বাজারে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম ॥ ক্রেতাদের মাঝে হতাশা
অস্থির হয়ে উঠছে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম। বাজারে প্রভাব পড়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। সকলের চিন্তা ভোজ্যতেল ও গম রপ্তানির বৃহৎ উৎপাদক দুই দেশে চলমান যুদ্ধ-আতঙ্ক। যদি যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদী হয় তাহলে হয়তো তেল বা গমশূন্য হয়ে যাবে দেশ। তাই যে যেভাবে পারছে সামর্থ্যানুযায়ী সংগ্রহ করতে যাওয়ায় অধিক প্রভাব পড়ছে ভোজ্যতেলের ওপর। এক সময় বাজারমূল্যের দ্বিগুণেরও অধিক দামে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। যা ক্রেতাসাধারণকে ভাবিয়ে তুলছে।
ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার অজুহাত হচ্ছে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী বৃহৎ কোম্পানি মেঘনা গ্রুপ ও টিকে গ্রুপের উৎপাদন বন্ধ থাকা। তাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ায় চাহিদানুযায়ী তেলের আমদানি না থাকায় দিন দিন বেড়েই চলছে তেলের দাম-এমনটাই অভিযোগ পাইকারী ব্যবসায়ীদের। আর খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, যেমনটা কিনে এনেছি, তেমনটাই বিক্রি করছি৷ আমাদের কিছুই করার নেই। ভোজ্যতেলের অপর কোম্পানি সিটি গ্রুপের কারখানা খোলা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী তাদের ডেলিভারি অনেক কম হওয়ায় ভোজ্যতেলের সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে বলে কোনো কোনো ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন। তবে যে কারণেই বাজার অনিয়ন্ত্রিত হোক না কেনো, নিত্যপণ্যের বাজার বৃদ্ধিতে ক্রেতাসাধারণ রয়েছেন আতঙ্কে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, এভাবে বাজার বৃদ্ধি পেলে বাসা ভাড়া দিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে সংসার চালাতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হবে। আমরা এমন পর্যায়ে রয়েছি, যা কাউকেই বলতে পারছি না। তার প্রশ্ন, আদৌ কি কমবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম? নাকি এমন করেই বেড়ে চলবে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম। তবে এর উত্তর বাণিজ্যমন্ত্রীই ভালো দিতে পারবেন বলে কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেন।
গতকাল চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারের পাইকারি কয়েকটি দোকান ঘুরে জানা গেলো নিত্যপণ্যের দাম। যাতে দেখা যায়, ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, ডাল, চিনি ছাড়া অন্যান্য পণ্যের দাম ১০/১৫ দিনের পর্যায়ে একই রয়েছে। গতকাল পাইকারী বাজারে সয়াবিনের কেজি বিক্রি হয়েছে ১৬৪ টাকা আর শহরের পালবাজারে তা বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা, সরিষার তেল পাইকারি বিক্রি হয়েছে ১৭০/১৭৫ টাকা আর খুচরা বাজারে তা বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২০৫ টাকা। পাইকারিভাবে ৭৪ টাকা চিনি বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে তা ৮০ থেকে ৮২ টাকা। এছাড়া পাইকারি বাজারে আটা ৩০ টাকা, ময়দা ৪২ টাকা, মসুরি ডাল মোটা ৯০ টাকা, ছোট দানার মসুরি ১১০ টাকা, খেসারি ৬৫ টাকা, অ্যাংকর ৪৫ টাকা, ছোলা ৬০ টাকা, মুগ ডাল বড় দানা ৭০ টাকা, ছোট দানা ৯০/৯৫ টাকা, পেঁয়াজ এলসি ৪০ টাকা, দেশি ৩০ টাকা, রসুন এলসি ৮৫ টাকা আর দেশি ২৫ টাকা, আদা এলসি চায়না ৫৫ টাকা আর ইন্ডিয়ান কেরালার আদা বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। আলুর পাইকারি বাজার সাড়ে ৯ টাকা থেকে ১০ টাকা হলেও খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকা। তবে শহরের পালবাজারে সরিষার তেল ২০০ টাকা, সয়াবিন (লুজ) কেজি ১৮৫ টাকা, আটা (লুজ) কেজি ৩৩ টাকা আর দুই কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা। লুজ ময়দার কেজি ৫০ টাকা আর প্যাকেট ৫৫ টাকা। মসুরি ডাল চিকন ৯৫ টাকা আর চিকন ১২০ টাকা, খেসারি ৭০ টাকা, মুগ চিকন ১২০ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৫৫ টাকা, ছোলা ৭০ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন ৫ লিটার ৮২০ টাকা, ২ লিটার ৩৫০ টাকা বিক্রি হতে দেখা যায়৷ তবে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চালের বাজার। নেই কোনো রমরমা কেনা-বেচা। চিকন চালের দাম ব্যতীত গত ক’দিন যাবৎ একই পর্যায়ে রয়েছে অন্যান্য চালের দাম।
পুরাণবাজারস্থ পাইকারি চালের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, জিরা চাল ৫৯ টাকা, নাজিরশাইল ৬৮/৭০ টাকা, পাইজাম ৪২/৪৩ টাকা, আটাইশ চিকন ৫৫/৫৭ টাকা, স্বর্ণা গুটি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৯ থেকে ৪০ টাকা। মিনিকেট চিকন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। অথচ এলসি থাকাকালীন এ মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা। কোনো কোনো ব্যবসায়ীর অভিমত, এলসি বন্ধ থাকার কারণেই চিকন চালের বাজার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে চালের কেনা-বেচা অনেকটাই কম বলে তারা অভিমত প্রকাশ করেন। তবে পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরা বাজারে এর দাম নিয়ন্ত্রিত না থাকায় ক্রেতাসাধারণের মাঝে এর প্রভাব পড়ে বেশি। অনেকে মনে করেন, পাইকারি দামের চেয়ে আনুপাতিক হারে খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে কি না তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।
এদিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে টিসিবির পণ্য সংগ্রহে ক্রেতাদের লাইন। টিসিবির পণ্যের মূল্য আশানুরূপভাবে কিছুটা কম হওয়ায় তা পেতে ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে অনেকেই এখন লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। আর দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য না পেয়ে ক্রেতাসাধারণ হচ্ছেন হতাশ। পূর্বে টিসিবির ডিলারদের যে পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করা হতো, বর্তমানে সে পরিমাণ পণ্য সরবরাহ না করার কারণে সাধারণ গ্রাহক পণ্য সংগ্রহ করতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন। চাঁদপুরের প্রতিটি উপজেলাতেই টিসিবির ডিলার রয়েছে। তবে পূর্বে যে পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করা হতো বর্তমানে সেই পরিমাণ পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে টিসিবির ক’জন ডিলার জানান।
বর্তমানে টিসিবির চিনি ৫৫ টাকা, মসুরি ডাল ৬৫ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন লিটার ১১০ টাকা আর পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা কেজি দরে। তবে বাজারের সয়াবিন তেল নিয়েই অধিক পরিমাণে দেখা যাচ্ছে অস্থিরতা। গত মাসের ৬ ফেব্রুয়ারি বোতলজাত সয়াবিন লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা করা হয়েছিলো। মাস শেষ হতে না হতেই তা লিটারপ্রতি ১২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেই তারা দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন।