• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

সিন্ডিকেটের আখড়া চাঁদপুর মাছঘাট, নেই তদারকি

প্রকাশ:  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

ইলিশের জন্যে ব্র্যান্ডিং জেলা চাঁদপুরে এ সময় ইলিশের আমদানি বাড়লেও এর দাম দেশের অন্য স্থানের তুলনায় অনেক বেশি। এই মাছ এখন সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কঠিন সিন্ডিকেট থাকায় ইলিশ আহরণকারী, জেলে, ফরিয়ারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ইলিশ কমদামে বিক্রি করতে পারছে না। বাজার তদারকি না থাকায় এখানকার ব্যবসায়ীরা তাদের ইচ্ছেমতো ইলিশের দাম নির্ধারণ করে শক্তিশালী সিন্ডিকেট বজায় রেখেছেন বলে অভিযোগ সাধারণ ক্রেতাদের। কিন্তু চাঁদপুরে ইলিশ ব্যবসা সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এমনটি মানতে নারাজ এখানকার মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল বারী জমাদার মানিক। তিনি বলেন, এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই। মূলত মাছ আমদানি কম তাই দাম বেশি। সিন্ডিকেট করে লাভ তো নেই। কারণ ইলিশের দাম বেশি হলে ক্রেতা কমে যায়। সেজন্য খুচরা বিক্রেতারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি বলেন, বিগত বছরে এখানে এসময় প্রায় তিন-চার হাজার মণ ইলিশ আমদানি হত। কিন্তু এবার গড়ে ১৫-১৬শ’ মণ ইলিশ আসছে। জ্বালানি হতে শুরু করে ফিশিং বোট, জেলে ও ট্রলারের খরচ তিনগুণ বেড়েছে। সেজন্যে মাছের দামতো বাড়বেই।
তিনি আরো বলেন, ক’দিন ধরে ইলিশ আসতে শুরু করলেও পরিমাণে অন্যান্য বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। বিগত কয়েক বছরই আমাদের চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশের উৎপাদন অনেক কমে গেছে। এর কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নদীতে অসংখ্য চর জেগেছে, নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে এবং সাগর থেকে যখন মেঘনায় মাছ আসবে সেখানে বরিশাল, হাতিয়া ও ভোলায় অসংখ্য জেলে একসঙ্গে ইলিশ আহরণ করে। এত পরিমাণ জেলে ও জাল পেরিয়ে মেঘনায় ইলিশ আসা খুবই দুরূহ ব্যাপার।
বর্তমানে ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। অক্টোবর পর্যন্ত থাকবে এই মৌসুম। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায় সাগর উপকূলীয় এলাকা থেকে চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আসছে বড় বড় সাইজের ইলিশ। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার ট্রলারে করে ইলিশ  আসছে খুবই কম। যে-সব ইলিশ এখানে আসছে বেশির ভাগই আসছে ট্রাকযোগে। এখানকার অর্থাৎ পদ্মা- মেঘনার ইলিশের চাহিদা বেশি থাকায় আড়ৎগুলোতে বেড়েছে ক্রেতার সংখ্যা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে লোকজন আসছেন মাছ কিনতে। এ ক্ষেত্রে সাগর বা উপকূলীয় নদী থেকে আহরিত  ইলিশকে মাছঘাটেই লোকাল ইলিশ বলে প্রকাশ্যে হাঁক-ডাক দিয়ে বিক্রি করেন কতিপয় খুচরা ব্যবসায়ী। এমন অভিযোগ থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন কিংবা মাছ ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দকে উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
জেলা সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) সভাপতি ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া বলেন, ইলিশ উৎপাদন খরচ নেই, আহরণই খরচ হয়। আসলে সবকিছুর দাম বাড়ার হিড়িকের সাথে এখানকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ইলিশের দাম বাড়িয়েছে। মূলত ইলিশের দাম পরিমাণ কম-বেশির উপর নির্ভর করে না। তিনি বলেন, চাহিদা বৃদ্ধির সাথে ইলিশের জোগান কম হওয়ার সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কেননা ইলিশের জোগান কম হলেও তাদের উৎপাদন ও আহরণ ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এতে পরিষ্কার বুঝা যায়।
ঢাকা থেকে ইলিশ কিনতে আসা আবদুল জব্বার বলেন, শুনেছি চাঁদপুরে ইলিশের দাম কম। কিন্তু এখানে এসে দেখি ঢাকার চাইতে বেশি দাম। তারপরেও কিনেছি। খেয়ে বুঝতে পারব, চাঁদপুরের নাকি সাগরের ইলিশ।
শনিবার লঞ্চে করে ঢাকা থেকে চাঁদপুর ইলিশ কিনতে এবং ঘুরতে এসেছেন বেশ ক’জন যুবক। এর মধ্যে  মুশফিক নামে একজন জানান, ইলিশ নিয়ে চাঁদপুর ব্র্যান্ডিং হয়েছে। ইলিশের জন্যে চাঁদপুর দেশ-বিদেশে পরিচিত। তাই ইলিশের আসল স্বাদ নেয়ার জন্য এসেছি। দাম পছন্দসই হলে ইলিশ কিনে নিয়ে যাব। মাছঘাট সূত্রে জানা যায়, এখানে প্রায় অর্ধ শতাধিক মৎস্য আড়তের অধীনে প্রায় দেড় শতাধিক ব্যবসায়ী আছেন।  খুচরা বিক্রেতা আছেন আরো কমপক্ষে অর্ধশত। প্রায় বিশটির মতো অনলাইনেও অনেকে ইলিশ বিক্রি করেন। তবে বেশ ক’জন খুচরা ইলিশ বিক্রেতার সাথে কথা বলে দামের ক্ষেত্রে বেশ তারতম্য পাওয়া গেছে। একই ইলিশ প্রতিকেজি ২০০-৩০০ টাকা কম-বেশি দরে বিক্রি করছেন।
