কবরে শায়িত ইব্রাহিম, মা-বাবা শায়িত বিছানায়
সদ্য সমাপ্ত হওয়া এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ইব্রাহিম খলিল (১৬)। সহপাঠীদের এক কথা-সে এ প্লাস পাবেই পাবে। গ্রামবাসীর কথা গোবরে পদ্মফুল। সেই ইব্রাহিমকে কবরে শায়িত করা হয়েছে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে। তার আগ থেকে অর্থাৎ শুক্রবার দুপুর থেকে ইব্রাহিমের দিনমজুর বাবা সেলিম মিয়া ও মা বিছানায় শায়িত। কোনোভাবেই বাবা-মাকে সান্ত¡না দিতে পারছেন না গ্রামবাসী কিংবা নিকটাত্মীয়রা। গত শুক্রবার সকালে ইব্রাহিম গাজীপুরে একটি নির্মাণাধীন ভবনের লিফটের ৬ তলা থেকে বেজমেন্টে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ইব্রাহিম বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ও পরিবারের বড় সন্তান ছিলো। ছেলে মেধাবী, নামাজী আর হ্যান্ডসাম হওয়ায় বাবা দিনমজুর হলেও ইব্রাহিমকে অভাব তেমন একটা বুঝতে দেয়নি। ইব্রাহিম হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা ইউনিয়নের সন্না অক্কার বাড়ির সেলিমের ছেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেলিম দম্পতির তিন সন্তান। সবার বড় ছেলে ইব্রাহিম। তারপর ছোট দুই মেয়ে। কিছুটা শ্রবণপ্রতিবন্ধী সেলিম শিশু বেলায় বাবাকে হারান। মা বিভিন্নজনের সহায়তা নিয়ে সেলিমকে বড় করার চেষ্টা করেন। কিশোর বয়সে সেলিম মাকে হারান। মা হারানোর পর বেশ কিছু বছর পার করেন একা একা। এরপরে আত্মীয়স্বজনের ইচ্ছায় আপন ফুফাতো বোনকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন।
একেবারে গতর খেটে খাওয়া সেলিম বিয়ের পর কষ্টার্জিত টাকায় নতুন ঘর করেন। এরপর ইব্রাহিমের জন্ম। বাবা-মাহারা দিনমজুর বাবার ঘরে জন্ম নেয়া ইব্রাহিম বেশ আদরেই বড় হতে থাকে। এক সময় সঠিক বয়সে ইব্রাহিমকে স্কুলে ভর্তি করান বাবা-মা।
প্রথম শ্রেণিতে থাকতে বিদ্যালয় থেকে খবর আসে ইব্রাহিম অনেকটাই মেধাবী। এতে করে বাবা-মা উৎসাহ পান আর সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে পড়াবেন। প্রাথমিকের গ-ি পার হয়ে ইব্রাহিমকে ভর্তি হয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখানেও সে পড়ালেখায় বেশ ভালো করতে শুরু করে। খানিকটা বুঝ হবার পর থেকে পড়ালেখার পাশাপাশি ইব্রাহিম বাবার কাজে সহযোগিতা করতে শুরু করে। মাধ্যমিকে পড়ার মাঝামাঝি সময় থেকে আশপাশের বাড়িতে ছোট বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করে তথা নিয়মিত টিউশনি শুরু করে। নিজের পড়ালেখা ষোলআনা ঠিক রেখে টিউশনির পাশাপাশি বাবাকে কাজে সহায়তা করতে থাকে ইব্রাহিম। নবম শ্রেণী থেকে নিজে প্রাইভেট পড়া শুরু করে। ইতোমধ্যে বাকিলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছর অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে। তার সহপাঠীদের একই কথা-সে এ প্লাস পাবেই।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার দুদিন পর কাজ শেখার জন্যে মামা আর খালুদের সাথে কাজে দেয়া হয় ইব্রাহিমকে। গত মাসের মাঝামাঝি সময় ইব্রাহিম বাড়ি থেকে কাজ শেখার জন্যে গাজীপুরে যায়। গত শুক্রবার সেখান থেকে লাশ হয়ে বাড়ি ফিরে ইব্রাহিম।
লাশের সাথে আসা ইব্রাহিমের মামাতো ভাই ও খালু জানান, গাজীপুরের একটি ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরির ওখানে কাজে যায় সে। গত শুক্রবার সকালে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের লিফটের ৬ তলায় কাজ করাকালে কোনো না কোনোভাবে লিফট রুম দিয়ে নিচে বেজম্যান্ট পড়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে সহকর্মীরা তাকে মারাত্মক জখমসহ লিফটের ব্যাজমেন্টে মৃত অবস্থায় খুঁজে পায়। এ ঘটনা শুক্রবার সকালের। এ খবর লেখা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি কোনো পক্ষ থেকে।
এদিকে শুক্রবার দুপুরে যখন ইব্রাহিমের মৃত্যুর ঘটনা ফোনের মাধ্যমে বাড়িতে আসে, তখন ইব্রাহিমের ব্যবহার্য শীতের গরম কাপড় লোকমাধ্যমে পাঠানোর জন্যে তার মা আছিয়া বেগম তার বাবার বাড়িতে যান। ছেলের গরম কাপড় বাবার বাড়িতে দিয়ে ফেরত আসার পথেই বাড়ি থেকে খবর যায় ইব্রাহিম আর নেই। শুক্রবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে ইব্রাহিমের লাশ বাড়িতে পৌঁছে। তার আগেই প্রতিবেশীরা বাঁশ কেটে, কবর খুঁড়ে প্রস্তুত রাখে। অ্যাম্বুলেন্সে করে ইব্রাহিমের লাশ বাড়ির সামনে আসা মাত্র শত শত মানুষ জড়ো হতে থাকে লাশ দেখতে। আর বাড়ির ভেতরে ‘ওরে বাবা ওরে বাবা’ বলে বাবা-মায়ের গগণবিদারী কান্নার শব্দ আশপাশের পরিবেশকে একেবারেই ভারাক্রান্ত করে তোলে।
একই দিন রাত ১১টায় স্থানীয় সন্না সপ্রাবির মাঠে জানাজায় কয়েক হাজার মুসল্লি অংশ নেন। মাত্র ১৬ বছরের একটি ছেলের জানাজায় এতো লোকের উপস্থিতি সবাইকে হতবাক করে তোলে। এদিকে লাশের সাথে আসা ইব্রাহিমের মামা ও খালু জানাজায় অংশগ্রহণকারী মুসল্লিদের সামনে প্রকাশ্যে বলেন, এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি, তবে যারা ভবন নির্মাণ করছেন তাদের সাথে কথা হয়েছে, যা নিয়ে ৫ নভেম্বর বসা হবে।