বঙ্গবন্ধু-কন্যাকে নিয়ে টুকরো স্মৃতি
বঙ্গবন্ধু-কন্যা তখন গৃহবন্দি ধানমন্ডি পাঁচ নম্বর সড়কের সুধাসদনে। ২০০৭-এর সম্ভবত জুনের শেষ সপ্তাহ তখন। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রবেশাধিকার নেই সেই বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজনরা দেখা করতে পারেন। আমি তখন সেই বাড়িতে প্রতিদিন যাই। যাই বঙ্গবন্ধু-কন্যার ব্যক্তিগত চিকিৎসক পরিচয়ে।
তার কিছুদিন আগেই একদিন হঠাৎ করেই আমাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল তার বাড়ি থেকে দুই মোড় আগে পাঁচ নম্বর সড়কের মাথায়। প্রহরারত পুলিশ কিছুতেই যেতে দেবে না নেত্রীর কাছে। ওপরের নিষেধ আছে। শুধু আমাকে নয়, সবার জন্যই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য, বলেছিল পুলিশ। আমি ভেতরে নেত্রীকে ফোন করে জানালাম, ‘আপা, ঢুকতে দিচ্ছে না।’ নেত্রী অনুরোধ করতে বললেন তার নাম করে। শুনল না। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই চলল। এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হলো। নেত্রীকে বললাম, ‘কিছুই তো শুনছে না, তবে কি চলে যাব আপা?’ নেত্রী এবার বললেন, ‘ওকে বলো, তুমি আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তোমাকে ঢুকতে না দিলে আমি এখনই বেরিয়ে আসছি রাস্তা পর্যন্ত।’ শুনেই তটস্থ হয়ে পুলিশ সদস্যটি খুবই অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘এই কথাটা তো আগে বললেই পারতেন। যান, ভেতরে যান। এরপর যখনই আসবেন, এই পরিচয়টাই দেবেন।’ সেই থেকেই সাথে সাদা অ্যাপ্রোন আর রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ও স্টেথেস্কোপ নিয়ে রোজ সুধাসদনে আমার যাতায়াত। দুপুরের কাছাকাছি সময়ে গিয়ে নেত্রীর সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে বিকেলের মধ্যে বেরিয়ে আসা, এই ছিল ১৬ জুলাই ২০০৭-এর ভোরে নেত্রী গ্রেফতার হবার আগের দিন পর্যন্ত প্রতিদিনের রুটিন।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও গেছি সুধাসদনে। নিচতলায় শেখ জামাল ক্রীড়াচক্রের কর্তাব্যক্তি একজন দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি চলে যাবার পর নিচতলায় বসেই কথা হচ্ছে। নেত্রী আমাদের রেলপথ নিয়ে কথা বলছেন। রেলপথের উন্নয়ন নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলে চলেছেন। কোথায় কোথায় রেলসেতু হবে, কোথায় ডাবল গেজ হবে, কোথায় নতুন রেলপথ হবেÑ এমনভাবে বলে চলেছেন যে তিনি যেন চোখের সামনেই সারাদেশের রেলপথের ছবিটি স্পষ্ট দেখছেন। তার স্বপ্ন আর পরিকল্পনার কথা শুনতে শুনতে আমি দু-চোখের পানি সামলাতে পারলাম না। রাগ আর কষ্টের অদ্ভুত মিশ্রণ। নেত্রী উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছি কেন হঠাৎ করেই। রাগে-দুঃখে বললাম, ‘আপনাকে গৃহবন্দি করে রেখেছে। দুদিন বাদেই হয়তো গ্রেফতার করে জেলে নেবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহু বছর ক্ষমতায় থাকার পাঁয়তারা করছে। ঘরে-বাইরে শত্রুরা ষড়যন্ত্র করছে। আপনাকে মেরে ফেলবে সুযোগ পেলেই। আদৌ নির্বাচন হবে কি না, গণতন্ত্রে দেশ ফিরবে কি না বা ফিরলেও কত বছরে, তার কোনো হিসাব নেই। আর আপনি কি না বন্দিদশায় বসে বসে রেলপথের উন্নয়ন, সাধারণ মানুষের চলাচল আর দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনের সুবিধার পরিকল্পনা করছেন। আপনাকে গ্রেফতার করবে না তো আর কাকে করবে?’ বলতে বলতে উত্তেজনায় চোখের পানি নাকের পানি একাকার।
নেত্রী সস্নেহে শান্ত অথচ খুব দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘একটুও ভাববে না। ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার দেশের জনগণ ওদের শাসন মানবে না। ওরা নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে। জনগণ আমাদের ভোট দেবে। আমরা সরকার গঠন করব। পরিকল্পনা সব তাই এখন থেকেই করে রাখছি, যেন দায়িত্ব পাবার পর সময় নষ্ট না করতে হয়।’ আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনলাম। মনে পড়ল কর্নেল শওকত আলী চাচার কথা। ’৬৯-এ বঙ্গবন্ধু (তখনও এ উপাধিতে তিনি ভূষিত হননি) আগরতলা মামলায় তার সাথে আরও যারা অভিযুক্ত ছিলেন তাদের ফাঁসিতে ঝুলবার আশঙ্কার জবাবে বলেছিলেন, ‘ভাবিস না, জনগণ এ প্রহসনের বিচার মানবে না। আমাদের আন্দোলন করে মুক্ত করবে। তারপর নির্বাচন দিতে সরকার বাধ্য হবে। আমরা জিতব। আমাদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না। যুদ্ধ হবে। আমরা স্বাধীন হব।’ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। নেত্রীর কথাগুলো কি পিতার কথার মতোই সত্যে পরিণত হবে? কোন দৈববলে মানুষ এমন ভবিষ্যৎ দেখতে পারে? ইতিহাসবোধ আর মানুষকে বুঝতে পারার গভীরতা এবং আত্মবিশ্বাস কতটা জোরাল হলে কোনো নেতা বা নেত্রী এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন?
মনে পড়ে, চোখ বন্ধ করে স্রষ্টার কাছে নীরবে সেদিন প্রার্থনা করেছিলাম, পিতার মতোই বঙ্গবন্ধু-কন্যার কথাও যেন সত্যি হয়। আর শুকরিয়া আদায় করলাম আল্লাহর কাছে, এমন নেত্রীর কাছে থাকবার, তার স্নেহ পাবার, তার কাছে থেকে রাজনীতি শিখবার, তার কর্মী হিসেবে দেশের জন্য কাজ করবার সুযোগ তিনি দিয়েছেন আমাকে। আমি ধন্য।
লেখক : শিক্ষামন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক