‘স্বর্ণা ডেথ গেমসে ঢুকে পড়েছিল’
এখনো খোলা রয়েছে আত্মঘাতী মেধাবী কিশোরী অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার মোবাইল ফোন। শুক্রবার মধ্যরাতেও কল এসেছিল স্বর্ণার মোবাইলে। একটি দু’টি নয়। পর পর পাঁচটি। ফোন রিসিভ করেন স্বর্ণার মা সানি চৌধুরী ওরফে সানি বর্ধন। কলকারীরা সবাই পরিচয় দিয়েছে তারা স্বর্ণার ফেসবুক ফ্রেন্ড। শনিবার এ তথ্য জানিয়ে স্বর্ণার বাবা অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্ধন বলেন, স্বর্ণার ফেসবুক বন্ধু পরিচয় দিয়ে একজন জানিয়েছে, ‘স্বর্ণা তো ডেথ গেমসে ঢুকে পড়েছিল’। মেয়ের ফেসবুক বন্ধু এমন তথ্য দেয়ার পর তার বিস্তারিত পরিচয় জানতে চাইলেই কেটে দেয়া হয় সংযোগ।
এনড্রয়েড মোবাইল ব্যবহারের পাশাপাশি মৃত্যুর আগে তার নানা আচরণ এবং আত্মহত্যার আলামতে সে ব্লু হোয়েলের শিকার হওয়ার ধারণা বদ্ধমূল স্বর্ণার বাবা সুব্রতের। কিন্তু ব্লু হোয়েলের শিকার হয়ে এক মেধাবী কিশোরীর আত্মহত্যার তৃতীয় দিনেও এ বিষয়ে অন্ধকারে পুলিশ। তবে স্বর্ণার মৃত্যুর দ্বিতীয় দিনে ব্লু হোয়েল নিয়ে লেখালেখি শুরু হওয়ার পর বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন নিউ মার্কেট থানার ওসি মো. আতিকুর রহমান ও সুরতহাল সম্পাদনকারী এসআই আল মাহমুদ।
গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর নিউ মার্কেট থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাট থেকে স্বর্ণার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার কয়েকঘণ্টা আগে মধ্যরাতে সুকৌশলে তার কক্ষ থেকে ঘুমন্ত পিতাকে জাগিয়ে অন্য কক্ষে সরিয়ে দেয়। এরপর গলায় নাইলনের ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে সে। তার আগেই বড় হরফে ‘আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়’ বলে চিরকূট লিখে গেছে। তার নিচে এঁকেছে হাসির চিহ্ন। এরপর থেকে তার ব্লু হোয়েলের শিকার হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু তার আত্মহত্যার বিষয়ে এখনো ওয়াকিবহাল নয় পুলিশ। থানা পুলিশ সুরতহালের পর পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করে। এরপর গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পোস্তাগোলা শশ্মানে মৃতদেহের সৎকার হয়েছে।
পুলিশ প্রাথমিকভাবে তার আত্মহত্যার কোনো ক্লু খুঁজে না পাওয়ায় তার মোবাইল ফোন খোলা রাখার পরামর্শ দেয়। মোবাইলে ফোন বা এসএমএসে কোনো ক্লু পাওয়া যায় কিনা তা অনুসন্ধানের পরামর্শও দেয়া হয়। স্বর্ণার পিতা সুব্রতও তা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এরই মধ্যে তার আত্মহত্যার দ্বিতীয় বা গত শুক্রবার মধ্যরাতে তার মোবাইলে পর পর পাঁচটি ফোন কল আসে। তার মা মোবাইল রিসিভ করলে তারা ওপার থেকে নিজেদের ফেসবুক ফ্রেন্ড পরিচয় দিয়ে তাকে ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন জানতে চায়। কিন্তু প্রতিবারই তার মায়ের সব কথার জবাব দেয়ার আগেই মোবাইল সংযোগ কেটে দেয়া হয়। এরই মধ্যে এক ফোন কল থেকে আসে স্বর্ণার ব্লু হোয়েলে ঢুকে পড়ার ইঙ্গিত। একজন ফেসবুক বন্ধু স্বর্ণার মাকে বলেন, ‘স্বর্ণা তো একটি ডেথ গেমসে ঢুকে পড়েছিল। সে আমাদের বলেছিল, আমি যদি হঠাৎ মারা যাই। তোরা কী আমাকে দেখতে যাবি?’
স্বর্ণার বাবা সুব্রত বর্ধন বলেন, আমার আদরের মেয়ে ব্লু হোয়েলের ফাঁদে পড়ে গলায় ফাঁস নেয়ার নানা আলামত পাচ্ছি। গতরাতে মোবাইলে এক কলে তার মায়ের কাছে সে ব্লু হোয়েলে ঢুকে পড়ার বিষয়ে জানানো হয়। তিনি আর কাউকে কৌতূহলের বশেও ব্লু হোয়েলে না ঢুকার অনুরোধ জানান।
নিউ মার্কেট থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, সে ডেথ গেমস ব্লু হোয়েলে ঢুকে আত্মহত্যা করেছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। যদিও মিডিয়ায় ব্লু হোয়েলের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে বলা হচ্ছে।
স্বর্ণার লাশের সুরতহাল সম্পাদনকারী নিউ মার্কেট থানার এসআই আল মাহমুদ বলেন, ব্লু হোয়েলের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। আজ (গতকাল শনিবার) থেকে শুনছি ব্লু হোয়েল গেমসের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। আরো অনেকে নাকি এর শিকার হয়েছে। স্বর্ণার গলায় ফাঁসের চিহ্ন পাওয়া গেলেও শরীরে অন্য কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটির সূচনা ২০১৩ সালে, রাশিয়ায়। গেমটির সূত্রপাত ঘটে ‘ভিকোন্তাকে’ নামের সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, যার পরিচালক ছিল ‘এফ৫৭’। এফ৫৭ মূলত ‘ডেথ গ্রুপ’ নামে পরিচিত। ২০১৫ সালে গেমটির জের ধরে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
সাধারণভাবে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটিতে অংশগ্রহণকারীকে প্রতিদিন কে কোন লেভেলে আছে তা পোস্ট করে কিউরেটরকে জানাতে হয়। এ নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আতঙ্কের বিষয় হলো ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি একবার ডাউনলোড করার পর তা আর সহজে আনইন্সটল করা যায় না। আর মুহুর্মুহু আসা নোটিফিকেশন অংশগ্রহণকারীকে বাধ্য করে গেমটিতে কী চলছে বা পেজটিতে কী হচ্ছে তা একবার ঢুঁ মেরে দেখে আসার। প্রতিটি টাস্ক কমপ্লিট করে তার ছবি গেমিং পেজটিতে আপলোড করার নিয়মও রয়েছে। কাজেই সমবয়সী অন্যান্য তরুণ-তরুণীদের গেমটিতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দেখে স্বভাবতই বাকিরাও তাতে অ্যাকটিভ হওয়ার একটি তাড়না অনুভব করেন। এভাবেই একের পর এক তরুণ-তরুণী যুক্ত হয় আত্মঘাতী এই গেমটির সঙ্গে।
গেমটির উদ্ভাবক ফিলিপ বুদেকিন। বুদেকিন সাইকোলজির ছাত্র ছিল। তবে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। রাশিয়ান এই গেম ডেভেলপার তার ভিক্টিমদের ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েস্ট’ বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে দাবি করেন, তিনি সমাজকে আবর্জনামুক্ত করছেন।