে মেনে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবিরা। কবিরা সে সময় এগিয়ে এসেছেন নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমানের প্রদর্শিত পথে। কবিরাই বলেছিলেন সেদিন 'বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান'। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই স্বৈরাচারী শাসকের বিরূদ্ধে বিস্তৃত হয়েছে সত্তরের দশকের প্রতিবাদী কবিতামালা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে প্রথম উচ্চারণ করেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। ঊনিশশো সাতাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে সামরিক শাসনের কড়া পাহারায় বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সফেদ শ্মশ্রুতে ঋষির অবয়বে তিনি পাঠ করেন, "সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ/গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি'।
এই সাহসী উচ্চারণ যেন এক লহমায় খুলে দিলো ভীতির অর্গল। আর সেই মুক্ত দুয়ার দিয়ে অবমুক্ত হতে থাকল কবির মনে জমে থাকা একের পর এক কবিতা। কবি নির্মলেন্দু গুণই একমাত্র কবি যাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধু এসেছেন সর্বাধিকবার।
কবির 'মুজিবমঙ্গল' কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে মুজিবকে নিয়ে লেখা তিরিশটির মতো কবিতা যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতা হলো 'প্রচ্ছদের জন্য : শেখ মুজিবুর রহমানকে', 'সুবর্ণ গোলাপের জন্য', 'শেখ মুজিব ১৯৭১', 'সেই খুনের গল্প ১৯৭৫', 'ভয় নেই', 'রাজদ-', 'আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি', 'মুজিব মানে মুক্তি', 'শেষ দেখা', 'সেই রাত্রির কল্পকাহিনী', 'স্বাধীনতা, এই শব্দটি কিভাবে আমাদের হলো', 'শোকগাথা : ১৬ আগস্ট ১৯৭৫', 'পুনশ্চ মুজিবকথা', 'আগস্ট শোকের মাস, কাঁদো', 'প্রত্যাবর্তনের আনন্দ' ইত্যাদি ।
বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান 'ইলেকট্রার গান' কবিতায় মুজিবকে নিয়ে রচনা করেন বেদনামথিত শোকবিলাপ। গ্রীক রাজা অ্যাগামেননের হত্যাকা-ের সাথে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুকে রূপকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট করে তিনি গভীর মমতায় কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন। তাঁর কবিতায় আমরা পাই,
'নিহত পিতা, অ্যাগামেননের কবরে শায়িত আজ/আড়ালে বিলাপ করি একা/আমার সকল স্বপ্নেও তুমি/নিষিদ্ধ আজ তোমার দুহিতা একী গুরুভার বয়'।
কবি কামাল চৌধুরী ঊনিশশো সাতাত্তর সালের নয় ফেব্রুয়ারি রচনা করেন 'জাতীয়তাময় জন্মমৃত্যু' শীর্ষক দ্রোহপূর্ণ কবিতাটি। তাঁর কবিতায় আমরা পাই, 'রক্ত দেখে পালিয়ে গেলে/বক্ষপুরে ভয়/ভাবলে না কার রক্ত এটা স্মৃতি গন্ধময়/দেখলে না কার জন্ম মৃত্যু জাতীয়তাময়। '
কবি ময়ূখ চোধুরীর দুটো চরণে পঁচাত্তরের আগস্ট বেদনাময় হয়ে উঠে, 'কেনো আগাছার ভিড়ে বিষধর সাপের ভেতর/বেড়ে উঠেছিলে তুমি, গড়েছিলে স্বপ্নের কবর। '
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় আমরা পাই, 'নমিত হৃদয় আজ/দিকে দিকে পতাকাও/নমিত সে শোকে/তেরশত নদী আজ/অশ্রু ঢালে কোটি কোটি মানুষের চোখে। '
জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের 'ডাকিছে তোমারে', জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর 'কোন ছবিগুলি', হাসান হাফিজুর রহমানের 'বীর নেই', 'আছে শহিদ', বেলাল চৌধুরীর 'রক্তমাখা চরমপত্র', মহাদেব সাহার 'আমি কি বলতে পেরেছিলাম', শহিদ কাদরীর 'হন্তারকের প্রতি', হেলাল হাফিজের 'নাম ভূমিকায়', আসাদ চৌধুরীর 'দিয়েছিলে
সকল আকাশ', ত্রিদিব দস্তিদারের 'জনকের ছায়া', সানাউল হকের 'লোকান্তরে তুমি আত্মদানে', আবিদ আনোয়ারের 'প্রতিরোধ' কবিতাগুলি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক একটা কালের দলিল।
ঊনিশশো আটাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যতরুণ গোষ্ঠীর একুশের স্মরণিকা 'এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়' প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এটিই হলো প্রথম প্রতিবাদী কবিতা-সংকলন। দুঃসাহসিক এ সংকলনটি ছিল তিরিশটি ছড়া ও কবিতার সমন্বয়ে সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শোকাঞ্জলি নিবেদনের অতুলনীয় নিদর্শন। এই সংকলনে গ্রন্থিত ভীষ্মদেব চৌধুরীর 'পিতা : তোমার জন্যে' শিরোনামে একটি অনবদ্য কবিতা প্রকাশিত হয়। আরেক বিখ্যাত কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে চিত্রিত করেছেন এভাবে,
আমি কবি এবং কবিতার কথা বলছি।
সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা;
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা;
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা;
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।
আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো;
আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন কবীর চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, মযহারুল ইসলাম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবুল হোসেন, রোকনুজ্জামান খান, কায়সুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, রুবী রহমান, মাহবুুব সাদিক মনজুরে মওলা, নাসির আহমেদ, অসীম সাহা, মহীবুল আজিজ, মুহাম্মদ সামাদ, খালেদ হোসাইন, শামীম রেজা, আমিনুর রহমান সুলতান, সৌরভ জাহাঙ্গীর প্রমুখ। প্রতিবাদী কবি নূরুল হুদার সাহসী উচ্চারণ তার কবিতায়, 'নেইতো তাহার জিভ/যে বলেনি জাতির পিতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব'। কবিতাতেই তিনি আরও বলেন, 'চল্লিশ হাজার বছর পরে তোমার স্মরণ নেবে/তোমার বাঙালি’।
ছড়া ও শিশুসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু :
ছড়া একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ছড়ার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধু আরো ছড়িয়ে পড়েছেন মানুষের হৃদয়ের গভীরে। অন্নদা শংকর রায়ের সেই অমর ছড়া আজও আমাদের প্রেরণা:
'যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা
গৌরী যমুনা বহমান
ততদিন তুমি অমর রবে
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা
রক্তগঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান। '
ছড়াকার আনজীর লিটনের ছড়ায় আমরা পাই,
'মুজিব ছাড়া বাংলা-বলো
কেমন করে মানতে পারি?
একটা জাতির একটা মুজিব
কোত্থেকে আর আনতে পারি?'
