• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

লকডাউন শিথিলে নিশ্চিত বিপর্যয়, হার্ড ইমিউনিটি শুধুই ভ্রম!

প্রকাশ:  ০২ মে ২০২০, ১৩:১৮
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

‘চলাচলের জন্য প্রস্তুত ট্রেন, অপেক্ষা নির্দেশের’— দেশের কোনো একটি সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম এটি। এভাবেই দেশের প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রেল যাত্রী পরিবহনে প্রস্তুতি শেষ করেছে। এ ঘোষণা এমন এক সময় এলো যখন আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে কোটি কোটি মানুষ বাড়ি ফিরতে উন্মুখ।

হঠাৎ করেই দেশের পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ার ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, ভেঙে গেছে ঘরবন্দি মানুষের ‘মনের লকডাউন’। এখন অনেকে রমজানে মসজিদ, ঈদ সামনে রেখে মার্কেটগুলো খুলে দেয়ারও দাবি তুলছেন। অবস্থা এমন, যেন কাল ভোর হলেই পুরো পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে যাবে!

কিন্তু আসলে কি তা-ই? আমরা চোখ বুজলেই ভাইরাস কি তার প্রলয় বন্ধ করে দেবে? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, লকডাউন শিথিল বা তুলে নেয়া হবে জাতির জন্য চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এমন প্রেক্ষাপটে আমরা কি জাপান, যুক্তরাষ্ট্র বা ইতালির ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাব, নাকি আসন্ন বিপর্যয় কাটাতে কৌশলী হবো?

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে চলছে অঘোষিত লকডাউন। আমাদের দেশে সরকারের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। বরং বারবারই বলা হচ্ছে সাধারণ ছুটি। গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি চলছে। পাঁচ দফা ছুটি বাড়িয়ে আগামী ৫ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো সরকার টানা ৪১ দিনের ছুটি ঘোষণা করল। এই ছুটির উদ্দেশ্য হলো, করোনাভাইরাস যেন দেশে মহামারি আকার ধারণ করতে না পারে।

chtt-01

হাটহাজারী উপজেলার কাটিরহাট বাজার। শুক্রবারের চিত্র এটি

কিন্তু চলমান অঘোষিত লকডাউনের এক মাসপূর্তির আগের দিন বিজিএমইএ-বিকেএমইএ পোশাক কারখানাগুলো খোলার জন্য বৈঠকে মিলিত হয় এবং তার পরের দিনই অর্থাৎ ২৬ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন শহরের পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়। কিন্তু কারখানাগুলো খোলার আগে যেসব ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল, তার কোনা কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। সেদিন বিকেলে চট্টগ্রাম ইপিজেড এলাকার কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায়, শ্রমিকদের মাঝে সামাজিক দূরত্ব মানার বালাই নেই।

পোশাক কারখানাগুলো খোলার পরপরই বিভিন্ন পক্ষগুলো লকডাউন শিথিলের দাবি তুলতে শুরু করে। আসলে এ দাবির প্রস্তুতি বেশ কিছুদিন ধরেই নিচ্ছিলে গোষ্ঠীগুলো। কিন্তু তাদের সামনে কোনো উপলক্ষ ছিল না। কিন্তু পোশাক কারখানার মালিকরা সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। এছাড়া লকডাউন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে নিয়মানুবর্তিতা তৈরি হচ্ছিল, সেটাও ওই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে ছেদ পড়েছে।

গত তিনদিন ধরে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং দেশের গণমাধ্যমের সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগের চাইতে বেশি বাইরে আসছেন নগরবাসী। কারণে-অকারণেই তারা বের হচ্ছেন। পোশাক কারখানার কাজে যোগ দিতে হাজার হাজার মানুষ লকডাউন ভেঙে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ও দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাটসহ বিভিন্নভাবে রাজধানীতে প্রবেশ করছেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবার অনেকে রাজধানী ছাড়ছেন। যেখানে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই। কার্যত অঘোষিত লকডাউন অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।

chtt-02

লকডাউন ভেঙে বিয়ে বোয়ালখালী উপজেলায়

ফলাফল যা হবার তা-ই হয়েছে, বুধবার (২৯ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ৬৪১ জন। যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) রাজধানীতে ২৪ ঘণ্টায় শুধুমাত্র ডেডিকেটেড হিসেবে ঘোষিত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৯৫ জন। এছাড়া পোশাক কারখানা খোলার পরদিন ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে একদিনে সর্বোচ্চ ৮৪ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন৷ সর্বশেষ আজ শুক্রবার (১ মে) নতুন আরও ৫৭১ জনের করোনা শনাক্ত হওয়ায় এখন দেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট হাজার ২৩৮ জন। আইইডিসিআর বলছে, এদের মধ্যে প্রায় ৮০০ রোগী আছেন যাদের শরীরে করোনার কোনো লক্ষণ নেই।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির জাগো নিউজকে বলেন, “এভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় পোশাক কারখানাগুলো খুলে দেয়ায় ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণের মাত্রা বেড়েই গেল। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। শুধু তা-ই নয় ‘ম্যাসাকার’ ঘটে যেতে পারে। বিষয়গুলো আমরা নির্ধারিত ফোরামে জানিয়েছি।”

