শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে বক্তব্যকালে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি
ঝুঁকি কমলে খুলবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অটোপাসের সুযোগ নেই
শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি বলেছেন, আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল পাল্টে ফেলা হবে। সনদসর্বস্ব পরীক্ষানির্ভর পদ্ধতি বদলাতে হবে। আমাদের মাইন্ডসেটও বদলাতে হবে। আনন্দময় শিক্ষার কথা আমি বলেছি। আমরা কী শিখলাম, কতটা শিখলাম সেটা মূল্যায়নের বদলে আমরা জুজু বানিয়ে ফেলেছি। সেজন্যে আমরা ধারাবাহিক মূল্যায়নে যাচ্ছি। জিপিএ-৫ তুলে দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সেটা করতে হবে।
বাংলাদেশে কর্মরত ১৫টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার 'নিরাপদ ইশকুলে ফিরি' শীর্ষক ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডাঃ দীপু মনি এসব কথা বলেন। এ আয়োজনে শিক্ষামন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করেই শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানো হবে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, ঝুঁকি কম মনে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সরকার শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে যথেষ্ট আন্তরিক। তবে সকল ঝুঁকি বিবেচনা ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করেই শিক্ষার্থীদের ফেরানো হবে। কোভিড পরিস্থিতি আমাদের সামনে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন ও সংস্কারের একটি সুযোগও তৈরি করেছে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগ, প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন ও দাতা সংস্থা সবাই একসঙ্গে কাজ করেই শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরাতে চায় সরকার।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে, এখন খুলবো। তাহলে খুললেই কী হবে? বিল্ডিং ব্যাক বেটার! আগে যা ছিলো তার চেয়ে কীভাবে ভালো করবো তা তো ভাবতেই হবে। কোভিড-১৯ আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, হাইজিনের ব্যাপারে এবং কী কী সুযোগ-সুবিধা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আছে তার বিষয়ে ভাবতে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সামাজিক দূরত্বের বিষয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমরা সামাজিক দূরত্বের কথা বলছি। আমাদের একটা বিরাট সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে শিক্ষার্থীদের গায়ে গায়ে লেগে বসতে হয়। তাহলে সামাজিক দূরত্ব কীভাবে হবে? গায়ে গায়ে লেগে বসলে আমাদের বন্ধুত্ব বেড়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমরা বলি শেয়ার করা ভালো, কিন্তু রোগ শেয়ার করা ভালো নয়। ওটা তো বন্ধুত্ব হলো না। আমাদের আইডিয়াল ক্লাসরুম সাইজ বলা হয় ৪০ জন বা তার নিচে শিক্ষার্থীর হিসেবে। ওপরে নয়। কিন্তু আমাদের দেশের সবচেয়ে স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের কাছাকাছি। তাহলে আমাদের জন্যে এটি নিয়ে কি এখনি ভাবার সুযোগ নয়? এখন একটা সুযোগ পেয়েছি ঠিক করা যায় কিনা। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো দরকার। আমরা কী পড়ছি, কী পড়াচ্ছি, কেনো পড়াচ্ছি, কীভাবে পড়াচ্ছি_এসব ভাবতেই হবে।
শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মাইন্ডসেট পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বাবা-মা হওয়া কষ্টকর, কঠিন কাজ। ভালো শিক্ষক হওয়া যেমন কঠিন, তেমনি ভালো বাবা-মা হওয়াও কঠিন। সন্তান জন্ম দিলেই ভালো বাবা-মা হওয়া যায় না। সেজন্যে সবার মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া উচিত।
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের কথা উল্লেখ অভিভাবকদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, জিপিএ-৫ নিয়ে উন্মাদনা চলে, জিপিএ-৫ পেলে উচ্ছ্বাস, আর ৪.৯ পেলে কবরের নীরবতা। সেটি শিক্ষার্থীদের জন্যে শুভকর কিছু? আমি মনে করি না। আমরা রোল নম্বর তুলে দেয়ার কথা ভেবেছি কেন? সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে শিক্ষার্থীদের নিস্তার দেয়ার জন্য।
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পড়তে হবে, ভালো ডিগ্রি অর্জন করতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ভালো রাখতে হবে। আমরা মানুষ হবো সেটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আনতে পারছি কি না, সেটার সেটার দিকে দিকে নজর দিচ্ছি কি না?
দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষকের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৪৩০ জন। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে তাদের পুরো জনসংখ্যা এর চেয়ে কম। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষার্থী এক কোটি ৫ লাখ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ১৫ হাজার ৫২৪ জন, আর শিক্ষার্থী ৪০ লাখ ৮৫ হাজার ২৯১ জন। পৃথিবীর খুব কম দেশ পাওয়া যাবে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় ৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। আমাদের এই সংখ্যাগুলো মাথায় রেখে বিবেচনা করা দরকার। মাঝে মাঝে রিসার্চের কথা যখন শুনি তখন স্যাম্পল নিয়ে আমার জানতে ইচ্ছে করে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, সিনিয়র শিক্ষক পদ ছিল না। সেটার ব্যবস্থা করে আমরা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষককে পদোন্নতি দিতে যাচ্ছি। এছাড়া নতুন করে দুই হাজার একশ' ৫০ জন শিক্ষক নিয়োগ হতে যাচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা খুব ভালোভাবে করোনা সংকটকে মোকাবিলা করেছি। মৃত্যুর হারও কমে এসেছে। তারপরও সংকট তো কিছু না কিছু থেকেই যায়। আমাদের কাছে অতি সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত এসেছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে যখন কথা হচ্ছিল-তিনিও (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেন আমাদের আবাসিক ছাত্রদের যদি টিকা দিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে পারতাম। প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সকল শিক্ষককে টিকা দেয়া হবে। এটি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে অনেক বেশি সহায়তা করবে। আমরা তার পরের ধাপে আবাসিক শিক্ষার্থীদের দিতে পারবো। আমাদের শিক্ষার্থী তো অনেক। পৃথিবীর কোনও কোনও দেশের পুরো জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। আমরা যখন সমস্যা নিয়ে কথা বলি, তখন অনেক দেশের সঙ্গে তুলনা করে ফেলি। হিসাব করি না। দেশের জনসংখ্যাটা মাথায় রাখি না।
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পড়তে হবে, ভালো ডিগ্রি অর্জন করতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে। শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ভালো রাখতে হবে। আমরা মানুষ হবো সেটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আনতে পারছি কিনা, সেটার সেটার দিকে দিকে নজর দিচ্ছি কিনা?
অটোপাসের সুযোগ নেই উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেছেন, পড়াশোনা ছাড়া কীভাবে অটোপাস দেবো? যদি স্কুল খুলতে দেরি হয়, তাহলে পরীক্ষা পরে নেবো। তাতে এমন কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।
২০২০ সালের এইচএসসিতে মূল্যায়নের মাধ্যমে ফলাফলের প্রসঙ্গ তুলে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০২০ সালে যারা এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন, তারা ভালো করে পড়াশোনা করেছেন। পুরোপুরি নিজেরা তৈরি হয়েছেন। ঠিক পরীক্ষার আগে পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে, এতে ওদের কোনও দোষ নেই। তারা পরীক্ষায় তাদের মেধার পরিচয় দিতে পারতেন। তাদের আগের দুটো পরীক্ষায় তারা তা ঘটাতে পেরেছেন। সেটার ওপর ভিত্তি করে ফলাফল দেয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, যদি মার্চের গোড়ায় খুলতে পারি, তাহলে আমরা একটি হিসাব করেছি, কতদিন পর এসএসসি পরীক্ষা নিলে তাদের শিক্ষাবর্ষ নষ্ট হবে না। বিঘি্নত হবে না। তাহলে আমরা কতগুলো কার্যদিবস পাবো, ক্লাস পাবো, সেই হিসাবে, নতুন করে সিলেবাস প্রণয়ন করেছি। কোন কোন বিষয় শিক্ষার্থীর জানাটা অত্যাবশ্যক সেটা মাথায় রেখে এসএসসির জন্য ৬০ কর্মদিবসের সিলেবাস তৈরি করেছি। অনেক বিষয় আছে, আগের ক্লাসে পড়েছে এবং পরের ক্লাসে আবারও পড়বে, সেসব বিষয় মাথায় রেখে করেছি। এইচএসসির ক্ষেত্রে আমরা ৮৪ কার্যদিবস করেছি। যদি স্কুল খুলতে দেরি হয় তাহলে পরীক্ষা পরে নেবো। তাতে এমন কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। তারপরও তাদের পরবর্তী যাওয়াটা সমস্যা হবে বলে আমরা মনে করছি না।
অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোঃ গোলাম ফারুক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সোহেল আহমেদ, ইউনিসেফের উপ-প্রতিনিধি ভিরা মেন্ডোনকা, বাংলাদেশে কানাডা হাইকমিশনের হেড অব ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিট্যান্স ফেদ্রা মুন মরিস বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ-এর পরিচালক (প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি) রিফাত বিন সাত্তার এই ক্যাম্পেইনের পটভূমি এবং বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আলোকপাত করেন। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোরশেদ। ওয়ার্ল্ড ভিশনের পরিচালক টনি মাইকেল অনুষ্ঠানটি সমন্বয় ও সঞ্চালনা করেন।
[সংবাদটি বাংলা ট্রিবিউনের তথ্য অবলম্বনে লেখা হয়েছে।]