আবার আখতার হুসেনের 'তুমি মুজিবর' ছড়ায় আমরা পাই,
'তুমি মুজিবর, আত্মার স্বর
তুমিই তো দেশ, তুমি প্রতি ঘর।'
ছড়াকার আমীরুল ইসলামের ছড়া 'শেখ মুজিব'-এর চরণে চরণে আমরা পাই,
'তুমি আমাদের হাজার বছরে
একটি আলোর দীপ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। '
এমনি ভাবে শিশুদের জন্যে অজ¯্র ছড়া-কবিতায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে আজও জীবন্ত হয়ে।
গানে-প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধু :
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সৃজনশস্য হিসেবে গানের অন্ত নাই। গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের কালজয়ী গান 'শোনো একটি মুজিবরের ---' হতে শুরু করে 'মুজিব বাইয়া যাও রে', 'যদি রাত পোহালে শোনা যেত/বঙ্গবন্ধু মরে নাই--' ইত্যাদি হাজারো গানে মুজিব আজ জেগে আছে এই বাংলায়।
মুজিবকে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধের যেমন অন্ত নাই তেমনি ছোটদের জন্যে 'বঙ্গবন্ধু
কোষ', 'শেখ মুজিবকে নিয়ে বিখ্যাত মানুষের উক্তি' ইত্যাদি বিভিন্ন বইও আজকাল লিখিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মুজিবকে নিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ড. মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থগুলো অনন্য সম্পদ। 'বঙ্গবন্ধু কোষ'-এর মাধ্যমে শিশুরা এক লহমায় বিভিন্ন বঙ্গবন্ধু বিষয়ক তথ্য আজ হাতের মুঠোয় পাচ্ছে।
বিদেশি সাহিত্যিকের সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু :
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিদেশি সাহিত্যিকদেরও চর্চার শেষ নেই। মনে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতা 'রাসেল, অবোধ শিশু তোর জন্যে আমিও কেঁদেছি/খোকা তোর মরহুম পিতার নামে /যারা একদিন তুলেছিলো আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি/তারাই দুদিন বাদে থুথু দেয়, আগুন ছড়ায়/আমি ক্ষমা চাই আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই। ' কবিতার প্রতিটি পরতে পরতে রাসেল ও বঙ্গবন্ধুর মুখ ফুটে উঠে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতি উত্তরে নয়াদিল্লির সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মনিপুরের অন্যতম শীর্ষ কবি এলাংবম নীলকান্ত তাঁর ‘তীর্থযাত্রা’ গ্রন্থে ‘শেখ মুজিব মহাপ্রয়াণে’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন। মার্কিন লেখক রবার্ট পেইনের ‘দি চর্টার্ড এন্ড দ্য ডেমড’, সালমান রুশদীর ‘মিড নাইট বিলড্রেম’ এবং ‘শেইম’, জাপানি কবি মাৎসুও শুকাইয়া, গবেষক ড. কাজুও আজুমা, প্রফেসর নারা, মার্কিন কবি লোরি অ্যান ওয়ালশ, জামান কবি গিয়ার্ড লুইপকে, বসনিয়ান কবি ইভিকা পিচেস্কি ও ব্রিটিশ কবি টেড হিউজসহ বিভিন্ন বিদেশি কবির কবিতায় বঙ্গবন্ধু জীবন্ত হয়েছেন নানাভাবে।
পাকিস্তানের পাঞ্জাবি কবি আহমেদ সালিম পাঞ্জাবি ভাষায় লাহোর ডিস্ট্রিক্ট জেলে বসে ‘সিরাজউদ্দৌল্লাহ ধোলা’ কবিতাটি লিখে উৎসর্গ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে। কবিতাটিতে তিনি সিরাজ উদ দৌলা ও শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার রক্ষক হিসেবে ব্যক্ত করেন।
ভারতের উর্দু কবি কাইফি আজমী ‘বাংলাদেশ’ কবিতায়, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান সাহিত্যিক আবিদ খানের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ‘সিজনাল এডজাস্টমেন্ট’ উপন্যাসে প্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধুর কথা এসেছে।
মার্কিন সাংবাদিক এবং ঔপন্যাসিক অ্যানি লোপা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, 'শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ঘরোয়া পরিবেশে। একবারও মনে হয়নি এতো বড় একজন নেতার সামনে বসে আছি। বন্ধুসুলভ মুজিব নিজে চায়ের কাপ তুলে দিলেন আমার হাতে। এমন অসাধারণ মনের পরিচয় পাওয়া কঠিন। আমার সাংবাদিক জীবনে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছি, বহু নেতা-নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি, কিন্তু বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতো এমন সহজ-সরল মানুষ আর পাইনি। '