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘আমরা সরকারি সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কথা বলতে পারব না। মানুষ বাইরে বের হলে ঝুঁকি তো থাকবেই। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এর বেশি কথা বলা সম্ভব না।’

chtt-03

চট্টগ্রামের ইপিজেডে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই

শিথিল লকডাউনে বিপর্যয় নিশ্চিত

টানা এক মাস ধরে চলমান লকডাউন এখন কার্যাত ভেঙে পড়ার উপক্রম। গণপরিবহন বাদে সব পরিবহন রাস্তায় নেমেছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন সড়কে রিকশার যানজটও দেখা গেছে। নগরে চালু হওয়া পোশাক কারখানাগুলোর প্রবেশপথে জীবাণুনাশক স্প্রের ব্যবস্থা করা হলেও শ্রমিকদের পরিবহন ও চলাফেরায় প্রয়োজনীয় নিয়ম মানানো সম্ভব হচ্ছে না। এই সুযোগে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কাজে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণঘাতী ভাইরাস কোভিড-১৯ এর গতিবিধি কী হতে পারে তা নিয়ে জানতে দেশসেরা তিন প্রতিষ্ঠানের তিন ভাইরোলজিস্ট ও মাইক্রোবায়োলজিস্টের সঙ্গে কথা বলে জাগো নিউজ। সবার মতামত হলো- এভাবে অবাধ চলাফেরা চলতে থাকলে ‘বিপর্যয় নিশ্চিত’।

চট্টগ্রামের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) এর ল্যাবপ্রধান ও মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘চট্টগ্রামে সংক্রমণ শুরুর পর স্বাস্থ্য বিভাগ-মেট্রোপলিটন পুলিশ আক্রান্ত এলাকা লকডাউন করে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। খেয়াল করলেই দেখবেন, এ কারণে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া নগরের অন্যান্য এলাকাগুলো সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু এখন ইপিজেডসহ পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা যে হারে আসা-যাওয়া করছেন, তাতে ভাইরাসের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে সম্ভাব্য রোগীদের শনাক্তের কোনো পথ রইল না। এদের মাঝে কোনোভাবে একজন আক্রান্ত হলেই রোগটা ছড়িয়ে যাবে সারা শহরে।’

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের স্বাভাবিক গতি নিয়ে লিখে আলোচনায় এসেছেন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)- এর ভাইরাসবিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ভাইরাসের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিয়ে আমরা লকডাউন শিথিলের পক্ষে মত দিচ্ছি। কিন্তু সেটা এভাবে নয়। সেফটি মেজারগুলো নিশ্চিত না করে কারখানা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলে, সেসব প্রতিষ্ঠা আসলে কতদিন চালু রাখা যাবে, সেটাই প্রশ্ন। আমরা বলেছি, ধাপে ধাপে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিসরে উন্মুক্ত করতে। করোনা আক্রান্ত এলাকা বিবেচনায় আলাদা জোনে ভাগ করে সুরক্ষিত জোনের প্রতিষ্ঠানগুলো চালু করা যেতে পরে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা শুধু বিপর্যয়ই ডেকে আনবে।’

chtt-04

চট্টগ্রামের ইপিজেডে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই

প্রসঙ্গত, গত ২৬ এপ্রিল থেকে চট্টগ্রামের ইপিজেডসহ ২৫৫টি পোশাক কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। এসব কারখানার কর্মরতদের অধিকাংশের বসবাস নগরের ইপিজেড থেকে পাহাড়তলী পর্যন্ত। সর্বশেষ গত বুধবার (২৯ এপ্রিল) ইপিজেড এলাকার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) মেরিন ওয়ার্কশপের কর্মচারী (৫২) করোনা ‘পজিটিভ’ হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এর আগে বন্দর এলাকায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়। পাহাড়তলীতে এক গার্মেন্ট কর্মকর্তার পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত হন। পোশাকশ্রমিক অধ্যুষিত পাহাড়তলী ও আশপাশের আকবরশাহ-হালিশহর থানা এলাকাকে চট্টগ্রামে করোনার সবচেয়ে বড় ক্লাস্টার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও ভাইরোলজিস্ট ডা. জাহিদুর রহমানের মতে, ‘লকডাউন শিথিল করা বা তুলে নেয়া হবে চরম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’ তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি কোনো দেশের লকডাউন তুলে নেয়ার আগে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে বলেছে। অন্যান্য দেশের বিশেষজ্ঞরাও একই ধরনের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। তারা বলেছেন- ‘কোনো দেশ লকডাউন শিথিল বা তুলে নেয়ার আগে তাদের জনস্বাস্থ্য বাহিনীকে প্রসারিত করুন, প্রশিক্ষণ দিন এবং মোতায়েন করুন।’ আমরা কী করেছি? একেবারে প্রথম পর্যায়েই ট্রায়াজ (কোভিড সন্দেহভাজন রোগী বাছাই প্রক্রিয়া) প্রটোকল না মেনে, ভুয়া পিপিই দিয়ে, সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ খোলা রেখে শত শত হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের (ডাক্তার, নার্স, টেকনোলজিস্ট ইত্যাদি) কোভিড-১৯ পজিটিভ বানিয়ে জনস্বাস্থ্য বাহিনীকে ভয়ঙ্করভাবে সঙ্কুচিত করে ফেলেছি।

‘এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি সন্দেহজনক কেস খুঁজতে সিস্টেম প্রয়োগের কথা বলেছে। অথচ আমাদের নীতিনির্ধারকদের এই বিষয় সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাটুকুও নেই। অথচ পুরো পৃথিবীর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কন্টাক্ট ট্রেসিং হচ্ছে কোনো ভাইরাল এপিডেমিক কন্ট্রোল সিস্টেমের ব্যাকবোন বা মেইন পিলার। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে, তার পেছনের প্রধান কারণ ছিল অ্যাগ্রেসিভ টেস্টিং অ্যান্ড কন্টাক্ট ট্রেসিং। আমেরিকা, ব্রিটেন, স্পেন, ইতালির মত দেশগুলো প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। কয়েকদিন আগে থেকে তারা আবার কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের জন্য কয়েকশ এপিডেমিওলজিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। এটি সফল করতে কয়েকটি দেশে সেনাবাহিনীর সাহায্য পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে, ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল অ্যাপ। গুগল ও অ্যাপেলের মতো কোম্পানি এক হয়ে চেষ্টা করছে আরও কার্যকর ক্রস প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে পারবে এমন অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপ করার। আর আমাদের দেশে কেমন কন্টাক্ট ট্রেসিং হয়, সেটার প্রমাণ খুঁজতে বেশি দূর যাওয়া লাগবে না। কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই বুঝবেন কীভাবে তার কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হয়েছিল। উনার মাধ্যমে মোট কতজনকে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হয়েছিল। এ অবস্থায় সবায় যখন খোলাখুলি ঘুরে বেড়াবে তখন কন্টাক্ট-কে ট্রেস করার কোনো সুযোগই থাকবে না’- বলেন ডা. জাহিদুর।

Image

বেতন ও চাকরির দাবিতে বিক্ষোভ

তিনি আরও বলেন, ‘প্রায় প্রতিটি দেশই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পরীক্ষার ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছে। অথচ আমাদের এখানে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করা হয়েছে এর পরীক্ষা নিয়ে। প্রথম থেকেই একটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে গণমাধ্যমে বলে আসছিলেন, একমাত্র তাদেরই এ পরীক্ষা করার উপযুক্ত ল্যাব, কিট ও ম্যানপাওয়ার আছে। বাস্তবতা হলো, বিভিন্ন সরকারি, প্রাইভেট ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় মিলে কমপক্ষে ১০০টি পিসিআর মেশিন এই মুহূর্তে চলমান আছে। সেগুলো চালানোর জন্য লোকবলও আছে, ট্রেনিং দেয়ার লোকও আছে। তারপরও একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানের গোয়ার্তুমির কারণে সেসব রিসোর্স কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অবশেষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জেলাপর্যায়ে পিসিআর ল্যাব চালুর নির্দেশ দেয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হয়। তারপরও যে পরিমাণ টেস্ট করা প্রয়োজন তার দশভাগের একভাগও আমরা করতে পারছি না।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেফারেন্স তুলে ধরে এ চিকিৎসক বলেন, কোয়ারেন্টাইনে থাকা নাগরিকদের জন্য একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। ইতালিফেরত ১৪২ প্রবাসীকে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এখন অবাধ সংক্রমণ শুরু হলে কোন পরিকল্পনায় আমরা রোগীদের কোয়ারেন্টাইন বাস্তবায়ন করব?

