উত্তর কোরিয়া দিয়ে শান্তিতে নোবেল পেতে চান ট্রাম্প
তিনবার উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠক করে (যা খুবই সাড়া ফেলেছিল) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো বিশ্বাস করেন যে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এই দেশে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের কাজ চলছে। যদি তা হয়, তবে সম্ভবত তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি উত্তর কোরিয়াকে ঘন ঘন ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো এবং এর অস্ত্রগুলোর উৎকর্ষ বিধান করার অনুমতি দিয়েছেন।
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গত সপ্তাহে আবারও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া, কিন্তু এ ব্যাপারে কড়া কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি ট্রাম্পের পক্ষ থেকে; বরং এসব ক্ষেপণাস্ত্র বেশ মানসম্মত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। একটি টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘এ পরীক্ষার মাধ্যমে জাতিসংঘের নিয়ম ভাঙলেও মনে হয় না কিম আমার বিশ্বাস ভাঙতে চাইবেন। আমার ধারণা, দেশকে নিয়ে কিমের সুন্দর কিছু পরিকল্পনা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শুধু আমারই ক্ষমতা আছে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার। ফলে আমাকে হতাশ করার মতো কোনো কাজ তারা করবে না। কাজটি করলে অনেক কিছু হারাতে হবে তাদের।’
যে কেউ অনুমান করতে পারেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের উত্তর কোরিয়ার নীতিটি আগামী এক বছরে কেমন হবে। তবে আপাতত মনে হচ্ছে উভয় পক্ষ যা চায়, তা–ই আছে। ট্রাম্প ২০২০ সালের নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এমন একটি ঢিলেঢালা অচলাবস্থা চাইছেন এবং কিম তাঁর পারমাণবিক পরীক্ষাগুলো বন্ধ করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়া বন্ধ রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কিমের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকগুলোতে ‘বন্ধের বিনিময়ে বন্ধ’ করার ব্যবস্থায় যাওয়া উচিত হয়নি, এই ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার জোটকে দুর্বল করে দিয়েছে। ২০১৮ সালের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে কিমের সঙ্গে প্রথম বৈঠক করার সময় ট্রাম্প কেবল তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে মার্কিন নীতি ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন।
নিউইয়র্কের আবাসন ব্যবসায়ীদের মতো চিন্তাভাবনা করে ট্রাম্প ধরে নিয়েছিলেন যে উত্তর কোরিয়া অর্থনৈতিক স্বস্তি চায়। তবে উত্তর কোরিয়া কেন প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল, সে ব্যাপারে ট্রাম্প কিমের ব্যাখ্যা মনোযোগসহকারে শুনেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলা থেকে বিরত রাখতে এটা তিনি করেছিলেন এবং এ কারণেই সিঙ্গাপুর বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রকাশ্যে ‘ব্যয়বহুল’ যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক মহড়ার পরিমাণ হ্রাস করার কথা ঘোষণা করেছিলেন, যেখানে তিনি কিমের নিজস্ব ‘ওয়ার গেমস’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। যৌথ সামরিক মহড়া বন্ধ ঘোষণা করে এবং তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও শান্তিচুক্তির আলোচনার জন্য সর্বদা প্রস্তুত—এ রকম উল্লেখ করে ট্রাম্প ধরে নিয়েছিলেন যে তিনি উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘস্থায়ী আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন।
এরপর ১৫ মাস কেটে গেছে এবং উত্তর কোরিয়ার সরকার এখনো পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে আগ্রহী নয়। ট্রাম্পের টিম উত্তর কোরিয়ায় ট্রাম্পের নীতির আসন্ন ব্যর্থতার বিষয়টি জানে, তবে এটা স্বীকার করতে নারাজ যে তাদের প্রিয় নেতা এ জন্য দায়ী। উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি স্টিভ বিগুন এখনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে ব্যস্ত রয়েছেন। তবে তিনি ট্রাম্পের কাছ থেকে কোনো সমর্থন পাচ্ছেন বলে মনে হয় না।
স্টিভ বিগুন বা পম্পেও মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার উচিত জরুরি ভিত্তিতে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করা। তবে ট্রাম্প উত্তর কোরীয়দের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে বলেছেন, এটা করার জন্য প্রচুর সময় রয়েছে। ট্রাম্প এভাবে উত্তর কোরিয়ার আস্থা অর্জন করতে চাইছেন। আসলে ট্রাম্পের কেবল দরকার কিমের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক বজায় রাখা, যাতে করে তিনি পরে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতে পারেন। অনেকেই মনে করেন, কিম সম্ভবত কখনোই তাঁর সব পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করবেন না। তবে তিনি এমন কিছু করতে পারেন, যাতে প্রতিবেশীরা ও যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে কম হুমকি মনে করে।
কিম সরকারের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি আচরণ ট্রাম্পের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা যেতে পারে। যদি তা হয়, তবে বার্তাটি পরিষ্কার: আপনি যদি আমাদের আশ্বস্ত না করেন, তবে আমরা ২০২০ সালের নভেম্বরের আগেই আপনার জন্য সমস্যা তৈরি করব।
ট্রাম্প হয়তো বিশ্বকে এটা ভাবাতে চান যে তিনি উত্তর কোরিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কৌশলগত ধৈর্য বজায় রাখছেন। তবে এ কৌশল ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করবে কি না, তা এখন দেখার বিষয়।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ক্রিস্টোফার আর হিল: পূর্ব এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী