• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

প্রকৃত খুনি চিহ্নিত হোক, বিচার হোক এ দাবি সকলের

প্রকাশ:  ২৬ জুন ২০১৮, ১২:২০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

গত ৪ জুন সোমবার চাঁদপুরের ইতিহাসে ঘটে গেলো একটি আলোচিত নৃশংসতম হত্যাকা-। এ হত্যাকা-টি আলোচিত এজন্যে যে, যিনি খুন হয়েছেন এবং এ খুনের অভিযোগে সন্দেহভাজন হিসেবে যিনি আটক হয়ে হাজতবাস করছেন উভয়ই চাঁদপুরের সর্বমহলে বেশ পরিচিত। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াসহ সর্বত্র তাঁদের পদচারণা এবং সরব উপস্থিতি ছিলো। আর এই আলোচিত হত্যাকা-টি হচ্ছে অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি হত্যাকা-। আর এ খুনের অভিযোগে সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে ৫ জুন থেকে চাঁদপুর কারাগারে আটক রয়েছেন নিহত ফেন্সির দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী অ্যাডঃ মোঃ জহিরুল ইসলাম। এই আলোচিত ও লোমহর্ষক হত্যাকা-টি নিয়ে গত ৫ জুন থেকে যে আলোচনা, মন্তব্য ও নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ঝড় বইছে, তা নিয়েই এ প্রতিবেদনটি।


অ্যাডঃ জহির ও ফেন্সি দম্পতিকে চিনে না এমন মানুষ চাঁদপুরে হয়তো খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। কারণ, দু'জনই রাজনৈতিক ও পেশাগত জীবনে বেশ পরিচিত। মানুষের মুখে তাঁদের সম্বোধনটি ছিলো 'জহির ভাই' ও 'ফেন্সি আপা' নামে। পারিবারিক ও দাম্পত্যজীবনও ছিলো মোটামুটি সুখের। পেশাগত জীবনেও তাঁরা নিজেদের অবস্থানকে বেশ সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আইন পেশায় নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় ও সুসংহত করেছেন, অপরজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে বেছে নিয়ে নিজেকে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। সর্বশেষ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফরিদগঞ্জের গল্লাক আদর্শ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন শাহিন সুলতানা ফেন্সি। শিক্ষকতা পেশায় তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছেন। যে নারী নির্যাতিতা নারীদের পাশে দাঁড়াতেন, নির্যাতনকারীদের বিচার ও শাস্তির দাবিতে সোচ্চার থাকতেন, সে নারীকেই নৃশংসভাবে খুন হতে হলো, তাও আবার নিজ বাসায় শয়নকক্ষে-এ বিষয়গুলো যখন মানুষ ভাবে তখন যেনো সম্বিত হারিয়ে ফেলে। হঠাৎ এ কোন্ প্রলয়ঙ্করী ঝড় এসে সব তছনছ করে দিলো এ সুখী (?) দম্পতির সংসারকে?

 


অ্যাডঃ জহিরুল ইসলাম চাঁদপুর বারের আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘকাল যাবৎ সুপরিচিত। জেলা আইনজীবী সমিতির একাধিকবারের নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একজন সিনিয়র বিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে জেলা বারে তাঁর বেশ পরিচিতি রয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও তিনি সর্বমহলে আলোচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। তিনি চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের একাধিকবারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানেও এ পদে আসীন আছেন। এর আগে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সময়ের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

 


একেবারে মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকদের সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন কয়েকবার। সর্বশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে দলের জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন। ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সাথেও তাঁর বেশ সুসম্পর্ক রয়েছে। চাঁদপুরে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে কোনো আচার-অনুষ্ঠানে অ্যাডঃ জহিরুল ইসলামের উপস্থিতি প্রায় নিশ্চিত ছিলো। একজন তুখোড় সুবক্তা হওয়ার কারণে তিনি প্রায় অনুষ্ঠানেই বেশ সম্মানের সাথে বক্তৃতার সুযোগ পেতেন। আরেকটি দিকে অ্যাডঃ জহিরের বেশ পরিচিত ছিলো। তা হচ্ছে-তিনি একজন বস্নাড ডোনার। তিনি বহু রোগীকে নিজের শরীর থেকে রক্ত দিয়েছেন। এদিক দিয়ে তাঁর বেশ খ্যাতি ছিলো। নিজের পেশাগত জীবনে সহকর্মী এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও সমর্থকসহ সব মানুষের সাথে তিনি হাসি-ঠাট্টা-দুষ্টামি করতেন। এটা সবারই মুখে মুখে।

 


