মোদির দ্বিতীয় মেয়াদের মন্ত্রিসভা: পরীক্ষিত সহযোদ্ধা ও নতুনদেরই প্রাধান্য
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার দ্বিতীয় মেয়াদের মন্ত্রিসভায় পরীক্ষিত সহযোদ্ধা ও নতুনদের প্রাধান্য দিয়েছেন। এবার মোদি তার দীর্ঘদিনের সহচর ও ঘনিষ্ঠজন বিজেপি সভাপতি অমিত অনিলচন্দ্র শাহকে মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছেন।এছাড়া সাবেক আমলা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রীদের ওপর তিনি ভরসা রাখছেন। এ মন্ত্রিসভা যেন আগের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। মন্ত্রিসভায় সাবেক আমলা, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও নতুনদের ওপর মোদি ভরসা রাখছেন। শপথের পর শুক্রবার রাতে এক টুইটে মোদি নিজের নতুন দলকে ‘টিম ২.০’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, তার দল ‘তরুণদের শক্তি ও প্রশাসনিকভাবে অভিজ্ঞদের মিশেল।’ এবার প্রধানমন্ত্রী বাদে ৫৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায় ২৪ জন পূর্ণমন্ত্রী, ২৪ জন প্রতিমন্ত্রী এবং ৯ জন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন। মন্ত্রিসভায় নারী সদস্যের সংখ্যা ছয়জন। আর নতুন মুখ ১৯ জন। এবার মন্ত্রিসভায় একগুচ্ছ আনকোরা নতুন মুখ এনে নরেন্দ্র মোদি চমক দিয়েছেন। খবর আনন্দবাজার পত্রিকা, এনডিটিভি ও হিন্দুস্থান টাইমসের।
শুক্রবার মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টন করা হয়। এবারের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার দৌড়ে বাজিমাত করেছে উত্তরপ্রদেশ। এ রাজ্য থেকে ১০ জন জায়গা পেয়েছেন। এরপরই রয়েছে মহারাষ্ট্র ও বিহার। ওই দুই রাজ্য থেকে সাতজন করে মন্ত্রী হয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির চমকপ্রদ উত্থান সত্ত্বেও মাত্র দু’জনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। আসানসোল থেকে জয়ী বাবুল সুপ্রিয় এবং রায়গঞ্জ থেকে জয়ী দেবশ্রী চৌধুরী প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। তবে মিজোরাম, সিকিম, ত্রিপুরা ও অন্ধ্রপ্রদেশের কোনো সাংসদকে এবার মন্ত্রী করা হয়নি। আবার কেরালা রাজ্য থেকে বিজেপি কোনো আসন না পেলেও সেখানকার এক বিজেপি নেতাকে মন্ত্রী করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অমিত শাহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে গতবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী রাজনাথ সিংকে বেছে নিয়েছেন। গতবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা নির্মলা সীতারমন এবার অর্থ মন্ত্রণালয় পেয়েছেন। ভারতের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী (স্বতন্ত্র) নির্মলা দেশটির প্রথম নারী প্রতিরক্ষামন্ত্রীও ছিলেন। প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় জায়গা পাওয়া কূটনীতিক এস জয়শঙ্কর পেয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আমেথিতে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে পুরস্কার পেয়েছেন স্মৃতি ইরানি (নারী ও শিশু উন্নয়ন)। আগেরবার তিনি বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। মোদি মহাকাশ পারমাণবিক শক্তি নিজ হাতে রেখেছেন। গতবারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী বাদ পড়েছেন।
