জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা : সামাজিক অপরাধ সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে
চাঁদপুর জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলার নানা সামাজিক অপরাধ বেশ গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় মাদক, আত্মহত্যা এবং কিশোর অপরাধ। মাদকের বিষয়ে সভায় দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনা হয়। পিপি তথ্য জানান, কোর্টে যত মামলা হয় তার মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ হলো মাদক মামলা। প্রতি মাসে তিন শতাধিক মামলা হয় মাদক সংক্রান্ত। পুলিশ সুপার জানান, এর বাইরে ওয়ারেন্ট তামিল করা হয় প্রায় দুইশ। সবমিলিয়ে মাসে পাঁচশ’র মতো মাদক মামলা এবং মাদক মামলার ওয়ারেন্ট তামিল করা হয়। চাঁদপুরে মাদকের এমন ভয়াবহতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। যে কোনো মূল্যে মাদকের লাগাম টেনে ধরতে সভায় জোরালো আলোচনা হয়।
কিশোর অপরাধের বিষয়েও বলা হয়, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। তেমনি কিশোর গ্যাং একটি ভয়ানক আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সভায় এসব বিষয় নিয়ে আলোচকদের আলোচনার প্রেক্ষিতে সভার সভাপ্রধান জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান বলেন, এগুলো হচ্ছে সামাজিক অপরাধ। সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধ বা দমন করতে হলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণির মানুষকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে, এসবের কুফল থেকে যে আমরা কেউ মুক্ত নই সেটা আমাদের মধ্যে জাগ্রত হতে হবে। এই সচেতনতা যদি আসে যে, আমার সন্তান বখে গেলো কিনা, মাদকাসক্ত হলো কিনা, সে ইভটিজিং করে কিনা, এসব বিষয়ে সন্তানের প্রতি নজর রাখা। এ ধরনের সচেতনতা অভিভাবকদের মাঝে জাগ্রত হলেই সম্ভব সামাজিক অপরাধ দমন করা। তাই আমি বলবো- সামাজিক অপরাধ সামাজিকভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ দিয়ে সামাজিক অপরাধ দমন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা রাখতে হবে। যদি তা না করি, তাহলে এসবের কুফল পুরো সমাজ ভোগ করবে। তার থেকে কেহ রক্ষা পাবে না।
পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশ বেশ জোরালো ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেলো যে, অভিভাবকরা এসে উল্টো পুলিশের উপর দোষ চাপাচ্ছে। পুলিশ নাকি অযথা তাদের সন্তানদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। এ জন্য এখন আমরা ওইসব ছেলেদের ছবি তুলে রাখছি। তারা কোথায় আড্ডা দেয়, কী করে, কাদের সাথে, কোন্ সময়ে আড্ডা দিচ্ছে তা অভিভাবকদের দেখানোর জন্য আমরা ছবি তুলে রাখছি। মাদকের বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, সারাদেশে মধ্যে চাঁদপুর মাদক পাচারের অন্যতম রূট। পার্শ্ববর্তী জেলা কুমিল্লা হচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলা। তাই সেখান থেকে অনায়াসে মাদক এসে চাঁদপুর হয়ে বিভিন্ন জেলায় পাচার হয়। আবার এখানে মাদকের বিকিকিনি তথা মাদক ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। যা মাদক সংক্রান্ত মামলার পরিসংখ্যানেই বলে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমি বলবো- এখানে মাদক সেবনকারীর সংখ্যা অনেক বাড়ছে। তাই মাদক বিক্রি হচ্ছে বেশি। চাহিদা বেশি থাকলেই বিক্রি বাড়ে। এ ক্ষেত্রেও আমি বলবো- সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এর বিকল্প নেই। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে আরো বেশি জোরদার ভূমিকা রাখবে।
গতকাল রোববার চাঁদপুর সার্কিট হাউজের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে বিগত সভার কার্যবিবরণী এবং জেলার আইনশৃঙ্খলার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এএসএম মোসা। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে প্রতিমাসে অন্তত একটি করে অভিযান করতে হবে। অভিযানগুলো যেন নিয়মিত হয় সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশনা দেন তিনি।
