• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

এক যুগেরও বেশি দলে তাঁর কোনো পদ নেই, তারপরও কেনো এতো ভক্ত!

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে যে পরিবারটির রক্ত ঝরেছে

প্রকাশ:  ১০ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:২৬
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

জাহিদুল ইসলাম রোমান নামটি চাঁদপুরের আওয়ামী রাজনীতিতে বেশ পরিচিত। শুধু আওয়ামী রাজনীতিই নয়, এ জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনেও রোমান নামটির বেশ পরিচিতি রয়েছে। দলমত নির্বিশেষে তাঁর ভক্ত অনুরক্তও রয়েছে অনেক। এক যুগের মতো হয় তাঁর আওয়ামী লীগের কোনো সাংগঠনিক স্তরে কোনো পদ-পদবি নেই। চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তাঁর সর্বশেষ পদ। তাও সেটি ২০১০ সাল। এরপর এক যুগ হয়ে গেছে তাঁর কোনো পদ-পদবি নেই। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল। এই সাত বছরের মধ্যে শেষের দুই বছর বাদ দিলে প্রথম পাঁচ বছর পুরোটাই প্রতিকূল। শুধু প্রতিকূলই নয়, আওয়ামী রাজনীতির জন্য চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে পাঁচটি বছর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন রোমান। ২০১০ সালের পর থেকে দলের কোনো পর্যায়ে আর কোনো পদ-পদবি নেই তাঁর। তারপরও তাঁর ভক্ত, অনুরক্ত, শুভাকাক্সক্ষী, অনুসারীর কমতি নেই। তাঁর জন্য সাবেক এবং বর্তমান ছাত্র নেতারা কেনো এতো সহানুভূতিশীল? এর পেছনে কী এমন শক্তি, কী এমন রহস্য বা কারণ রয়েছে? রোমান তেমন কোনো অর্থ-বিত্তের মালিক নন বা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানও নন। টাকাণ্ডপয়সা দিয়ে নেতা-কর্মী ধরে রাখেন তেমনটাও নয়। তাহলে এই দীর্ঘ সময় ধরে কেনো অসংখ্য নেতা-কর্মী তাঁর অনুসারী? এ পেছনে কী এমন নিয়ামক শক্তি?

এসব কেনোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কথা হলো বেশ কিছু সাবেক ও বর্তমান ছাত্র নেতার সাথে। তাদের বক্তব্য হলো- রোমান ভাই এমন একজন নেতা, যাঁর মাঝে কোনো লোভ-লালসা নেই। ব্যক্তিগত চাহিদা বা ভোগ-বিলাস তাঁর স্বভাবে নেই। তিনি শুধু নেতাই নন, যে কোনো পরিস্থিতিতে সম্মুখভাগের যোদ্ধা তিনি। যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কর্মীদের সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছন থেকে সরে যাওয়ার মতো নেতা নন তিনি। কর্মীদের সুখে-দুঃখে রাত-বিরাতে সবসময় তাঁকে পাশে পাওয়া যায়। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামাতের দুঃশাসনকালে জাহিদুল ইসলাম রোমান যেভাবে চাঁদপুর জেলায় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা স্মরণ হলে এখনো আমরা শিহরিত হই। এরপর ২০০৭ থেকে ২০০৮ সাল টানা দুই বছর ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময় জাহিদুল ইসলাম রোমানের নেতৃত্বে জীবনবাজি রেখে এই জেলায় আন্দোলন সংগ্রাম করেছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময়গুলোতে অনেক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে রোমানকে। কিন্তু যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নেতা-কর্মীদের ছেড়ে তিনি যান নি। কোনো কর্মী বিপদে পড়ার আগে তিনি আগে ছুটে গিয়েছেন। তাঁর এসব গুণাগুণের কারণে ছাত্র-যুবক ছাড়াও বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি আওয়ামী লীগাররাও রোমানের অসম্ভব ভক্ত।

নেতা-কর্মীরা বলেন, জাহিদুল ইসলাম রোমানের আওয়ামী রাজনীতিতে এতো দৃঢ়তার কারণ হলো- রোমান রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জন্যে লড়াই সংগ্রাম করতে গিয়ে যেই পরিবারটির রক্ত ঝরেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে গিয়ে রোমানের পিতা অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলামের শরীর থেকে রক্ত ঝরেছে জিয়ার শাসনামলে। আওয়ামী লীগ অফিস তখন চাঁদপুর শহরের জোড়পুকুর পাড় এলাকায় ছিল। বিএনপির একটি মিছিল থেকে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা করা হয়। সেই হামলা ঠেকাতে তখন অফিসে থাকা অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম এগিয়ে গেলে হামলাকারীরা ইট মেরে অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলামের মাথা ফাটিয়ে দেয়। তাঁর কপালে সেই দাগ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বহন করেছেন।

রোমানের পিতৃ পরিচয় শুধু এই জেলাতেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও রয়েছে। খোদ জাতির জনকের পরিবার যে নামটি জানে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যিনি রাজনীতি করেছেন, বাঙালির মহান মুক্তি সংগ্রামে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি হচ্ছেন মরহুম অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম। যিনি ১৯৬৪ সালে ফরিদগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৫ সাল থেকে টানা ২৩ বছর প্রথমে মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর ১৯৯৮ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের ১১ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তিনি পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চাঁদপুর জেলা সংগ্রাম কমিটিকে মিনিস্ট্রিয়াল কেবিনেটে রূপ দেয়া হয়। অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন সেই কেবিনেটের প্রধানমন্ত্রী।

অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম দুবার সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদে সংসদীয় আসন-২৬৫ (কুমিল্লা-২৫) হতে প্রথম এবং ১৯৭৫ সালের ২০ জুলাই উপনির্বাচনে একই আসন থেকে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির ছয়বারের সাধারণ সম্পাদক এবং দুই বার সভাপতি নির্বাচিত হন। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও অ্যাডঃ সিরাজুল ইসলাম একজন নির্লোভ, নিরহংকার এবং পরোপকারী রাজনীতিবিদ হিসেবে চাঁদপুর জেলার আপামর জনতার কাছে ছিলেন সমাদৃত।

পিতার আদর্শেই যেনো জাহিদুল ইসলাম রোমানের রাজনৈতিক পথচলা। পিতার মতই নির্লোভ, নিরহংকার এবং পরোপকারী। সে জন্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী তার ভক্ত এবং শুভাকাক্সক্ষী। স্কুল জীবন থেকেই রোমান ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।

রাজনৈতিক পরিক্রমা

১৯৮৭-৮৮ সালে স্কুলে পড়াশোনা অবস্থায়ই জাতির পিতার আদর্শে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে রোমান সম্পৃক্ত হন। ১৯৮৯ সালে এসএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম হাজী মহসিন কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। সেখানে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে গিয়ে শিবিরের রোষানলে পড়ে তাদের তাণ্ডবে ৬ মাসের মাথায় তাকে মহসিন কলেজ ছেড়ে আসতে হয়।

১৯৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং চাঁদপুরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন।

পদ পদবী :

১৯৯৭ সালে চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগ আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে বিএনপি-জামাতের দুঃশাসনের সময় চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন ও কাউন্সিলের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১০ সাল পর্যন্ত জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ।

২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে প্রতিপক্ষের ৩,১০০ ভোটের বিপরীতে প্রায় ১,৪৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

আন্দোলন-সংগ্রামের উল্লেখযোগ্য ঘটনা :

২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য আহসান উলাহ মাস্টারকে বিএনপি সন্ত্রাসীরা হত্যা করে। এর প্রতিবাদে ৯ মে রোববার দেশব্যাপী সকাল সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন রোমান। যা পরদিন ১০ মে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন আকারে প্রকাশিত হয় ।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে মঈনুদ্দিন ফখরুদ্দিনের সেনাশাসিত সরকারের সময় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ এবং তাঁর মুক্তির দাবিতে চাঁদপুর শহরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চোরাগোপ্তাভাবে মিছিল-মিটিং করেন রোমানের নেতৃত্বে। এজন্যে সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থাকতে হয় রোমানকে।

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ভূমিকা :

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৩ (সদর ও হাইমচর) আসনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ডাঃ দীপু মনির বিজয়ে ছাত্রলীগসহ সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন রোমান। প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে রোমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা রাখে। যার ফলে স্বাধীনতার ৩৫ বছর পর এ আসনটি আওয়ামী লীগ ফিরে পায়। একই সাথে চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে ব্যাপক গণসংযোগ করে প্রার্থীকে বিজয়ের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যায় রোমান। কিন্তু দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোনাফেকদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র এবং প্রার্থীরও কৌশলগত কিছু ভুলের কারণে এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরে যায়।

শুধু জাতীয় নির্বাচনেই নয়, চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাহিদুল ইসলাম রোমানের সক্রিয় ভূমিকা ছিলো উল্লেখ করার মতো। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ফরিদগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপক্ষে বিএনপি-জামায়াত জোট সমর্থিত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে তৎকালীন স্থানীয় এমপিসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের একটি অংশের জোরালো ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও নৌকার বিজয় ঠেকাতে পারেনি। সেদিন রোমান ফরিদগঞ্জে বৃহত্তর আওয়ামী পরিবারের সাধারণ কর্মী, সমর্থক ও তৃণমূলের নেতাদের সাথে নিয়ে জীবনবাজী রেখে মাঠে অবস্থান করে মেয়র পদে নৌকা প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করে।

এই ১৪ বছর সরকারের সকল উন্নয়ন কাজে রেমাান নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছে। পাশাপাশি চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে সুসংগঠিত রাখতে অদ্যাবধি প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।

ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাবেক এবং বর্তমান নেতাদের প্রশ্ন দলের নীতি-নির্ধারকদের কাছে- এমন একজন আদর্শবাদ, ত্যাগী ও কর্মীবান্ধব নেতা আর কতদিন দলের বাইরে তথা পদ-পদবী ছাড়া থাকবে?

সর্বাধিক পঠিত