চাঁদপুর মাছঘাটে মাছ কিনতে শহরের  ঢালিরঘাট থেকে আসা শফিক ভূঁইয়া জানান, জেলা সদরের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা প্রশাসনের বাজার তদারকি অভিযান থাকলেও মাছঘাটে কোনো অভিযান নেই। যে কারণে এখানে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো মাছের দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করে আসছেন। গতকাল মাছঘাটে কেজি সাইজের ইলিশ  ১৫০০ থেকে সাড়ে ১৬শ’ টাকা দরে বিক্রি করতে  দেখা গেছে। দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি কেজি ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী শবেবরাত সরকার বলেন, আমাদের চাঁদপুরে সাগরের ইলিশ আসে না। হাতিয়া, রামগতি ও আলেকজেন্ডার থেকে ইলিশ আসে। সাইজ অনুসারে দাম কম-বেশি হয়। প্রতিদিনই ইলিশের দাম ওঠানামা করে। প্রকাশ্যে ডাক দিয়ে মাছ বেচা-কেনা হচ্ছে।
এদিকে অতিরিক্ত মূল্যে ইলিশ বিক্রি না করা, ইলিশের ক্রয় ভাউচার সংগ্রহ রাখা ইত্যাদি বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে গত শনিবার ২ সেপ্টেম্বর সকালে চাঁদপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নূর হোসেন রুবেল। কিন্তু এরপর বাজার তদারকিতে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। এই বিষয়ে নূর হোসেন রুবেল  জানান, ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত তদারকি অভিযান হয়নি। তবে শিগগিরই করা হবে।
মাছঘাটের বেশ ক’জন খুচরা বিক্রেতা জানান, চাঁদপুরে যে পরিমাণ ইলিশ আমদানি হয়, তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। লোকালে জেলেরা যা পাচ্ছে, তার দামও খুব চড়া। মাছঘাটে দাম বেশি হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে এখন জেলার বিভিন্ন বাজারেও। মূলত চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীর মাছ অনেক কম। সাগর উপকূলীয় নদীর যে ইলিশ  এখানে আসছে তা দুপুরের আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।  এ সুযোগে ইলিশের দামও বেশি হাঁকা হচ্ছে-এমনটিই ঘাটে গিয়ে লক্ষ্য করা গেছে।
কুমিল্লার হোমনা থেকে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে  আসা ক’জন ক্রেতা বলেন, প্রতিবছর আমরা এসময় দলবেঁধে ইলিশ কিনতে এখানে আসি। কিন্তু এবার এসে দেখি ভিন্ন চিত্র। চাঁদপুর ঘাটে ইলিশের দাম বেশি। তাইতো যে পরিমাণ মাছ কেনার আশা নিয়ে এসেছিলাম অল্প কয়টা মাছ কিনেছি। নদীর জীবিত তাজা পাঙাশ ও রিডা মাছ কিনে নিয়েছি। গত বছর এই সময়ে ইলিশের দাম আরও অনেক কম ছিল বলে জানান তারা।
পচা ইলিশের ডিম ও নোনা মাছ চাঁদপুরের বড়স্টেশন মাছঘাটে গত ক’বছর ধরে অর্ধগলিত পচা ইলিশও আসছে। এসব পচা ইলিশ লবণজাত করে লোনা ইলিশ করে বিক্রি করছে। সড়ক পথে আসা সারি সারি ট্রাক, পিক-আপ ও কভার্ডভ্যান এবং পন্টুন ঘাটে নদী পথে আসা ট্রলারে এসব ইলিশ মাছ বিক্রির জন্য চাঁদপুর মোকামে নিয়ে আসা হয়। যার একটা অংশ বাসি-পচা ও অর্ধ গলিত ইলিশ। মূলত অপেক্ষাকৃত দুর্বল পচা ইলিশের পেট থেকে ডিম বের করে বিশেষ বক্সে করে মোটা দামে বিক্রি করা হচ্ছে। আর পচা ইলিশ কেটে লবণ দেয়া হচ্ছে। বিশেষ প্রক্রিয়াজাত করে নোনা ইলিশে পরিণত করা হচ্ছে এ ঘাটে। দিনে-রাতে বেশ ক’জন নারী পুরুষ শ্রমিক এসব মাছ নোনা ও ডিম আলাদা করে সংরক্ষণে ব্যস্ত  সময় পার করছেন এখন। এসব নোনা ইলিশের বেশিরভাগই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। এসব অর্ধ পচা ইলিশ ও ডিম স্বাস্থ্যের জন্য কতটুকু সহায়ক বা ক্ষতিকর। এ ব্যাপারে পচা ইলিশের ডিম রান্না করলে শক্ত হয়ে যায় এবং স্বাদ গন্ধ খুব একটা থাকে না বলে জানান এক সময়ের চাঁদপুর দক্ষিণের ইলিশ মাছ ব্যবসায়ী বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা সহিদ উল্লাহ ভূঁইয়া।
পচা মাছের ডিম ও নোনা ইলিশ স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক কিনা জানতে চাইলে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ সাহাদাৎ হোসেন বলেন, অবশ্যই এসব ইলিশ বা তার ডিম স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। পচা ইলিশ বা তার ডিম খেলে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিয়ে কলেরা বা স্বাস্থ্যগত অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। আমি বিষয়টি জেনেছি যখন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরসহ বিশেষ মোবাইল টিম পরিচালনার উদ্যোগ নেবো।

সর্বাধিক পঠিত