• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

প্রকাশ:  ২৫ জুন ২০২৩, ০৯:০৩
কাওসার চৌধুরী
প্রিন্ট

‘দেশে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে’ কথাটি শুনলে মনের মণিকোঠায় অজান্তে ভেসে উঠে একজন লুঙ্গি কাঁচামারা, ছেঁড়া গেঞ্জি পরা, হাতে চকচকে কাঁচি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষকের প্রতিচ্ছবি। এটা চরম তৃপ্তিদায়ক, সুখের। এই নিষ্পাপ হাসিটাই বলে দেয় আগামী কয়েক মাস কৃষক পরিবারের পেট ভরে দুবেলা খাওয়ার গ্যারান্টি আর শাকভাত-ডালভাত খাওয়ার আনন্দের হাতছানি, বাবা-মাকে ডাক্তার দেখানোর আশা, বউকে একটি রঙিন শাড়ি কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিজয়ী হাসি, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে বইখাতা কিনে দিতে পারার আনন্দ, আত্মীয় পরিজনকে দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে আসার বাসনা।
কৃষিপ্রধান এই দেশের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষক পরিবারের সাথে সম্পর্কিত। কৃষকরা স্যাটেলাইট দিয়ে ঘূর্ণিঝড় তাড়ানো হয় নাকি বোমা ফেলা হয় তার খবর রাখে না। বাংলাদেশে বিমানের নাম পালকি নাকি উল্কি তা জানে না। রোবট সুফিয়া কী বললো তার খবর রাখে না। তাদের একমাত্র চাওয়া গতর খাটিয়ে ঝড়-তুফানে, বন্যা-খরায় না খেয়ে ধানক্ষেত পাহারা দেওয়া, কাক্সিক্ষত দিন গোণা। এ যে বড় আনন্দের।
গত ক'দিন আগে একটি পত্রিকায় পড়লাম, এক কেজি ইলিশ কিনতে হলে দুই মণ ধান বিক্রি করতে হয়! কৃষকরা তো কবে থেকেই অভিজাত ইলিশের গা-ঘেঁষা বন্ধ করে দিয়েছেন। অথচ ফ্রিতে সমুদ্র/নদী থেকে পাওয়া ইলিশের এতো দাম! কৃষকরা দিনকে রাত করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সুদ করে, ঋণ করে, গাঁটের পয়সা খরচ করে আমাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছেন, তবুও নেই ন্যায্য দাম।
কৃষকরা এখন ধানের পরিবর্তে বিকল্প ফসল চাষ করছেন। এটা ভাল কথা। কিন্তু এই বিকল্প শস্য উৎপাদন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে হুমকি হয়ে দেখা দেবে আগামী দিনগুলোতে। একটা সময় আসবে, দেশ বিদেশি চালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে; এটা শতভাগ ভাত খাওয়া জাতির জন্যে মোটেও ভাল সংবাদ নয়। আমাদের গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলো এখন আর ধান চাষ করে না; কারণ, ধান চাষ এখন আর লাভজনক শস্য নয়। শত শত একর জমি প্রতি বছর পড়ে থাকে কোনো চাষাবাদ ছাড়া।
প্রতি বছর বাজেট আসলেই সিগারেটের দাম বাড়ে। অথচ চালের দাম সে অনুপাতে বাড়ে না। উত্তরবঙ্গের অনেক কৃষক এখন ধানের পরিবর্তে তামাক চাষে উদ্যোগী হচ্ছেন। এতে লাভের অংশটা বেশ ভারী। টোবাকো কোম্পানিগুলো নাকি অগ্রিম টাকা দেয়, কীটনাশক দেয়, সার দেয়। এছাড়া কৃষকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সহযোগিতা করে। একটা সময় যদি সারা দেশের কৃষকরা ধানের পরিবর্তে তামাক উৎপাদনে মনোযোগী হয়, তবে আমি মোটেও অবাক হবো না। সারাদেশ তামাকে সয়লাব হবে। আমরা ভাতের পরিবর্তে সিগারেট খাবো। ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকোর মতো বেনিয়ারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাবে এদেশ থেকে। আর আমরা একটা গাঞ্জাখোর, বিড়িখোর জাতি হয়ে বিদেশি রিলিফ খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকবো।
সরকার কৃষকদের সার ও কীটনাশকে ভর্তুকি দিচ্ছেন। এটা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকের বিষয়ে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি। না হলে আগামী কয়েক বছরে কৃষকরা ধান উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন নিশ্চিত। এজন্যে ধান উৎপাদনকারী কৃষক এবং তাদের কৃষি জমিগুলো চিহ্নিত করে প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে। এই টাকার অঙ্কটা একর প্রতি তিন হাজার-পাঁচ হাজার হতে পারে। প্রতি বছর বাজেটের একটি অংশ দিয়ে সরকারকে নিজ উদ্যোগে 'কৃষিবীমা' করতে হবে, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি দুর্যোগে যাতে কৃষকরা বাঁচতে পারে। আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম অল্প দামে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
সরকার এ বিষয়ে সচেতন হলে কৃষক বাঁচবে, আর কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।