‘হার্ড ইমিউনিটি’ তত্ত্ব এক অনিশ্চিত ভাগ্যের নাম

করোনাভাইরাসের থাবায় অচল বিশ্বকে সচল করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে বিশ্ব। অজানা ভাইরাসকে কীভাবে প্রতিহত করা যাবে তা আজও অজানা সবার। তাই কোথাও কোনো আশার আলো দেখলেই তা আঁকড়ে ধরতে চাইছে দুনিয়া। এই যেমন, প্রথম থেকেই প্রচুর করোনার ‘টেস্ট’ করে করে পরিস্থিতি আয়ত্তে নিয়ে এসেছে দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়া তাই একটা ‘মডেল’ই হয়ে গেছে বাকি পৃথিবীর কাছে। কিন্তু মুশকিল হলো সেই ‘মডেল’ অনুকরণ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘টেস্ট’ করার জন্য প্রয়োজনীয় কিটের জোগান পেতেই হিমশিম খাচ্ছে অন্যরা।

করোনার জেরে লকডাউনে বহু দেশ, মানুষের সাধারণ জীবনযাপন আজ বিপন্ন। করোনাকে বাগে আনতে কোনো না কোনো ধরনের লকডাউনের খোলসে ঢুকে পড়েছে প্রায় ৮৭ শতাংশ বিশ্ব। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ লকডাউন পদ্ধতি বেছে নিলেও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখা গেছে সুইডেন, নিউজিল্যান্ডসহ প্রথম দিকে যুক্তরাজ্য-কেও। অবস্থাদৃষ্টে অচল হয়ে পড়া অর্থনীতি সচল করতে বাংলাদেশও সেই পথে এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

করোনা মহামারি শুরুর পর প্রায় সব দেশের গবেষকরা জানিয়েছিল, এই হার্ড ইমিউনিটির পথ ভয়ঙ্কর হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আরেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, 'হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে মোট জনসংখ্যার ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষকে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি নিতে হবে। তাহলে বাকি ১০ শতাংশ মানুষ এই সুবিধা পাবে। যদি অধিকহারে সংক্রমণ ঘটে তাহলে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব হবে, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কলকারখানা সীমিত আকারে খুলে দেয়া, আবার ঢাকার রেস্তোরাঁ খুলে দেয়া, ঢিলেঢালা লকডাউন— এসব কী ইঙ্গিত দেয় আমরাও হার্ড ইমিউনিটি পদ্ধতির দিকে হাঁটছি।

কিন্তু ভাইরোলজিস্ট ডা. জাহিদুর রহমানের মতে, “‘হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব’ কখনও-ই লকডাউনের বিকল্প হতে পারে না। এটি শুধুই ভাগ্য, একটি অন্ধকার ভাগ্য।”

chtt-06

ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় দিন কাটে যার সেই গবেষক বলছেন, “আমাদের দেশে কয়েকদিন পরপর হাইপ (উত্তেজনা) ওঠে, এবার বলা হচ্ছে ‘হার্ড ইমিউনিটি’র কথা। কিন্তু হার্ড ইমিউনিটি কখনও অপশন হতে পারে না; এটি একটি পরিণতি, আর এই পরিণতি কোনো জাতির জন্য ভালো হতে পারে না। এখন পর্যন্ত যেসব ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিশ্ব ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করেছে তার বিপরীতে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন থাকতে হবে। তারপর ভাইরাসের কারণে আমাদের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেই অ্যান্টিবডি ‘প্রটেক্টিভ অ্যান্টিবডি’ হতে হবে। সবার শরীরেই যে নির্দিষ্ট ভাইরাসটির বিরুদ্ধে অ্যন্টিবডি সুরক্ষা দেবে— এমনটি আশা করারও কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে ব্যক্তির শরীরেও যেমন কিছু কারণ আছে, আবার ভাইরাসেরও কারণ আছে প্রটেক্টিভ অ্যান্টিবডি পাওয়া, না পাওয়ার পেছনে। এটি হতেও পারে, নাও হতে পারে।”

“যে ভাইরাসের চরিত্র কম পরিবর্তন হয় সেটি আপনাকে প্রটেক্টিভ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ দিতে পারে। কিন্তু যে ভাইরাস ঘন ঘন চরিত্র বদল করে তার বিপরীতে ভ্যাকসিন তৈরি করাটা কঠিন হয়ে যায়, সেহেতু ভ্যাকসিন ছাড়া ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করাও কঠিন হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ এ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, যারা ইতোমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, এর ফলে তার শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, এটি তাকে সুরক্ষা দেবে কি-না, তা নিশ্চিত নয়। এমনও দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরে আবারও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এটি প্রমাণিত হয়নি যে, করোনার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি কাজে দেবে। এ কারণে করোনার ক্ষেত্রে ‘হার্ড ইমিউনিটি’র বিষয়টি বাতিল করে দিতে হচ্ছে।”

মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডা. শাকিল আহমেদ বলেন, ‘হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তুলতে মোট জনসংখ্যার ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষকে আক্রান্ত হবার পর সুস্থ হতে হবে। তাই এটি কোনোভাবেই সহজ বিষয় নয়। সুইডেন, কানাডা কিংবা নিউজল্যান্ড এ পদ্ধতি মেনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থা-কে মেলানো কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। কেননা, আমরা যদি সুইডেনের জনসংখ্যা এবং সেখানে বসবাসের ঘনত্ব দেখি তাহলে দেখা যায়, সুইডেনের মোট জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি। আর প্রতি বর্গকিলোমিটারে সেখানে মাত্র ২৫ জন লোক বসবাস করে। বিপরীতে বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১১১৬ লোক বাস করে, যা সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ।’

ডা. শাকিল বলেন, ‘হার্ড ইমিউনিটি আমাদের জন্য ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। ধরুন, হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে ১৮ কোটি মানুষের ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ১০ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলো। এরপর আমরা কতজনকে সুস্থ করতে পারব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর মধ্যে যদি ১ শতাংশ মানুষও মারা যায়, তাহলে এক লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সে অর্জন কি আসলেই কোনো অর্জন হবে?’

জাপানের হোক্কাইডো শহরের ঘটনা যে বার্তা দিচ্ছে

করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণে জাপানের যে অঞ্চলের গল্প কিছুদিন আগেও সাফল্যের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হতো; যখন তারা সংক্রমণের সংখ্যা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল- সেই হোক্কাইডো অঞ্চলই দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ধাক্কা সামাল দিতে এখন হিমশিম খাচ্ছে।

chtt-08

চট্টগ্রামের পোশাক কারখানাগুলো ছুটির পর এমন দৃশ্য এখন প্রতিদিনের

জাপানের মূল দ্বীপপুঞ্জগুলোর সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ হোক্কাইডো ফেব্রুয়ারিতে যখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে, তারাই ছিল পুরো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা প্রথম এলাকা। স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়, বড় ধরনের জনসমাগম বন্ধ করে দেয়া হয় এবং মানুষকে ঘরে থাকতে 'উৎসাহ' দেয়া হয়।

স্থানীয় সরকার ভাইরাস সংক্রমণ রোধে দৃঢ় সংকল্প ছিল- শনাক্ত করা এবং আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের দ্রুত আইসোলেট করে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করে তারা।

তাদের ওই নীতি কাজ করে, মার্চের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ওই অঞ্চলে প্রতিদিন নতুন সংক্রমণের সংখ্যা এক বা দুইয়ে নেমে আসে। ১৯ মার্চ জরুরি অবস্থা তুলে নেয়া হয় এবং এপ্রিলের শুরুতে স্কুলও খুলে যায়। কিন্তু জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার ২৬ দিনের মাথায় আবারও জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয় শহরের কর্তারা।

নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিকে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন গবেষকরা। তাই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ লকডাউন তুলে না নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক বিখ্যাত জার্নাল দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র।

ল্যানসেটে প্রকাশিত ওই গবেষণাপত্রের সহ-গবেষক এবং হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ টি-য়ু বলেন, যখন লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে আপনি সংক্রমণের গতিকে একেবারে নিম্নপর্যায়ে নিয়ে আসলেন তখন ভ্যাকসিনটা কাজ করবে চূড়ান্ত আঘাতের মতো। কিন্তু তা না করতে পারলে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে জাঁকিয়ে বসতে পারে করোনা, যেটা হবে মানবজাতির জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, ‘লকডাউন তুলতে হবে কৌশল নিয়ে, ধীরে ধীরে। প্রথমে যদি দোকানপাট-বিপণিবিতান খোলা হয় তবে পরিস্থিতি দেখে তার কিছুদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যেতে পারে। এভাবে একে একে খোলা যেতে পারে উপাসনালয়, পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু একসঙ্গে সবকিছু খুলে দেয়াটা হবে ভীষণ বোকামি।’

সূত্র : জাগো নিউজ।