ডেঙ্গুর প্রকোপে কিন্তু জিডিপি বাড়ে!
‘ছেলেধরার মতো ডেঙ্গুর সংখ্যাও একটা গুজব’। ‘এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মতো, তাই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না’। ‘উত্তরে ওষুধ দিলে মশা দক্ষিণে যায়, দক্ষিণে দিলে উত্তরে যায়। এ কারণে মশা নিধন সম্ভব হয়নি’। ‘উত্তর সিটি কর্পোরেশনে অকার্যকর প্রমাণিত ওষুধ দক্ষিণ সিটিতে কার্যকর’। ‘বাসায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হবে’।
এ কথাগুলো শুনে আপনি কি অবাক হয়েছেন? আমরা কি মনে করি এ দেশের খুব বড় বড় দায়িত্বশীল পদে বসে থাকা মানুষের এ ধরনের উক্তি করা দুঃখজনক? তার মানে তো কিছুদিন আগে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশের দাম আর বালিশ তোলার খরচ দেখেও আমরা অবাক হয়েছিলাম। সেটি দেখে ভীষণ অবাক হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম।
আসহাবে কাহাফ (সেভেন স্লিপারস)-এর জানা গল্পটা আবারও মনে একটু করিয়ে দিতে চাই। ২৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সাত জন যুবক একটা গুহায় আশ্রয় নেয়। সেখানে তারা ঘুমিয়ে পড়েছে।
তারপর তারা ঘুম থেকে ওঠে যখন গুহা থেকে বের হয়েছে তখন চারপাশটা তাদের কাছে ভীষণ অপরিচিত ঠেকে। কারণ তারা টেরই পায়নি তাদের ঘুমের পরিমাণ ছিল ৩০০ বছর। ৩০০ বছর ঘুমিয়ে থেকে এমন বাস্তবতার মুখে পড়াটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ পাল্টাচ্ছে, ভীষণ দ্রুতই পাল্টাচ্ছে। না, আমি তথাকথিত উন্নয়নের কারণে কিছু অবকাঠামো তৈরিজনিত কারণে পাল্টাচ্ছে, সেটা বলতে চাইছি না। আমি সেই পরিবর্তনের কথা বলতে চাইছি যেটা ঘটছে এ রাষ্ট্রের মূল কাঠামোটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ার কারণে।
তাই ৩০০ বছর দূরেই থাকুক, ৩০০ ঘণ্টাও যদি কেউ ঘুমিয়ে থাকে এ দেশে, সে এ দেশকে ঠিকঠাক চিনতে পারবে না। কিন্তু কেউ যদি দৈনিক সাধারণ ঘুমটা ঘুমান তাদের ডেঙ্গু সংক্রান্ত এসব মন্তব্য শুনে বিন্দুমাত্র দুঃখিত বা অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এই দেশে বড় বড় চেয়ারে বসে থাকা মানুষদের মুখে প্রতিনিয়ত যেসব কথা আমরা শুনি তাতে ডেঙ্গুর সাম্প্রতিক সময়ে তাদের উক্তি নিয়ে অবাক হইনি আমি। বরং তাদের কেউ যদি বলতেন- ‘ডেঙ্গু বলে আসলেই কিছু নেই, এটা গুজব’, তাতেও আমি অবাক হতাম না একটুও।
ঠিক এ কারণে নানা প্রকল্পে আর ব্যাংক থেকে দিনের পর দিন পুকুর চুরি দেখার পর রূপপুরের সেই ‘বালিশকাণ্ড’ দেখে আমি অবাক হইনি মোটেও।
আসলে একটা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষদের যদি জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজন না থাকে, তাহলে আপনি বলতে পারেন, করতে পারেন যা খুশি তা। ঠিক সেটির প্রদর্শনই দেখছি আমরা চারদিকে। এটাই হওয়ার কথা।
এবারের ডেঙ্গু নিয়ে সরকারের অবিশ্বাস্য ব্যর্থতার নানা কথা বলা যায়। যে ওষুধ দিয়ে মশা মারার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা তার কার্যকারিতা হারাচ্ছে, এটি গত কয়েক বছর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। সেটি পাল্টানো হয়নি। কেন পাল্টানো হয়নি সেটিও এর মধ্যে পত্রিকায় চলে এসেছে- দুটি কোম্পানিকে অন্যায় সুবিধা দিতে গিয়েই এটি করা হয়।
সবচেয়ে অবিশ্বাস্য একটা খবর এসেছে পত্রিকায়। ২০১৫-এর জুন থেকে ২০১৬-এর জুন পর্যন্ত ঢাকার ৬টি উদ্যানে একটা সমীক্ষা চালায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে দেখা যায়, শুধু বলধা গার্ডেনে এডিস মশার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়।
শুধু একটা জায়গায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ডেঙ্গুর বিস্তৃতি বেশ কয়েক বছরের জন্য কার্যকরভাবে ঠেকানো যেত। তবে এসব ক্ষেত্রে যে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না, এটা জানা যায়- এটা বাংলাদেশ এবং এই দেশে এখন একটা জবাবদিহিহীন সরকার ক্ষমতায়।
সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনার অভাবে লাখ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। সর্বশেষ খবরে ডেঙ্গুর ব্যাপ্তি এখন ২-৩টি বাদে সব জেলায় পৌঁছেছে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হচ্ছে, ডেঙ্গুর মৌসুম আরও তিন মাসের মতো বাকি আছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি সামনের সময়টা কত ভয়ংকর। এমন এক সময়ে আমাদের দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার হচ্ছে যখন আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গু প্রকোপ কমতে কমতে এখন খুবই সামান্য পর্যায়ে আছে।
একটা দেশের সরকারের জবাবদিহিতা এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকলে সেটার ফল কী হতে পারে পশ্চিমবঙ্গ ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। আর মানুষের প্রতি যদি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা না থাকে তার ফল কী হতে পারে সেটার জাজ্বল্যমান প্রমাণ বাংলাদেশ।
এই যে যখন স্রেফ সরকারের অবহেলা, অব্যবস্থাপনার ফলে ডেঙ্গু মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে, তখন মানুষের অন্তত প্রাণ বাঁচানোটা জরুরি হওয়ার কথা। সরকারি হাসপাতালে বারান্দায়ও রোগী রাখার ঠাঁই নেই, সামর্থ্যহীন রোগী যাবে কোথায় তাহলে?
