• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

চাঁদপুর হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার বানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মাতৃভাষা দিবস পালন করি :এস. এম. সালাহ্ উদ্দীন

প্রকাশ:  ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:০২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট


২১ মানে মাথা নত না করা। অমর একুশে ফেব্রুয়ারির আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। এমতাবস্থায় আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে তাৎক্ষণিক একটি সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা আমাদের স্কুলের সামনের নারিকেল গাছতলায় শহীদ মিনার বানিয়ে মহান মাতৃভাষা দিবসের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো। এই কথাটি খুব দ্রুতই স্কুলের ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লো এবং আমাকে বলা হলো একটি মিটিং ডাকতে। আমরা আমাদের স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে ছাত্রদের উপস্থিত থাকতে ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে অনুরোধ করি। পরের দিন ক্লাস শেষে মিটিংয়ের সময় দেখি অ্যাসেম্বলি ছাত্র-বন্ধুগণ কানায় কানায় পূর্ণ করে ফেলে। সে কী আনন্দ। যেন উৎসবমুখর অবস্থা। যা ভাবতে আজও আমি অনুপ্রাণিত হই। শুরু হলো ২১ মানে মাথা নত না করা এবং শহীদ মিনার বানিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্ত চাঁদপুর মহান ভাষা দিবস পালন করার পক্ষে আবেগময় বক্তৃতা। উপস্থিত সকলের সমর্থনে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা সকলেই স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে পবিত্র শহীদ মিনার বানাবোই। আরো সিদ্ধান্ত নেই যে, আমাদের স্কুলের সকলেই স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে পবিত্র শহীদ মিনার বানাবোই। আরো সিদ্ধান্ত নেই যে, আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক জয়নাল আবেদীন স্যারের সাথে দেখা করে শহীদ মিনার বানানোর ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্তের কথা জানাবো। রাতেই আমরা স্কুলের অফিসে স্যারের সঙ্গে দেখা করি এবং আমাদের শহীদ মিনার বানানোর কথা জানাই। সাথে সাথেই প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য স্যার রাজি হয়ে গেলেন এবং স্কুলের তহবিল থেকে ৩,০০০/- টাকা শহীদ মিনার বানানোর জন্যে অনুদান ঘোষণা করেন। আমরা যেন আকাশের চাঁদ পাই। এতোটাই উৎসাহিত হই, রাতেই আমরা ছক তৈরি করি যে, কে কীভাবে শহীদ মিনারের মালামাল সংগ্রহ করবো। কেউ দায়িত্ব নেই ইট, বালু সিমেন্টের, কেউ দায়িত্ব নেই কাঠ, বাঁশ, রড সংগ্রহের, কেউ দায়িত্ব নেই রাজ মিস্ত্রী সংগ্রহের। তারপর যার যার কাজে চলে যাই। পরের দিনে দুপুরে প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য স্যার শহীদ মিনারের স্থান নির্ধারণের জন্য নারিকেল গাছতলায় আসেন এবং শহীদ মিনার নির্মাণের ভিত্তি স্থাপন করেন।
শুরু হয়ে গেল নির্মাণ কাজ। পানি আনাসহ যুগালীর কাজ ছাত্রবন্ধুরাই করেছেন। আমাদের শ্রম, ঘাম ও নিজেদের নাস্তার টাকা এবং স্বেচ্ছায়শ্রম দিয়েই ৩তিনের মধ্যে পবিত্র শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শেষ করি।
এ শহীদ মিনার নির্মাণের কাজের অগ্রণী ভূমিকা বা নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা হলেন : আমি এসএম সালাহ্ উদ্দীন, আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারী, সেলিম, রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া, শফিকুর রহমান, এমদাদুল হক ভূঁইয়া, আবু বকর, মুসলিম, তপন সাঈদ, রুস্তম গাজী, দেলওয়ার, মাকছুদ, টুনু তালুকদার, আমির হোসেন পাটওয়ারী, রাগিবউদ্দিন, খোরশেদ, শাহাবুদ্দিন-হাবিব, মাহফুজ, সালেহ আহমদ, মফিজুল ইসলাম, উৎপল, শাহাদাত, সবুজ, সগির আহম্মেদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, আলী আকবর, ইমাম হোসাইন, মুরাদ খান, মহসিন, গগন, মঞ্জুর, জামাল, চন্দনসহ আরো অনেকে। আমি তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। নির্মাণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে যার কাছে গিয়ে বসতাম, চা খেতাম সে আমাদের সকলের প্রিয় ছানাউল্লাহ ভাই। মাথা ভর্তি পাকনা চুল, কী মনখোলা হাসি। সেই আমাদের প্রিয় ছানাউল্যাহ লাইব্রেরীর ছানাউল্যাহ ভাইয়ের কথা আজ খুব মনে পড়ছে।
২০ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৭২। বিকেল থেকে শুরু করি আমাদের স্কুল ভবনটি সাজানো এবং ছাত্রদের কার্নিসে প্রদীপ স্থাপন করার এক স্বতঃস্ফূর্ত র্কমযজ্ঞ। সকল ক্লাসের ছাত্রদের অংশগ্রহণে এক উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা স্কুল ক্যাম্পাসটি সাজিয়ে তুলি। ২১ শে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা আমরা খালি পায়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র বন্ধুরা লাইন করে দাঁড়িয়ে আমরা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি। শহীদ মিনারের বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথম প্রহরের কর্মসূচি পালন করি।
বিকেলে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শুরু হলো মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিচারণ ও ফটোসেশন। স্মৃতি চারণের পরপরই শুরু হয় আলোক সজ্জার জন্যে প্রদীপ জ¦ালানোর পর্ব। প্রদীপ জালানোর সাথে সাথে স্কুল ভবনটি যেন এক নতুন রূপ নেয়। শুরু হয়ে যায় এক আনন্দঘন পরিবেশের। তখন স্কুলের চতুর্দিক ছিলো অনেকটা ফাঁকা। তাই স্কুলের আলোক সজ্জা অনেক দূর থেকে দেখা যেত। সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রী ও পথচারীসহ মানুষ দলে দলে এই আলোক সজ্জা দেখতে আসতে শুরু করেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত এ স্কুল প্রাঙ্গণটি জমজমাট থাকে।
সকলেই আমাদের শহীদ মিনারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে দৃশ্য ভোলার নয়। তখন চাঁদপুরে কোনো শহীদ মিনার ছিলো না। হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনার গৌরবদীপ্ত মহিমায় চির অম্লান হয়ে আছে এবং থাকবে। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন সেই স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
আজকের এই দিনে আমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান, সকল ভাষা শহীদ, মহান মুক্তিযুদ্ধ ৩০ লাখ শহীদসহ সকল শহীদের রুহের মাগফিরাত কামানা করি এবং সকল ভাষাবীরদের, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে সেই দিনের শহীদ মিনার নির্মাণের সাথী যোদ্ধাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমার এ লেখাটি আগামী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করছি। চিরজীবী হোক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক কর্মী
ডকুমেন্ট : শহীদ মিনার ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
ফোন : ৬৫২৬৪,০১৮১৯-৮৪০০৮৫

সর্বাধিক পঠিত