চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও কি মেডিকেল কলেজের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে?
পদ্মা সেতু নিয়ে কথিত দুর্নীতির অভিযোগের ন্যায় বুমেরাং হয়ে যাবে নাতো?
বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদে চাঁদপুর জেলায় যে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- হয়েছে এবং আরো যেসব উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন হওয়ার অপেক্ষায়, সেগুলোর মধ্যে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। বিশেষায়িত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু হওয়ার একেবারেই দ্বারপ্রান্তে এসেও যেনো হোঁচট খেলো। অনেকটা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু হওয়ার ক্ষেত্রে। সম্প্রতি এটির জন্যে নির্ধারিত স্থানের জমির দর-দাম নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে (দেশের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত) সংবাদ প্রচার, ব্যক্তিবিশেষের সাক্ষাৎকার এবং দেশীয় কিছু মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার হওয়ায় এখন বিশ্ববিদ্যালয়টি হওয়া না হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ অনিশ্চয়তার বিষয়টি উপলব্ধি করে চাঁদপুরবাসীর মন্তব্য হচ্ছে, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও কি তাহলে মেডিকেল কলেজের ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে? চাঁদপুর মেডিকেল কলেজটি যেভাবে নানামুখী ষড়যন্ত্রের কারণে এটির সাইট সিলেকশান হওয়ার পরও এর অগ্রগতি থমকে গেছে, সেই ষড়যন্ত্রের মধ্যেই কি তাহলে পড়ে গেলো চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়? এই প্রশ্ন এখন চাঁদপুরবাসীর কাছে অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে তারা আশঙ্কা করছেন পদ্মা সেতু নিয়ে যে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছিল, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় নিয়ে ষড়যন্ত্র তারই একটি অংশ বলে আমরা আশঙ্কা করছি।
চাঁদপুরে একটি মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রতিশ্রুতি ছিলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাঁর এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন বর্তমান সরকারের মেয়াদেই হবে বিশ্বাস তৈরি হয় চাঁদপুরের জনগণের মাঝে। আর এই বিশ্বাসটিতে দৃঢ়তা পায় চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে। জনগণের এই বিশ্বাসের প্রতিফলনও ঘটতে থাকে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে। প্রথমত সরকার ২০১৮ সালে চাঁদপুরে মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দেয়। সে বছরেই চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের জন্যে অধ্যক্ষ নিয়োগ এবং ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ক্লাস শুরু হয়। মেডিকেল কলেজটির কার্যক্রম শুরু হয় আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে। হাসপাতালটির চতুর্থ তলার কেবিন ব্লকে শুরু হয় মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম। এদিক দিয়ে মেডিকেল কলেজের স্থায়ী ভবনের জন্যে সাইট সিলেকশন কাজও চলতে থাকে। প্রাথমিকভাবে চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ ব্রিজের ওপারে গাছতলা মৌজায় মেডিকেল কলেজের জন্যে সাইট সিলেকশন করা হয়। এ সংক্রান্ত কমিটির প্রস্তাবনাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া হয়। আর তখনই ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে মেডিকেল কলেজটি যাতে আলোর মুখ দেখতে না পায়। তারা নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সাইট এলাকাটি নদীর পাড়ে, এখানে ডাকাতিয়া ভাঙছে, এখানে মেডিকেল কলেজ হলে নদীর ভাঙনের মুখে পড়বে এমন নানা ভুয়া তথ্য প্রচার করার কারণে সেটির অগ্রগতিও থেমে আছে। একইভাবে এখন ষড়যন্ত্রকারীদের কবলে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি পড়লো কি-না এ প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে চাঁদপুরবাসীর মাঝে।
জানা যায়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয় ২০১৯ সালের শেষের দিকে। এর জন্য জমি দরকার প্রায় শত একরের মতো। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি সদর উপজেলায় করার ব্যাপারে জোরালো দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। শুধু তাই নয়, এ ধরনের বিশেষায়িত বিশ^বিদ্যালয় জেলা সদরেই হতে হবে এমন বিধানও রয়েছে। কিন্তু এতো বিশাল সম্পত্তি একত্রে পাওয়া যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। ২০-২৫ একরের বেশি সম্পত্তি কোথাও পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষে সদর উপজেলার ১০নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নে বিশ^বিদ্যালয় করার মতো উপযোগী জায়গা রয়েছে এমন সন্ধান পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কমিটি সরজমিনে পরিদর্শন করে প্রাথমিকভাবে এর সাইট সিলেকশান করে। আর এখানে আরো আগ থেকেই ফিল্ম সিটি করার জন্যে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সেলিম খান তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেন। যা ২০১৭ সালে তিনি তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুস সবুর ম-লের কাছে লিখিতভাবে অনুমতি চান বলে সেলিম খান জানান।
এরই মধ্যে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। এরপর উপাচার্য তাঁর কার্যক্রম শুরু করেন। তথ্যানুসন্ধানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত যে সব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো হলো-
