অবৈধ বিদেশী খুঁজতে আসামের পর এবার টার্গেট কি পশ্চিমবঙ্গ?
ভারতের আসামে জাতীয় নাগরিক তালিকা বা এনআরসি প্রকাশ নিয়ে তুলকালামের মধ্যেই বিজেপি দাবি তুলেছে পশ্চিমবঙ্গেও 'অবৈধ বিদেশি'দের শনাক্ত করতে একই পথ নিতে হবে।
এই প্রস্তাব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন খোদ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ্, আর তারপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করে তিনি বলে এসেছেন, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি করার চেষ্টা হলে তার ফল ভাল হবে না। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের মতোই সিপিএমও এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করছে।
কিন্তু কেন আসামের পর পশ্চিমবঙ্গেও এই দাবি উঠছে, আর ওই রাজ্যে তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনাই বা কতটুকু?
আসলে পশ্চিমবঙ্গে অবৈধ বিদেশিদের চিহ্নিত করা হোক, বিজেপির এই দাবি দীর্ঘদিনের।
কিন্তু আসামে এনআরসি নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই তাদের পশ্চিমবঙ্গ শাখা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে, বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে সে রাজ্যেও জাতীয় নাগরিক তালিকা তৈরি করা হবে।
দিল্লিতে বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ পর্যন্ত বলেছেন, আসামের প্রক্রিয়া মিটলে সবার সঙ্গে আলোচনাক্রমে পশ্চিমবঙ্গেও একই জিনিস করার কথা ভাবা যেতে পারে।
আর পশ্চিমবঙ্গে দলের মহিলা শাখার নেত্রী লকেট চ্যাটার্জি মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি যে নীতি নিয়ে চলছেন তাতে ওই রাজ্যেও এনআরসি ছাড়া গতি নেই।
মিস চ্যাটার্জি বিবিসিকে বলছিলেন, "আমরা পশ্চিমবঙ্গে ভীষণভাবে এনআরসি চাই! অবৈধ বিদেশির সংখ্যা আমাদের রাজ্যে আসামের চেয়েও অনেক বেশি - সম্ভবত দেড় কি দুকোটি হবে। অবৈধ বিদেশি তো আমাদের চারিদিকে, তার ওপর আবার রোহিঙ্গাদের ঢুকিয়েছে!
"সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখবেন ভেবে পশ্চিমবঙ্গবাসী যে মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতায় বসিয়েছে - তিনি সেই সুরক্ষার কথা না-ভেবে ভোটের জন্য আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন!"
"আসলে আগুনটা যে তার ভোটবাক্সে লেগেছে, সেটা পরিষ্কার। আসামে অবৈধ বিদেশিদের বিদায়ঘন্টা বাজছে দেখে তার আসলে অস্বস্তি শুরু হয়ে গেছে যে পশ্চিমবঙ্গেও এ জিনিস হলে তার ভোটব্যাঙ্কের তো বারোটা বেজে যাবে!", বলছিলেন মিস চ্যাটার্জি।
বিজেপি এরকম একটা দাবি তুলছে, এদিকে দিল্লিতে এ কথা জানার পরই প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরিয়ে তিনি পরিষ্কার ঘোষণা করেন, পশ্চিমবঙ্গে কী হবে সেটা ঠিক করার কোনও এক্তিয়ার বিজেপির নেই।
তিনি জানিয়ে দেন, "পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছুতেই এনআরসি-র মতো তার ভাষায় অশালীন ও বিশৃঙ্খলা তৈরির জিনিস রাজ্যে হতে দেবে না। আর কে ভারতীয় আর কে ভারতীয় নন, সেটা ঠিক করার অধিকারই বা বিজেপিকে কে দিল?"
এদিকে কেন পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি দরকার, তা ব্যাখ্যা করে বিজেপির রাজ্যসভা এমপি রূপা গাঙ্গুলিও পার্লামেন্টে এদিন বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে দেশের এমন এক রাজ্য যেখানে কোটি কোটি ভুয়ো রেশন কার্ড পাওয়া গেছে।"
"এখানে ছাত্রদের কোটি কোটি জাল পরিচয়পত্র ইস্যু করা হয়েছে, যাতে স্কুলে দুপুরের খাবারের নামে টাকা চুরি করা যায়। ভুয়ো রেশন কার্ডে খাবার তুলে তা বাইরে কালোবাজারিতে বিক্রি হচ্ছে।"
চৌত্রিশ বছর পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা সিপিএমের বিরুদ্ধেও এক সময় অভিযোগ উঠেছিল, তারা ঢালাওভাবে অবৈধ বিদেশিদের পশ্চিমবঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
রাজ্য বিধানসভায় এখন তাদের দলনেতা সুজন চক্রবর্তীও প্রশ্ন তুলছেন, কোন সাহসে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চায়?
মি চক্রবর্তী বলছিলেন, "এত বড় যোগ্যতা হয়ে গেল বিজেপির যে বলছে আমরা রাজ্যে জিতলে এনআরসি করব? এত আস্পর্ধা কোথায় পায় তারা?
"আসলে সাত মণ তেলও পুড়বে না, রাধাও নাচবে না - বিজেপিকেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কোনওদিন বেছে নেবে না। কিন্তু যারা বলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব, তারা আসলে অসভ্য ও বর্বর একটা দল!"
আসলে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতা যে আলাদা - এবং পশ্চিমবঙ্গে এরআরসি তৈরি করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, এই একই মতের শরিক শিক্ষাবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক মহুয়া সরকার।
ড: সরকার বিবিসিকে বলছিলেন, "পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে এই অর্থে আলাদা যে তারা সব সময় বাইরের লোকজনকে ঠাঁই দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সীমান্তবর্তী রাজ্য এটা - এবং সাতচল্লিশেই বলুন বা একাত্তরে, পশ্চিমবঙ্গ সব সময়ই তাদের প্রতি অ্যাকোমোডেটিভ ছিল।
"এমন কী এ রাজ্যে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারাও বাইরের লোকজনের প্রতি সহৃদয়তা দেখিয়েছে সব সময়ই। এটাকে ভোটের রাজনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করাও ঠিক হবে না - কারণ পশ্চিমবঙ্গের একটা অসাম্প্রদায়িক চেহারা আছে, সহনশীল মুখ আছে এটাও আমাদের বুঝতে হবে!"
আসাম চুক্তি সই হওয়ার পর সে রাজ্যে এনআরসি-র চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশেই লেগে গেছে দীর্ঘ তেত্রিশ বছর। আর পশ্চিমবঙ্গে এটা এখনও শুধু দাবি বা প্রস্তাবের স্তরেই।
কিন্তু তারপরও তা নিয়ে যে পরিমাণ রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি চালু করার দাবি হয়তো সহজে থিতোবে না। সূত্র: বিবিসি বাংলা।