চাঁদপুর নির্বিচারে নিধন হচ্ছে মাছের পোনা
চাঁদপুর নৌ-সীমানার পদ্মা-মেঘনা নদীতে নির্বিচারে চলছে জাটকার সাথে বাইলা, চিংড়ি, পাঙ্গাশ, আইড়, রিটা, পাবদা, পোয়া, টেংরা মাছের রেণু-পোনা নিধন। নদীতে এসব মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না আসাধু জেলেদের। এক শ্রেণীর জেলে আইন না মেনে প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ঠিকই জাটকাসহ অন্য মাছও তারা ধরছে। বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হাত করে দিন-রাত নিষিদ্ধ জাল দিয়ে এসব পোনা ধরছে অসাধু জেলেরা। আর নিধনকৃত মাছের পোনা বেচতে হাঁক-ডাকে শহরের অলিগলি মুখরিত করে তুলছে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে বলেন, শীতের সময়টাতে নদীতে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন মাছের পোনা পাওয়া যায়। গুঁড়া মাছ ধরতে নদীতে নামার আগে প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হাত করা লাগে। এরপর জোয়ার-ভাটার সময় বুঝে বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ জাল নিয়ে নদীতে নেমে পড়ে তারা। নদীগুলোতে এ সময় নানা ধরনের মাছের পোনায় ভরপুর থাকে। তাইতো মধ্যরাতে পাতাজাল, বেহুন্দীজাল, মশারী জালসহ নানা ধরনের নিষিদ্ধ জাল নিয়ে নদীতে নামছে অসাধু জেলেরা। পরে নিধনকৃত এসব মাছের পোনা নিয়ে সকাল থেকে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় হাঁকডাকে মুখর করে তোলে ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রেতারা। ভ্যানগাড়িতে বড় বড় পাত্রে সাজিয়ে বিক্রি করে বাইলা, চিংড়ির সাথে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা। কেউ বা আবার মাথায় নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করে। দাম কম থাকার কারণে ক্রেতারাও লুফে নিচ্ছে তা। শহরের প্রতিটি অলিগলিতেই চোখে পড়ছে এমন দৃশ্য।
মূলত নদীতে থাকা অধিকাংশ মাছই শীত মৌসুমের আগে ডিম ছাড়ে। শুধু তা-ই নয়, এসব জালে মাছের রেণুর পাশাপাশি উঠে আসছে কাঁকড়াসহ উপকারী বিভিন্ন জলজ প্রাণীও। দেখা যাচ্ছে নিধনকৃত মাছের রেণু পুরাণবাজারসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে নদীর পাড়েই দাদনদারদের কাছে বিক্রি করছে। নদী তীরবর্তী রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী কতিপয় নেতা কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে জেলেদের দিয়ে নদীতে জাটকা নিধন করার অভিযোগ উঠেছে। রাতভর জাটকা ধরার পর চিহ্নিত কিছু লোক রাত দশটার পর এবং ভোর বেলায় জাটকা ক্রয়-বিক্রয়ে মেতে থাকে। জাটকার পরিমাণ বেশি হলে ট্রলারে নদী পথে ও গাড়ি দিয়ে সড়ক পথে পাচার করছে। এই জাটকা মাছ ক্রয়-বিক্রয় করে কিছু লোক ইতোমধ্যে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গত বছর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাটকা ধরার অপরাধে এবার রেকর্ড পরিমাণে জেলে আটক হয়ে কারাগারে গেছেন। বিপুল পরিমাণ জাল, নৌকা ও জাটকা মাছ জব্দ হয়েছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে কেউ জাটকা ইলিশ শিকার করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তারপরও নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না অসাধু জেলেদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জাটকা অধ্যুষিত হাইমচরের মেঘনা নদীতে অবাধে জাটকা ধরছেন জেলেরা। জেল-জরিমানার তোয়াক্কা না করেই তারা জাটকা ও বাইলার পোনা শিকার করছেন। শুধু তাই নয়, পাঁচ-সাত ইঞ্চি সাইজের পাঙ্গাশের পোনাও নিধন করা হচ্ছে। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা কৌশলে বিভিন্ন বাজারে এসব জাটকা, পাঙ্গাশের পোনা ও বাইলার পোনা বিক্রি করছেন। এছাড়া চাঁদপুর শহর রক্ষাবাঁধের আশপাশের মেঘনা নদীতে কিছু জেলে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। তাদের বড়শিতে ছোট ছোট পাঙ্গাশ পোনা ধরা পড়ায় সেই মাছ শহর এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে বিক্রি করতেও দেখা গেছে। বর্তমানে ফ্রি স্টাইলে মতলব উত্তর উপজেলার একলাসপুর থেকে শুরু করে বোরোচর, আমিরাবাদ, চাঁদপুর সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর, তরপুরচণ্ডী, কল্যাণপুর, রাজরাজেশ^র ইউনিয়নের নদী এলাকা, শহরের যমুনা রোড, টিলাবাড়ি, পুরাণবাজার হরিসভা রণাগোয়াল, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দোকানঘর, রামদাসদী খাল, বহরিয়া লক্ষ্মীপুর, হরিণা ফেরি ঘাট সংলগ্ন খাল, আখনের হাট, মেঘনার পশ্চিমে ইব্রাহিমপুর চর এলাকা এবং হাইমচর উপজেলার বিস্তীর্ণ নদী জুড়ে অগণিত জেলে নদীতে নামছে এবং জাটকাসহ অন্য রেণু মাছ নিধন করছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, জাটকা বড় হলে পূর্ণাঙ্গ ইলিশে এবং পাঙ্গাশের পোনাগুলো বড় হবার সুযোগ পেলে বড় আকৃতির পাঙ্গাশে পরিণত হতো। পাশাপাশি বাইলার পোনাগুলোও অনেক বড় হতো। অথচ মৎস্য বিভাগের নজর নেই সেই দিকে।
এদিকে মৎস্য গবেষকরা বলছেন, এভাবে নির্বিচারে মাছের পোনা নিধন করার কারণে নদ-নদীতে হ্রাস পাচ্ছে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন। এখনই কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে ভবিষ্যতে নদীগুলো মাছশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা তাদের।
চাঁদপুর নৌ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, এসব রেণুপোনা ধরতে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার করা হয় । আর এ নিষিদ্ধ জালের ব্যাপারে আমাদের চলমান অভিযান ও কম্বিং অপারেশন অব্যাহত আছে।
জেলা মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি রোটারিয়ান আবদুল বারী জমাদার মানিক জানান, নির্বিচারে রেণু পোনা নিধনের ফলে চাঁদপুরে প্রতিনিয়তই কমছে মাছের উৎপাদন। আর এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এই চক্রের সাথে জড়িত থেকে গুঁড়া মাছ ধরাচ্ছে। আগে সারা বছরই নদীতে ছোট-বড় মাছ পাওয়া যেত। এখন ভরা মৌসুমেও জেলেরা মাছ পায় না। যে করেই হোক নদীতে গুঁড়া মাছ ধরা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, জাটকা নিধনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কম্বিং অপারেশন অব্যাহত আছে। তবে ভাটি অঞ্চল থেকে বেশি জাটকা এখানে আসে বলে তিনি দাবি করেন। জাটকাসহ অন্যান্য রেণুু নিধনের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রজাতির জাল ব্যবহারের বিষয়ে এখানে চারটি ধাপে কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।