• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ধর্ষণে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে

প্রকাশ:  ১১ অক্টোবর ২০১৭, ১১:১৭
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ধর্ষণে সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষায় নিয়োজিত জাতিসংঘের স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এ কথা জানিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হওয়া রোহিঙ্গারা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে অভিযোগ করেছেন, সেনাসদস্যরাই তাদের ধর্ষণ করেছে। ওই স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে আটজনের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে। 

এদিকে ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রধান জেন লিবি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতার পর থেকে ৮০০টিরও বেশি যৌন সহিংসতার ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এগুলোর অর্ধেকই শারীরিক নিপীড়ন।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার অনেক নারী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলাদেশে এই নারীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সময় চিকিৎসকরা অনেক নারীর শরীরেই যৌন সহিংসতার ক্ষত দেখতে পেয়েছেন। মিয়ানমারে যৌন সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশ আসা রোহিঙ্গা নারীদের স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা দিচ্ছেন— কক্সবাজারে এমন আটজন স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। ওই স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, গত আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার ২৫ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা নারীকে চিকিৎসা দিয়েছেন।

পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন ১৩ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শিশু আদিজা। সেদিন আদিজা চিৎকার করে উঠে এবং পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে। কিন্তু মুখোশধারী কিছু পুরুষের হাত তার কাপড় ছিড়ে ফেলে। চিৎকার করে ক্ষমা চাইতে থাকে আদিজা, কাকুতি-মিনতি জানায় ছেড়ে দেওয়ার। কিন্তু ১৩ বছর বয়সী ওই মেয়ে রেহাই পায়নি। বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এর কিছুক্ষণ আগেই চোখের সামনে নিজের বাবা-মাকে গুলিতে মারা যেতে দেখে সে।

রাখাইনে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে একটি কাঠের টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিল তারা। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ধরা পড়ে যায় এক সেনাসদস্যের হাতে। আদিজার ভাষায়, ‘আমি অসহ্য ব্যাথা পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার শুধু একটা বিষয়ই মনে হচ্ছিলো। আমি আর পবিত্র নেই। আমার আর কখনও বিয়ে হবে না।’

ছয় সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জ্বালিয়ে দিয়েছে তার বাড়ি। বোনকে নিয়ে সে পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক প্রধান জেন লিবি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতার পর থেকে ৮০০টিরও বেশি যৌন সহিংসতার ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এগুলোর অর্ধেকই শারীরিক নিপীড়ন।

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ৬০ শতাংশ শিশু। ১৫ বছর বয়সী ছোটবোন মিনারাকে সঙ্গে নিয়ে এক মাস আগে বাংলাদেশে এসেছে সে। বাঁশ আর প্লাস্টিকে নির্মিত নিজস্ব তাঁবুতে বাস করছে। তবে তারা এভাবে নিরাপদ বোধ করে না। আদিজা বলেন, ‘আমাদের বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের দেখার আর কেউ নেই। এই ক্যাম্পে আরও অনেক মেয়ের কাছে শুনেছি যে, তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তারা তাই বেশিরভাগ সময় তাঁবুতেই থাকতে চায়।

ওই কিশোরীরা থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একটি ফাঁকা ক্লাসরুমে কথা বলতে রাজি হয়। তবে তারা ওই কক্ষের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতে বলে। নিজেদের নাম গোপন রাখার শর্ত দেয়। হিজাবে মুখ ঢেকে রাখে। নিশ্চয়তা চায় যে, ওই কক্ষে কোনও পুরুষ প্রবেশ করবে না।

এরপর ধর্ষণের শিকার আদিজার বোন মিনারা বলেন, ‘আমি খুবই লজ্জিত। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমার সতীত্বের সঙ্গে সেগুলোও হারিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার শরীর ঢাকার জন্য পর্যাপ্ত কাপড় নেই। কিন্তু আমি কি করবো।’ প্রতিবেশীর কাছ থেকে কাপড় নিয়ে পরছেন বলে জানান তিনি।

কুতুপালং ক্যাম্পে ত্রাণ সংস্থাগুলো কিছু সেফ স্পেস স্থাপন করেছে। রঙিন এই ঘরগুলোতে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারী ও শিশুরা মানসিক সহায়তা পাবে। জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ’র মুখপাত্র ভেরোনিকা পেদ্রোসা বলেন, ‘তারা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সহজ হতে চেষ্টা করে। এখানেই তাদের বিভীষিকার ব্যাপারে প্রথম মুখ খোলেন তারা।’ কিন্তু এই অল্প সময়ে এত বিশাল সংখ্যক মানুষের সহায়তায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই।

ইউনিসেফেলে লিয়েবি বলেন, ‘আমরা এই শরণার্থীদের ঢল সামলানোর জন্য মাত্র এক মাস সময় পেয়েছি। বাংলাদেশে এমন ঘটনা কখনোই ঘটেনি। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ এ সময় বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আমরা শরণার্থী শিশুদের প্রয়োজন মেটাতে পরিশ্রম করছি। ধর্ষণের ফলে তাদের যে মানসিক অবস্থা তৈরি হয়েছে সেটা কাটানোর ব্যবস্থা করছি।’ 

ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করা একজন ত্রাণকর্মী জানান, কাউন্সেলিং সেবা থাকলেও অনেক মেয়েই বলতে চাইছে না যে, তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। রেবেকা ডাসকিন নামে এক নার্স থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে বলেন, ‘এমন পরিবেশে মেয়েরা যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া নিয়ে মুখ খুলতে ভয় পায়। তারা পরিবারের কথা চিন্তা করেও আতঙ্কে থাকে।’

স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করতে মেডিকেল টিমস ইন্টারন্যাশনালের হয়ে ক্যাম্পে এসেছেন ওই ত্রাণকর্মী। তিনি বলেন, ‘অনেকের জন্যই এটা যৌন নিপীড়িত হওয়ার প্রথম ঘটনা। এখন তাদের নিরাপত্তা প্রয়োজন। তাদের অনেকেই সহিংস ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, কখনও জনসমক্ষেই। এজন্য বিভীষিকার মাত্রা ছিলো ভয়াবহ।’ কুতুপালংয়ের নতুন শরণার্থীরা বিধ্বস্ত, ক্ষুধার্ত ও শারীরিকভাবে আহত। গুলি কিংবা ছুরির আঘাতে আহত হয়েছেন তারা। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা আসলে তাদের মানসিকভাবেই।’

মিনারা বলেন, ‘বাড়ি ফিরে যাওয়ার চেয়ে মারা যাওয়া ভালো। আমরা বাইরেই যেতে পারি না। এখানে কোনও বন্দুক হয়তো নেই। কিন্তু পুনরায় ধর্ষণের শিকার হতে পারি আমরা।’ তার পাশে বসা ছোট বোন আজিদাও তার কথায় সায় দেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম সেনারা যখন আমাকে জঙ্গলে নিয়ে গেল, আমি মারা যাবো। কিন্তু এখন মনে হয় সতীত্ব হারানোর চেয়ে মৃত্যুই আমার জন্য ভালো হতো।’