১০ মার্চ ২০২১ তারিখে উপাচার্য জেলা প্রশাসক চাঁদপুরকে ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। ৬ এপ্রিল ২০২১ তরিখে ৫১নং স্মারকে প্রশাসনিক অনুমোদনসহ প্রস্তাব প্রেরণের জন্য পত্র প্রেরণ। ৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ২৯নং স্মারকে উপাচার্য চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণের নিমিত্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনিক অনুমোদন চেয়ে পত্র প্রেরণ। ৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ১২৪ নং স্মারকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদনের পত্র উপাচার্য বরাবর প্রেরণ। ১১ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ৩২নং স্মারকে অধিগ্রহণের প্রস্তাব প্রেরণ। ১৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ৭১নং স্মারকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় চাঁদপুর ভূমি অধিগ্রহণের কমিটি করে সরজমিনে পরিদর্শনের পত্র। ২৭ এপ্রিল ২০২১ তারিখে কমিটির সুপারিশপত্র জেলা প্রশাসক চাঁদপুর বরাবর প্রেরণ। ৮ জুন ২০২১ তারিখে ৫৫নং স্মারকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রেরণ। ২ মে ২০২১ তারিখে ৫৭২ নং স্মারকে নদী ভাঙ্গার সম্ভাবনা নাই মর্মে প্রতিবেদন। ২০ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ৩৩নং স্মারকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র উপাচার্য বরাবর প্রেরণ। ১৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে ৭৩নং স্মারকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়, চাঁদপুর সাব রেজিস্ট্রার চাঁদপুরকে অধিক মূল্যে জমির দলিল রিজিস্ট্রি না করার পত্র। ১৬ মে ২০২১ তারিখে ১০৭নং স্মারকে জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটি ১১৫নং লক্ষ্মীপুর মৌজায় ৬২.৫৪৯০ একর ভূমি চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় জেলা ভূমি বরাদ্দ কমিটির কার্য বিবরণী। ১৮ মে ২০২১ তারিখে ০৪ ধারার নোটিস প্রদান। ১৬ জুন ২০২১ তারিখে ১৩২নং স্মারকে জেলা প্রশাসক চাঁদপুর চূড়ান্ত অনুমোদন চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ। ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে ১৮৩নং স্মারকে এলএকেস নং-১২/২০২০-এ ১৮/০৫/২০২০ তারিখ হইতে ১৭/০৫/২০২১ তারিখ পর্যন্ত মূল্যহার সংগ্রহের পত্র। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে ২১৯নং স্মারকের সাব রেজিস্ট্রার চাঁদপুর অধিগ্রহণকৃত ভূমির মূল্যহারের পত্র জেলা প্রশাসকের বরাবর প্রেরণ। ১৪ অক্টোবর ২০২১ তারিখে ২১৭নং স্মারকে বিশ^বিদ্যালয়ের ভূমির দাগ বাদ দিয়ে পুনরায় আরেকটি কমিটি করে পত্র প্রেরণ। ৩০ জুন ২০২১ তারিখে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহ অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব প্রেরণ। ১৯ জুলাই ২০২১ তারিখে ৯৮নং স্মারকে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করে জেলা প্রশাসক চাঁদপুরকে পত্র প্রেরণ।
এতোসব প্রক্রিয়া শেষে যখন চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্লাস কার্যক্রম সম্প্রতি চালু হবে, ঠিক তখনই এর জন্যে নির্ধারিত স্থানের জমির মূল্য নির্ধারণ নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় নানা তথ্য প্রচার হতে লাগলো। আর তথ্যগুলো প্রচার হচ্ছে চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের একটি অভিযোগের বরাত দিয়ে। যদিও জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ‘জেলা প্রশাসক চাঁদপুর’ নামে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন যে, এ বিষয়ে তিনি কোনো মিডিয়ায় কোনো ধরনের বক্তব্য দেননি। এরপরও বিভিন্ন মিডিয়ায় কারো কারো সাক্ষাৎকারসহ নানা তথ্য প্রচার হচ্ছে।
ফেস দ্যা পিপল ডট নেট নামে একটি ওয়েবসাইটে প্রথম এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রচার হয়। যেটি কানাডা থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ওয়েবসাইটে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদসহ একজন আইনজীবীকে লাইভে এনেও এ সংক্রান্ত সংবাদ লাইভ করা হয়। এসব বিষয়ে কথা হয় চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জহির উদ্দিন মিয়াজী, সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাদ্দাম হোসেন, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এবিএম রেজওয়ান, সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন এবং চাঁদপুর পৌর ছাত্রলীগের সভাপতি সোহেল রানা ও সাধারণ সম্পাদক জাহিরুল ইসলাম রবিন পাটওয়ারীসহ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সাথে। তারা বলেন, এখানে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডাঃ জেআর ওয়াদুদ টিপু, তাঁর আত্মীয় জাহিদুল ইসলাম রোমান ও সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী বেপারীর নামে। আর অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের তিন জনের নামে প্রায় সাড়ে তিন একর জমির মালিকানা আছে সে জন্য। এখানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ৬২ একর জমির মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন একর জমির মালিক তিনজন কীভাবে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেন? আরো সাড়ে ৫৮ একর জমির মালিককে কি তাহলে কোনো মূল্যই দেয়া হতো না? পুরো ৬২ একর জমির মূল্যই কি এই তিনজনকে দিয়ে দিতো সরকার? যদিও বাস্তবে জমি এখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি। যেখানে জমিই এখনো অধিগ্রহণ করা হয়নি, সেখানে অর্থ লুটপাটের অভিযোগ করাটা কতোটা ভিত্তিহীন তা জনগণের কাছে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তারা আরো বলেন, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমির মূল্য নির্ধারণ জমির মালিকের করার সুযোগ নেই। জেলা প্রশাসনই উভয় প্রাক্কলন তৈরি করেছে। তিলকে তাল করে এমন কল্পকাহিনী প্রচার পদ্মাসেতুর কথিত সেই দুর্নীতির অভিযোগকে স্মরণ করিয়ে দেয় বলে মন্তব্য করলেন এসব ছাত্র নেতা। একই মন্তব্য করলেন চাঁদপুরের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বৃহত্তর আওয়ামী পরিবারের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীরা। একইভাবে চাঁদপুরের সচেতন জনগণও মনে করছেন, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগটি পদ্মা সেতু নিয়ে ওঠা কথিত দুর্নীতির অভিযোগের ন্যায় বুমেরাং হয়ে যাবে না তো?