এতোটা সামাজিক গুণে গুণান্বিত মানুষটা কোনো মানুষকে খুন করতে পারে, তাও আবার ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের প্রিয়তমা স্ত্রীকে, তা মানুষ যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না। যদিও বিষয়টি এখনো সম্পূর্ণ তদন্তাধীন আছে। অ্যাডঃ জহিরসহ অন্য আসামীরা এখনো সন্দেহভাজন হিসেবে আটক আছেন। আবার হত্যাকা-ের ঘটনার আদ্যোপান্ত ও আলামতসহ নানা ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্নজনের কাছে এই সন্দেহ ঘনীভূত হয় যে, অ্যাডঃ জহির ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখা বেগম এ খুনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। থানায় মামলাও দেয়া হয়েছে এ দু'জনকে অভিযুক্ত করে। আবার অ্যাডঃ জহিরের তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে (এক মেয়ে বিদেশে অবস্থানরত) তাদের মায়ের খুনি হিসেবে তাদের বাবা অ্যাডঃ জহির ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী জুলেখাকে দায়ী করেছে। এ বিষয়ে তারা সংবাদ সম্মেলনও করেছে। সচেতন মহলকে বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সন্তানরা একে তো মাকে হারিয়েছে, উপরন্তু মার খুনি হিসেবে বাবাকে দায়ী করে বাবার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই চরম অগি্ন পরীক্ষার মুহূর্তে মেয়েরা বাবার বিরদ্ধে যে অবস্থান নিয়েছে তা না বুঝে-শুনে নেয়নি বলে সচেতন মহলের অনেকে মন্তব্য করেছেন।

 


এদিকে যারা হুটহাট করে মন্তব্য করছেন, অ্যাডঃ জহিরই খুন করেছেন বা খুন করে নাই, তাদের বাইরে ভিন্নমত পোষণকারীদের মন্তব্য একটু গভীরের এবং ভাবনার বিষয়। তারা বলছেন, অ্যাডঃ জহির কী জন্যে বা কোন্ কারণে তার স্ত্রীকে খুন করবেন? তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। এটাই কি তার অপরাধ? দ্বিতীয় বিবাহ করে তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে সন্তানসহ পৃথক ভাড়া বাসায় রেখেছেন। অ্যাডঃ জহিরের মেয়েদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের বাবা জুলেখা বেগম নামে এক বিবাহিতা এবং স্বামী পরিত্যক্তা ২ সন্তানের জননীর সাথে অনুমান চার বছর আগে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত গোপনে জুলেখাকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে করার বিষয়টি জানাজানি হয় এখন থেকে তিনি বছর হয়। মেয়েরা সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যের একটি জায়গায় এও উল্লেখ করেন যে, 'শুনেছি এই মহিলার গর্ভে তখন একটি কন্যা সন্তান আছে। আমার বাবার এই অনৈতিক সম্পর্ক ও পরবর্তীতে বিবাহ করার বিষয়টা আমরা বোনেরা এবং আমার মা কখনোই মেনে নেয়নি।' মেয়েদের এ বক্তব্যের দ্বারা তারা এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে, জুলেখার সাথে তার বাবার বিয়ের আগেই অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক ছিলো এবং বিয়ের সময় জুলেখার গর্ভে একটি সন্তান ছিলো।

 