জনগণের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা থাকলে কৃত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য ঘোষণা করতে পারত অন্তত ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তুকি দেবে সরকার। আমি জানি, সেটাও হবে না।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে, কর্তৃত্ববাদী শাসন মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বর্তমান সরকার উন্নয়নকে একমাত্র অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। আমাদের সামনে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হিসাব প্রতিনিয়ত আনা হয়।
এ দেশের আদৌ উন্নয়ন কতটা হচ্ছে, যা হচ্ছে সেটার সুফলভোগী কারা সেটা নিয়ে কথাবার্তা এখন মোটামুটি চারদিকেই হচ্ছে, আমি নিজেও কোনোদিন সময় করে লিখব। কিন্তু এটুকু বলা যায় সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের সুফলভোগী একেবারে হাতেগোনা কিছু মানুষ যারা তাদের ‘ক্রোনি’।
উন্নয়নের কথা মনে পড়ল বর্তমানের ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারের অর্থনৈতিক প্রভাবের কথা মাথায় রেখে। যে ব্যাপক মাত্রায় ডেঙ্গু এবার ছড়িয়েছে, সেটির অর্থনৈতিক প্রভাব হবে অনেক বড়। এবারকার ডেঙ্গু আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে বড় প্রভাব রাখবে।
ডেঙ্গু ভীতিতে মশা মারার ওষুধ, অ্যারোসল, কয়েলের বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। লাখ লাখ মানুষের জ্বর হচ্ছে এবং তাদের জ্বরের কারণে ওষুধ বিক্রি বেড়েছে অনেকগুণ। ঠাঁই দেয়া যাচ্ছে না, এমন সংখ্যক রোগী হাসপাতালে যাচ্ছে, তাদের হাজার হাজার থেকে শুরু করে লাখ লাখ টাকা হাসপাতালে খরচ করতে হচ্ছে।
এক হাসপাতাল তো ২১ ঘণ্টায় একজন রোগীর কাছ থেকে ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা বিল করেছে। মানুষের এই যাবতীয় ব্যয় শেষ পর্যন্ত জিডিপিতে হিসাব হবে। অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু থাকলে এবং তার প্রাপ্তি যেভাবে ছড়িয়েছে তাতে দেখা যাবে এ বছরের ডেঙ্গু আমাদের জিডিপি গ্রোথে খুব উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কনট্রিবিউশন করেছে।
সমাজের বেশিরভাগ মানুষকে সুফল পৌঁছে না দিয়ে, এমনকি তাদের জন্য ক্ষতিকর প্রকল্প নিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি দেখানোই যখন সরকারের মূল কৌশল, তখন ডেঙ্গু তো সরকারের কাছে এক রকম ‘আশীর্বাদই’।
ডেঙ্গু নিয়ে নানারকম অবহেলা, দায় এড়িয়ে যাওয়া, সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া যার ফলে লাখ লাখ মানুষের অসুস্থতা, আর্থিক চাপ এবং বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুর সিজন শেষ হতে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ হবে। মানে এর অর্থনৈতিক প্রভাবও বাড়বে আরও বহুগুণ।
আগামী অর্থবছরের আগে আরও অনেক নতুন নতুন ইস্যু আমাদের এই বছর ডেঙ্গু নিয়ে কী হয়েছিল, সেটা ভুলিয়ে দেবে, কিন্তু থেকে যাবে ডেঙ্গুর প্রভাবে ঘটা জিডিপির প্রবৃদ্ধি। সরকারের জন্য এটাও বা মন্দ কী?
এই কলাম শেষ করার সময় খবরে দেখলাম দেশের এই ডেঙ্গু মহামারীর সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী সপরিবারে মালয়েশিয়ায় আছেন। তিনি নাকি সেখানে এক সপ্তাহ থাকবেন। আমি জানি, এটা নিয়েও আমাদের অনেক কলামিস্ট, টকশো-এর টকার, ফেসবুকার খুব অবাক হবেন, ক্ষোভ-উষ্মা প্রকাশ করবেন।
আমি কিন্তু সেটা করব না, কারণ আমি অবাক হইনি বিন্দুমাত্রও। তার পরিবার সম্ভবত ডেঙ্গুর পুরো সিজনটাই বিদেশে থেকে আসবে, তিনিও যদি সেটাই করেন, থেকে যান অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত তাহলেও আমি অবাক হব না। বছরের পর বছর এই দেশের সরকারগুলোকে দেখছি নিরবচ্ছিন্নভাবে, আমি এখন আর বিস্মিত হই না কিছুতেই। সব কিছুতেই মনে হয় এটাই তো হওয়ার কথা।
জাহেদ উর রহমান : সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট