দলীয় শাস্তি থেকে বাঁচতে নেতাদের দেনদরবার
উপজেলা নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ইন্ধনদাতাদের কঠোর শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী ২৮ জুলাই থেকে ওই প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। বিষয়টি জানার পরই নির্বাচনে বিদ্রোহী ও ইন্ধনদাতারা দলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। অভিযুক্ত অনেক তৃণমূল নেতা ঢাকায় এসে এরই মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। নেতাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে তারা নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাদিক নেতার সঙ্গে আলাপে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অভিযুক্তরা বলছেন, এলাকায় রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে দল মনোনীতদের বিপক্ষে কাজ করেছেন তারা। তাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যারা বিএনপি সরকারের সময় নির্যাতিত। দলের প্রতি তাদের অবদান রয়েছে।
এদিকে দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সব বিচার-বিশ্লেষণে বিদ্রোহী ও ইন্ধনদাতাদের বিষয়ে যে কঠোর শাস্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি, তা থেকে শেষ পর্যন্ত খানিকটা নমনীয় হতে পারে, এমন আলোচনা রয়েছে খোদ আওয়ামী লীগের ভেতরেই। তবে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং ভবিষ্যতে এমন অবস্থা এড়াতে দল-বিদ্রোহী নেতাদের সতর্ক করতে কারণ দর্শানোর জন্য চিঠি দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের বক্তব্যে দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক কঠোর সিদ্ধান্তের কথাই জানান দিচ্ছে।
দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, গত ১২ জুলাই দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া পদধারী নেতাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর বিদ্রোহী প্রার্থীদের সহায়তা করা মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ) দেওয়া হবে এবং তিন সপ্তাহের মধ্যে এর জবাব দিতে হবে। দলীয় একটি সূত্র মনে করে, উপজেলায় যারা বিদ্রোহ করেছেন, তাদের বহিষ্কার করতে গেলে অনেক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ এতে অনেক উপজেলার তৃণমূল নেতারাই জড়িত রয়েছেন। আর বিদ্রোহীদের ইন্ধনদাতা হিসেবে রয়েছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি। তবে ভবিষ্যতে যাতে এমন অবস্থায় দলকে আর পড়তে না হয়, সে জন্য ওই বিদ্রোহী নেতাদের সতর্ক করতে তাদের কারণ দর্শানোর জন্য চিঠি দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের ওই সূত্রটি বলছে, উপজেলা নির্বাচনে এবার বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও দলীয় শৃঙ্খলার কথা বিবেচনায় নিয়ে হয়তো শেষ পর্যন্ত কঠোর সিদ্ধান্তের যে দলীয় অবস্থান, তা থেকে সরে আসতে পারে দল।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা বলেন, বিদ্রোহীদের ইন্ধনদাতা হিসেবে সাবেক এবং বর্তমান মন্ত্রী-এমপি মিলিয়ে ৭০ জনের মতো রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন হলেও তা অনেক দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। তবে দলীয় শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে তাদের কারণ দর্শানোর মাধ্যমে সতর্ক করা হবে—এটা এক ধরনের নিশ্চিত।
দলীয় সূত্র বলছে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের অভিযোগের যে তালিকা কেন্দ্রে এসেছে, সেখানে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারাও রয়েছেন। তাদের মধ্যে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, তারা এলাকায় রাজনীতিতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা এবং বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে দল মনোনীতদের বিপক্ষে কাজ করেছেন। স্থানীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচের কারণে এমনটি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এ ক্ষেত্রে তারা কারণ দর্শানোর চিঠি পেলে তার জবাব দিতে প্রস্তুত। তবে সরাসরি বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত নিলে সেটি দুর্ভাগ্যজনক হবে বলে মনে করেন তারা।
তবে বিদ্রোহীদের বিষয়টি নিয়ে দল সহানুভূতিশীল হবে কি না—জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, এখানে তো সহানুভূতির কোনো বিষয় নেই। এখন হলো বিচারের বিষয়। শোকজ আর সাসপেন্ড—দুটিই করা হবে। এটি নিয়ে কাজ চলছে। সহানুভূতি দেখানো হবে কি না—এটি পরবর্তী পর্যায়ের বিষয়।
এসব বিষয়ে গত শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, শাস্তির ধরন হতে পারে কাউকে শোকজ এবং কাউকে কাউকে সাসপেন্ড করে। আবার কাউকে কারণ দর্শাতে বলা হবে। সেটা বাস্তবায়নের কার্যকারিতা শুরু হবে ২৮ জুলাই থেকে। এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অফিসে ২০০ অভিযোগ জমা পড়েছে জানিয়ে কাদের বলেন, এই অভিযোগগুলো নিজ নিজ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের দিয়ে দিচ্ছি। কারণ কোনো অভিযোগ ব্যক্তিগত শত্রুতায় অনেক সময় দিয়ে থাকতে পারে। কাজেই বিষয়গুলো দেখার জন্য তারা দায়িত্ব পালন করবেন ২৭ জুলাই পর্যন্ত। ২৮ তারিখ থেকে আমরা বিভাগীয় টিমের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাস্তবায়নে যাব।
জানা গেছে, পাঁচ ধাপে শেষ হওয়া ৪৭৩টি উপজেলার নির্বাচনে ১৪৯টিতে চেয়ারম্যান পদে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১৪০ জনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে দলের বিদ্রোহী হিসেবে ধরে নেয় দলটি।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৮ বিভাগে আওয়ামী লীগের অভিযুক্ত দুই শতাধিক নেতার মধ্যে রয়েছেন খুলনায় ৪১ জন, রাজশাহীতে ২০, সিলেটে ৩২, রংপুরে ২৬, বরিশালে ১৭, ময়মনসিংহে ২০, ঢাকায় ৪৫ এবং চট্টগ্রামে ১৭ জনের অধিক। এ ছাড়া বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে ৬২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ৮ বিভাগে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শতাধিকেরও বেশি নেতাকর্মী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে।প্রতিদিনের সংবাদ