সচেতন মহলের প্রশ্ন-কোনো সন্তান কি তার বাবার এমন দুশ্চরিত্র তথা অবৈধ সন্তান জন্ম দেয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে লিখিতভাবে আনতে পারে? না কি এটি কারো তৈরি করা গল্প, যেখানে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও অ্যাডঃ জহিরের ছোট মেয়েকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে? এ বিষয়গুলো ভাবনার প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন মহল। তাদের মতে-একটি পক্ষ থেকে শুধুমাত্র অ্যাডঃ জহিরকেই বার বার খুনি বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কি প্রকৃত ঘটনা এবং প্রকৃত খুনকে আড়াল করার জন্যেই? আর যারা অ্যাডঃ জহিরকে বিনা বাক্যালাপে এখনই খুনি বলতে চাচ্ছেন না, তাদের বক্তব্য হচ্ছে-অ্যাডঃ জহির তার স্ত্রীকে কেনো খুন করতে যাবেন? তবে এটা সত্য যে, দ্বিতীয় বিয়ে করা নিয়ে অ্যাডঃ জহির ও ফেন্সির সাথে এবং তাদের সন্তানদের সাথে মারাত্মক গৃহবিবাদ ছিলো। এর থেকে মুক্তির জন্যে অ্যাডঃ জহির বড়জোর তার প্রথম স্ত্রী ফেন্সিকে তালাক দিয়ে দিতে পারতেন। কারণ, অ্যাডঃ জহিরের ষোলঘরস্থ যে বাড়িটি ছিলো এটা তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে ছিলো। জহির দ্বিতীয় বিয়ের পর প্রথম স্ত্রীর আগ্রহেই স্বামী-স্ত্রী দু'জনের সিদ্ধান্তেই পুরো বাড়িটি তাদের তিন মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন তারা দু'জনে মিলে। তাহলে এখানে তো মেয়েদের প্রতি অ্যাডঃ জহিরের ভালোবাসার কোনো ঘাটতি দেখা গেলো না। এমনকি প্রথম স্ত্রী ফেন্সির সিদ্ধান্তেই জহির রাজি হয়ে গেলেন। তাহলে তো দু'জনের মধ্যে বড় ধরনের কোনো কিছু নিয়ে বিরোধ ছিলো না বুঝা যায়। এমতাবস্থায় কোন্ কারণে স্ত্রীকে খুন করতে যাবেন জহির? গৃহবিবাদ যদি চরম আকারে যেতো তাহলে তো তিনি ফেন্সিকে তালাক দিয়ে সে বাসা থেকে চলে আসতে পারতেন। কারণ, এ বাসার মালিকানার কোনো অংশ তো আর অ্যাডঃ জহিরের নেই। প্রথম স্ত্রীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে বাসা থেকে চলে আসতে তো তার কোনো বাধা ছিলো না। সব পথ বাদ দিয়ে অ্যাডঃ জহির স্ত্রীকে খুনের পথ বেছে নিবেন তা তো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। আর অ্যাডঃ জহিরের মেয়েদের এবং তাদের মামাদের ভাষ্যমতে-অধ্যক্ষ ফেন্সিকে অ্যাডঃ জহির যদি অমানুষিক নির্যাতনই করে থাকতেন তাহলে তিনি (ফেন্সি) সে বাসায় রইলেন কেনো অথবা অ্যাডঃ জহিরকে সে বাসায় থাকতে দিলেন কেনো? ফেন্সি তো অ্যাডঃ জহিরকে সে বাসা থেকে বের করে দিলে জহিরের কিছুই করার ছিলো না। কারণ, এ বাড়ি তো এখন তাদের না। সচেতন মহলের বক্তব্য হচ্ছে-এ হত্যাকা-ের পেছনে অ্যাডঃ জহিরের দ্বিতীয় স্ত্রীর এবং তার পরিবারের কোনো হাত আছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার এবং এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিয়ে অধিকতর তদন্ত হওয়া দরকার।

 


আবার কেউ বলছেন, অধ্যক্ষ শাহিন সুলতানা ফেন্সি খুব রাগী এবং বদমেজাজী ছিলেন। তিনি তাঁর স্বামীর সাথে খুব রূঢ় আচরণ করতেন। অ্যাডঃ জহিরও হয়তো মাঝে মধ্যে প্রতিউত্তর দিতেন। সেদিনে (৪ জুন) হয়তো দুজনের মধ্যে উত্তেজনাবশত খুব বেশি রাগারাগি হয়েছে। যার কারণে অ্যাডঃ জহির হয়তো নিজেকে সামলাতে না পেরে মাথায় প্রচ-ভাবে আঘাত করে জেদ করে ঘর থেকে বের হয়ে যান। এদিক দিয়ে অধ্যক্ষ ফেন্সির মাথা ফেটে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হতে হতে একসময় তার শরীর নিথর হয়ে যায়। আর মাথায় প্রচ- আঘাতজনিত কারণে হয়তো তিনি তখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থাতেই তার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে হতে একসময় মৃত্যু ঘটে। আর অ্যাডঃ জহির এশা-তারাবীহ শেষ করে বাসায় ঢুকে যখন দেখলেন তার স্ত্রী রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে পড়ে আছেন, তার দেহ নিথর, তখন হয়তো তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। 'অ্যাডঃ জহির তার ভাইসহ পরিবারের সদস্য এবং আইনজীবীদের কেনো প্রথম খবর দিলেন' এমন প্রশ্নের জবাবে এই পক্ষ বলছে, তিনি যে জেদের বশে তার স্ত্রীর মাথায় আঘাত (হয়তবা) করে গেছেন, এ অপরাধবোধ তো তখন তার মধ্যে কাজ করছিল। আর সেজন্যেই তিনি নিজেকে সেফ করতে তার আত্মীয়স্বজনকে এবং সহকর্মীদের ডেকেছেন।

 


সর্বোপরি সচেতন সকল মহলের বক্তব্য হচ্ছে-বিষয়টি যেহেতু এখনো তদন্তাধীন, তাই কোনো পক্ষ থেকে কাউকে জোর করে দোষী বানানো উচিত হবে না। আর এটি যে একটি নৃশংস হত্যাকা- তা সন্দেহাতীত। তাই আমরা চাচ্ছি, কোনো রাগ-অনুরাগ বা আবেগের বশবর্তী না হয়ে সঠিক তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসুক এবং আসল খুনি ধরা পড়ুক ও বিচার হোক। কোনো ধরনের অশুভ তৎপরতায় যেনো মূল হোতা এবং এর নেপথ্যে যারা রয়েছে তারা যেনো নিষ্কৃতি না পায়।

 

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ

সর্বাধিক পঠিত