মন্ত্রিসভায় নতুন মুখ যারা : উত্তরাখণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশাঙ্ক (মানবসম্পদ উন্নয়ন), ঝাড়খণ্ডের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডা (আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়), কর্নাটকের বিজেপি নেতা ও আরএসএস ঘনিষ্ঠ প্রহ্লাদ যোশী (সংসদবিষয়ক ও কয়লা মন্ত্রণালয়), সরকারি চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসা শিবসেনা নেতা অরবিন্দ সাওয়ান্ত (ভারি শিল্প মন্ত্রণালয়), তেলঙ্গানার বিজেপির সভাপতি জি কিষান রেড্ডি (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), হিমাচল প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রেমকুমার ধুমলের ছেলে অনুরাগ সিং ঠাকুর (অর্থ প্রতিমন্ত্রী), ছত্তীশগড়ের সাংসদ রেণুকা সিংহ সারুতা (আদিবাসী বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী), হরিয়ানার সাংসদ রতনলাল কাটারিয়া (জলসম্পদ, সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী), চারবারের সাংসদ ও কর্নাটকের অন্যতম নেতা সুরেশ চান্নাবাসাপ্পা (রেল মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী), আমলা থেকে সরাসরি মন্ত্রিত্বে পাওয়া পাঞ্জাবের সোম প্রকাশ (বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী), মহারাষ্ট্রের আকোলার সঞ্জয় সামরাও ধোত্রে (মানবসম্পদ, তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী), কমিউনিস্ট দল থেকে বিজেপির ছাত্র সংগঠনে আসা কেরালার সাংসদ ভি মুরলিধরন (পররাষ্ট্র, সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী), রাজস্থানের সাংসদ কৈলাশ চৌধুরী (কৃষি ও কৃষক উন্নয়ন), ওড়িশার (বালেশ্বর) খড়ের চালের বাড়ি থেকে উঠে আসা প্রতাপ চন্দ্র সারেঙ্গি (প্রাণিসম্পদ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিমন্ত্রী), বিহারের হাজিপুরের সাংসদ নিত্যানন্দ রাই (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) ও আসামের রামেশ্বর তেলি (খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রতিমন্ত্রী)।
আবার যারা দায়িত্ব পেলেন (পূর্ণমন্ত্রী) : পীযূষ গোয়েল (রেলমন্ত্রী), প্রকাশ জাভড়েকর (তথ্য ও সম্প্রচার), রাম বিলাস পাসওয়ান (খাদ্য), নিতিন গড়করি (সড়ক ও পরিবহনমন্ত্রী), রবিশংকর প্রসাদ (আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি), ডিভি সদানন্দ গৌড়া (রাসায়নিক ও সার), রামবিলাস পাসোয়ান (খাদ্য, উপভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয়), নরেন্দ্র সিং তোমার (কৃষি, গ্রামোন্নয়ন, পঞ্চায়েত), হরসিমরত কউর বাদল (খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ), তাওয়ারচাঁদ গেহলোত (সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন), হর্ষবর্ধন (স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি), ধর্মেন্দ্র প্রধান (পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস, ইস্পাত), মুখতার আব্বাস নকভি (সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়), মহেন্দ্রনাথ পাণ্ডে (দক্ষতা উন্নয়ন), গিরিরাজ সিং (প্রাণিসম্পদ), গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত (জলসম্পদ)।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আবার যারা দায়িত্ব পেলেন : সন্তোষ কুমার গাঙ্গোয়ার (শ্রম), ইন্দ্রজিৎ সিং (পরিসংখ্যান), শ্রীপদ নায়েক (প্রতিরক্ষা, আয়ুর্বেদ), জীতেন্দ্র সিং (প্রধানমন্ত্রীর দফতর, উত্তর-পূর্বের রাজ্যের উন্নয়ন), আর কে সিং (বিদ্যুৎ, দক্ষতা উন্নয়ন), কিরেণ রিজিজু (সংখ্যালঘু বিষয়ক, যুব ও ক্রীড়া), প্রহ্লাদ সিং প্যাটেল (সংস্কৃত মন্ত্রণালয়, পর্যটন), হরদীপ সিং পুরী (নগরোন্নয়ন ও আবাসন, অসামরিক বিমান পরিবহন, বাণিজ্য), মনসুখ মান্ডভিয়া (জাহাজ, রাসায়নিক ও সার)। এছাড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন- ফগন সিং কুলস্তে (ইস্পাত), অশ্বিনী কুমার চৌবে (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ), অর্জুন রাম মেঘওয়াল (সংসদবিষয়ক, ভারি শিল্প, ইস্পাত), ভি কে সিং (সড়ক ও পরিবহন), কৃষ্ণপাল গুর্জর (সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন), রাওসাহেব দানবে (উপভোক্তা বিষয়ক, খাদ্য), পুরুষোত্তম রূপালা (কৃষি উন্নয়ন), রামদাস আঠাওয়ালে (সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন), সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতি (গ্রামীণ উন্নয়ন), বাবুল সুপ্রিয় (পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়), সঞ্জীব কুমার (প্রাণিসম্পদ)।
যারা জায়গা পেলেন না : অসুস্থতার কারণে সাবেক অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবার মন্ত্রী হতে রাজি হননি। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ শারীরিক কারণে নির্বাচন করেননি, মন্ত্রিত্বও নেননি। বাদপড়াদের তালিকায় রয়েছেন- উমাভারতী (জলসম্পদ, নদী উন্নয়ন), সুরেশ প্রভু (শিল্প ও বাণিজ্য এবং অসামরিক বিমান পরিবহন), মেনকা গান্ধী (নারী ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী), শিবপ্রতাপ শুক্ল (অর্থ প্রতিমন্ত্রী), জুয়েল ওরাঁও (আদিবাসী সংক্রান্ত দফতর), সাবেক অলিম্পিয়ান রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর (তথ্য ও সম্প্রচার), জে পি নাড্ডা (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী), অনুপ্রিয়া প্যাটেল (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী), কে জে আলফন্সের (সংস্কৃতি ও পর্যটন দফতরের প্রতিমন্ত্রী), এস অহলুওয়ালিয়ার (পানীয়জল ও নিকাশি দফতর), রাধামোহন সিংহ (কৃষি), চৌধুরী বীরেন্দ্র সিংহ (গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত দফতর), বিজয় সাম্পলা (সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী), শিবসেনা নেতা অনন্ত গীত (ভারি শিল্প ও পাবলিক এন্টারপ্রাইজ), সুভাষ ভামর (প্রতিরক্ষা দফতর প্রতিমন্ত্রী), সাবেক বিজেপি নেতা যশবন্ত সিনহার ছেলে জয়ন্ত সিনহা (অসামরিক বিমান পরিবহন), মহেশ শর্মা (সংস্কৃতি দফতর প্রতিমন্ত্রী)।
মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে বেশি সদস্য উত্তরপ্রদেশের : এবারের মন্ত্রিসভায় বাজিমাত করেছে উত্তরপ্রদেশ। এ রাজ্য থেকে জায়গা পেয়েছেন ১০ জন। এর ৮০টি আসনের মধ্যে এবার ৬২টি দখল করেছে বিজেপি। বারানসি আসনে জয়ী নরেন্দ্র মোদি ছাড়াও এ রাজ্য থেকে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন রাজনাথ সিংহ, স্মৃতি ইরানি, ভি কে সিংহ, সন্তোষ গাঙ্গোয়ারসহ একাধিক পরিচিত মুখ। এবার মোদি ঝড় ওঠে গুজরাট, হরিয়ানা ও রাজস্থানেও। গুজরাটে ২৬টি ও হরিয়ানায় ১০টি আসনের মধ্যে সবক’টিই দখল করেছে বিজেপি। অন্যদিকে রাজস্থানের ২৫টির মধ্যে ২৪টিতে জিতেছে বিজেপি। এবার এ দুই রাজ্য থেকে তিনজন করে সাংসদ মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন।
২৩ মে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। ৫৪২ আসনের লোকসভায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ৩৫২ আসন পায়। বিজেপি পায় ৩০৩টি আসন। ভোটের শতাংশ হার এবং আসন উভয় ক্ষেত্রেই ২০১৪ সালের চেয়ে এগিয়ে এবার সরকার গঠন করল মোদি।যুগান্তর