চীন আর আমেরিকার মধ্যে কি যুদ্ধ বেধে যাবে?
কিছুদিন আগেও চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে কোন উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখা হতো না। মনে করা হতো যে তাদের বিকাশমান অর্থনীতি ক্রমশ:ই উদার-হতে-থাকা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলবে।
মার্কিন বিশেষজ্ঞরা সে সময় বলতেন, "চীন একটি দায়িত্বশীল বৈশ্বিক অংশীদার হয়ে উঠছে।" কিন্তু সে দিন আর নেই।
বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস লিখছেন, চীনকে এখন দেখা হচ্ছে এক হুমকি হিসেবে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন যে চীন আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেভাবে বাড়ছে তাতে শেষ পর্যন্ত একটা যুদ্ধ বেধে যেতে পারে । তা যদি হয়, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া হবে বিশ্বব্যাপী।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম এ্যালিসন এ নিয়ে একটি বই লিখেছেন - যা এখন নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকদের অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠেছে।
বইটির নাম, 'ডেস্টিনড ফর ওয়ার: ক্যান আমেরিকা এ্যান্ড চায়না এ্যাভয়েড দ্য থুসিডিডেস ট্র্যাপ?' এতে তিনি প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক 'থুসিডিডেসের ফাঁদ' নামে এক তত্বের অবতারণা করেছেন, যাতে বলা হয়েছে - কিভাবে একটি উদীয়মান শক্তি হুমকি হয়ে ওঠে একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তির জন্য।
অধ্যাপক এ্যালিসন বলছেন, বিশ্বের ইতিহাসে এরকম ১৬টি উদাহরণ আছে - তার মধ্যে ১২টিই শেষ পর্যন্ত শেষ হয়েছে যুদ্ধে।
প্রাচীন গ্রীসে যেমন এথেন্স চ্যালেঞ্জ করেছিল স্পার্টা-কে, উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানি যেমন চ্যালেঞ্জ করেছিল ব্রিটেনকে, ঠিক তেমনি এ যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে চীনের উত্থান।
অধ্যাপক এ্যালিসন বলছেন, ওয়াশিংটন আর বেইজিংএর দ্বন্দ্ব হচ্ছে আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নির্ণায়ক ঘটনা।
অবশ্য সবাই যে এর সাথে একমত তা নয়। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং নৌ-যুদ্ধকৌশল বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হু বো বলছেন, চীন মার্কিন দ্বন্দ্বের সাথে থুসিডিডেসের ফাঁদের মিল নেই।
তিনি বলেন, "চীনের উত্থান চোখে পড়ার মতো ঠিকই, কিন্তু এখনো সার্বিকভাবে তাদের শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুলনীয় নয়। আমেরিকার সাথে চীন পাল্লা দিতে পারে শুধু একটি মাত্র জায়গায় - তা হলো পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।
কিন্তু এই প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাতেও কি চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব হঠাৎ যুদ্ধের রূপ নিতে পারে না?
এ প্রশ্নের জবাবে মার্কিন নৌযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ এন্ড্রু এরিকসন বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চীন যে সমরসজ্জা করছে তা ঐতিহাসিক মাপেও বিশাল।
চীন এমন সব বিশাল ও উন্নত প্রযুক্তি সমৃদ্ধ যুদ্ধজাহাজ তৈরি করছে - যা মানের দিক থেকে পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজের কাছাকাছি।
ওই অঞ্চলে চীন ক্রমশই আরো বেশি করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তারা যদি তাইওয়ানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ যেন ঠেকিয়ে রাখা যায় - সে চেষ্টাই করছে বেইজিং।
আর যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এখানে কোনভাবেই যেন তার প্রবেশাধিকার ব্যবহত না হয়।
বৈশ্বিক অঙ্গনের চীনের অবস্থানকে আরো উচ্চাভিলাষী করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভুমিকার রাখছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
অনেকে বলেন, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হয়তো এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধও শুরু হতে পারে। তবে এ যুগে তার কেন্দ্রে থাকবে প্রযুক্তিগত প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা।
চীনা টেলিযোগাযোগ কোম্পানি হুয়াওয়ের ঘটনাবলী এ ক্ষেত্রে সবার নজর কেড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কোন ভবিষ্যত যোগাযোগ নেটওয়ার্কে এ কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিচ্ছে না, তার মিত্রদেরকেও বলা হচ্ছে একই পদক্ষেপ নেবার জন্য।
কারণ মেধাস্বত্ব চুরি, ইরানের সাথে বাণিজ্য এবং গুপ্তচরবৃত্তি - একাধিক কারণে চীনা প্রযুক্তিকে উদ্বেগের সাথে দেখা হচ্ছে।
তারা ভয় পাচ্ছে যে, চীন হয়তো শিগগীরই এমন সব প্রযুক্তিতে নেতৃস্থানীয় ভুমিকা নিয়ে নিতে পারে - যার ওপর ভবিষ্যতের উন্নয়ন নির্ভর করবে।
কারণ আগামি দশকেই চীন একটা বৈশ্বিক ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে চায়। তবে চীনের যদি অর্থনৈতিক উন্নতি অব্যাহত থাকে তাহলেই এটা সম্ভব হবে।
কিন্তু চীন যেহেতু স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো ধরে রেখেছে, এবং বাজার সংস্কারকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাই হয়তো উন্নয়নের গতিও হোঁচট খেতে শুরু করেছে। উন্নয়নের গতি শ্লথ হয়ে পড়লে চীনে কি হবে?
অনেকে বলেন শি জিনপিং হয়তো তখন তার উচ্চাভিলাষ কমিয়ে আনবেন, অথবা তার অভ্যন্তরীণ বৈধতায় আঘাত লাগলে তিনি জাতীয়তাবাদ উস্কে দিতে পারেন। কিন্তু যাই ঘটুক, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দ্বন্দ্ব থেকেই যাবে।
এক্ষেত্রে কৌশলগত হিসেবে হঠাৎ কোন ভুলের বিপদ সবসময়ই আছে। কারণ এ উত্তেজনা নিরসন কি ভাবে করা হবে - তা তো কোন বইয়ে লেখা নেই।
চীন-মার্কিন সম্পর্ক এখন একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। হয় তারা পরস্পরের উদ্বেগ কাটাতে চেষ্টা করবে, নয়তো তাদের দ্বন্দ্ব আরো বাড়বে।
তবে যুদ্ধ অবধারিত নয়, বলেন অধ্যাপক এ্যালিসন। তার কথা, তার বইতে তিনি কূটনীতির কথাই বলছেন, নিয়তির কথা নয়। বিবিসি