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, 'আজকের দিন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আছে কাল, একশ মুজিব যদি মিথ্যে হয় তবুও থাকে সত্য। '
কবি আবু জাফর শামসুদ্দিনও তাঁর ‘আরেক ভুবন : সোভিয়েত ইউনিয়ন’ গ্রন্থে বলেছেন, রুশদের কাছে বঙ্গবন্ধু মানেই ছিল বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংকলন :
বাঙালির গৌরবের ধন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংকলন গ্রন্থের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। বেবী মওদুদ সম্পাদিত একটি সংকলন ছাড়াও বিশাখা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মুজিব মঙ্গল’ নামে বাইশজন কবির কবিতা সম্বলিত একটি কাব্য সংকলন। নামটি বাইশ কবির মনসা মঙ্গল হতে নেয়া হয়েছিল। কবি ও প্রাবন্ধিক সুমন্ত রায় অমর একুশে বই মেলায় প্রকাশ করেছেন ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিবেদিত শ্রেষ্ঠ কবিতা’ নামক একটি সংকলিত কাব্যগ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ ‘দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ প্রত্যয় জসীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। পঁচাশি জন কবির কবিতায় পুষ্ট সংকলনটি। শিশু সাহিত্যিক এমরান চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'বঙ্গবন্ধু'-নিবেদিত ছড়া-কবিতা সংকলন, যাতে একশ চার জন কবির লেখা স্থান পেয়েছে।
মোনায়েম সরকারের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খ্যাতিমান ও তরুণ পাঁচশ’ কবির লেখা কবিতা সংকলন ‘মুজিব মানে মুক্তি’ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রবাস প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কবিতা সংকলন ‘বাংলাদেশের আকাশ’। সম্পাদনা করেছেন কাজল রশীদ।
বঙ্গবন্ধুর নিজের লিখিত রোজনামচা হতে প্রকাশিত হয়েছে একটি অসামান্য গ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। এই বইটিতে আমরা অনন্য মুজিবকে জানতে পারি। তিনি যে লাহোর-করাচি গিয়ে নজরুল-রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনিয়ে এসেছেন তা উঠে এসেছে এই বইটিতে।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। ‘শেখ মুজিব : আমার পিতা’ এই গ্রন্থে আমরা নেতা ও পিতা মুজিবকে খুঁজে পাই। এছাড়াও বেবী মওদুদ ও শেখ হাসিনা সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি, উর্দু, মনিপুরী, জার্মান ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধু আজ ঘুরে বেড়াচ্ছেন পৃথিবী।
একজন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উৎপাদিত সৃজনশস্যের ভা-ার অসীম এবং ক্রমবর্ধিষ্ণু। বঙ্গবন্ধু কেবল বাঙালির নয়, পৃথিবীর সম্পদ। যতদিন যাবে ততোই বঙ্গবন্ধু চর্চা বৃদ্ধি পাবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ-কাব্য নিয়ে আজ গবেষণা-গ্রন্থ হয়েছে এবং তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের উৎস খোঁজা হচ্ছে। যত দিন যাবে বঙ্গবন্ধু ততোই নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কৃত হবেন ভক্ত সমীপে। যে ছড়ায় বঙ্গবন্ধুকে নদীর মতো বহমান করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সারাবিশ্বে, সেই ছড়া দিয়েই শেষ নিবেদন হোক এই আলোচনায়,
'শোষিতের হয়ে সংগ্রামী যতো
ইতিহাসে পেলো মান
বিরল সে সব নামের শীর্ষে
শেখ মুজিবুর রহমান।
যাঁর তর্জনী শোষকের যম
শোষিতের দীপে দম
তাঁর কন্ঠের বজ্রের ঘায়ে
মেঘ কাটে হরদম।
হাজার বছর পার হয়ে যাবে
হাজার বছর গেছে
পৃথিবীর বুকে বঙ্গবন্ধু
রবে চিরকাল বেঁচে। '
সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