শহরের পর্যটন কেন্দ্র মোলহেডে কার পার্কিংয়ের টোল আদায় সম্পর্কে জেলা প্রশাসক বলেন, এটি রেলওয়ের জায়গা। তাদের সাথে আমার কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে এটি তারা ইজারা দিয়েছে। আর ইজারার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি নির্ধারিত ইজারার টাকা থেকে তারা বেশি নেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, বীর নিবাসগুলো (প্রধানমন্ত্রী উপহার) যেন মানের হয় সেদিকে আমরা সবসময় সচেতন থাকি। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে যেন এ কাজগুলো খুব সাবধানে এবং সঠিক মানের হয়।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, দুর্গাপূজার জন্যে যেখানে প্রতিমা নির্মিত হচ্ছে, সেখানে সিসিটিভির সাথে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং স্বেচ্ছাসেবক টিম রাখতে হবে। সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে সামাজিকভাবে বিভিন্নভাবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সম্প্রীতি সমাবেশের পাশাপাশি সচেতনামূলক সভাও করা দরকার।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম গত আগস্ট মাসে বাঙালি জাতির শোকের মাসে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে নাই। ১৭ চুরির মধ্যে ১৫ চুরির মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। চাঁদপুরে সাধারণ বাসাবাড়িতে চুরির পাশাপাশি গরু চুরিরও প্রভাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমরা কসাইদের উপর নজরদারি রাখছি।
তিনি আরো বলেন, গতমাসে তেমন কোনো ঘটনা না ঘটলেও এ মাসে ২টি মার্ডারের ঘটনা ঘটছে। একটি মৈশাদীতে আরেকটি হাজীগঞ্জে। মৈশাদীর ঘটনায় ইতিমধ্যে আসামীদের আটক করা হয়েছে। হাজীগঞ্জের মার্ডারটি কেউ কেউ অন্যভাবে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে, আসলে তা নয়। এটি একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা। এটিতে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এ মাসে ভোরে শহরের একটি স্বর্ণের দোকানে চুরি হয়েছে। অচিরেই এ মামলার আসামীদের ধরতে সক্ষম হবো। গড়ে খুন হচ্ছে চাঁদপুরে মাসে ২টি অথচ মাসে গড়ে ৩০টির মতো আত্মহত্যা হচ্ছে। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। এ বিষয়ের উপর আমাদেরকে কাজ করতে হবে এবং সচেতনতামূলক কিছু করতে হবে।
মাদক নিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, মাদককে দমন করতে হলে মাদকসেবীদের চিহ্নিত করে তাদের কাউন্সিলিং করতে হবে। অন্যথায় মাদককে দমন করা কষ্টকর হয়ে যাবে। কারণ মাদকসেবীরা তাদের চাহিদা পূরণ করতে মাদক ক্রয় করে আনবেই।
কিশোর গ্যাং নিয়ে বলেন, আমরা কিশোর গ্যাংয়ের অবস্থানের ছবি তুলে আনছি। কারণ, কিশোর গ্যাংয়ের ধরে আনলে যেন তাদের অভিভাবকদের দেখানোর জন্যে। অনেক সময় অভিভাবকরা পুলিশদেরই অপবাদ দেয়। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আগামী মাসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বড় উৎসব দুর্গাপূজা। গতবছর চাঁদপুর জেলায় অপ্রীতিকর একটি ঘটনা ঘটেছিলো। গোয়েন্দা তথ্য মতে এ বছরও আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুর্গাপূজার একটি চক্র ষড়যন্ত্র করতে পারে। এ ব্যাপারে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
সভায় আরো বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ সাহাদাৎ হোসেন, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান, এনএসআই এর উপ-পরিচালক শাহ আরমান আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচিত কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ ওয়াদুদ, প্রেসক্লাব সভাপতি এএইচএম আহসান উল্লাহ, পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাড. রনজিত রায় চৌধুরী, হাইমচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নূর হোসেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক একেএম দিদারুল আলম।
আলোচনা সভার শুরুতে আলোচ্য বিষয় নিয়ে ডকুমেন্টারি উপস্থাপন করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট (এডিএম) এ এস এম মোসা। সভায় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।