• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

রক্তে ক্যালসিয়াম ঘাটতি

ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

প্রকাশ:  ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ১১:১০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মানবদেহকে সম্পূর্ণ সুস্থ রাখা কোনো একক কাজ নয়। দেহের সকল অঙ্গ ও তন্ত্রের সম্মিলিত শৃঙ্খলাপূর্ণ সমন্বিত কাজের ফলে পূর্ণাঙ্গ মানবদেহ সুস্থ থাকে। এই কাজে কিছু কিছু খনিজ উপাদানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইসব খনিজ উপাদান দেহের কাজে লাগে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণে। পরিমাণে অতি অল্প হলে কী হবে এই খনিজগুলোর ভূমিকা দেহের প্রতি অসামান্য ও অপরিহার্য। ক্যালসিয়াম এই গুরুত্বপূর্ণ খনিজসমূহের একটি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের দেহে প্রতি ডেসি লিটার রক্তে ৮.৮ থেকে ১০.৪ মিলি গ্রাম ক্যালসিয়াম দরকার। এর বেশি হলে তাকে বলে হাইপারক্যালসেমিয়া আর কম হলে বলা হয় হাইপোক্যালসেমিয়া।

দেহে ক্যালসিয়ামের দৈনিক চাহিদা
    * প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ-১০০০ মিলি গ্রাম
    * পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে মহিলা-১২০০ মিলি গ্রাম
    * সত্তরের ঊর্ধ্বে যে কেউ-১২০০ মিলি গ্রাম
    * শিশু ৯-১৮ বছর-১৩০০ মিলি গ্রাম
    * শিশু ৪-৮ বছর -১০০০ মিলি গ্রাম
    * শিশু ১-৩ বছর-৭০০ মিলি গ্রাম
    * শিশু ৭ মাস-১২ মাস- ২৬০ মিলি গ্রাম
    * শিশু ০-৬ মাস- ২০০ মিলি গ্রাম
    * গর্ভবতী মা- ১০০০ মিলি গ্রাম
    * স্তন্যদানকারী মা- ১০০০ মিলি গ্রাম

দেহে ক্যালসিয়ামের ভূমিকা :
    * ক্যালসিয়াম মানবদেহে হাড় ও দাঁত গঠনে সহায়তা করে।
    * মানুষের অভ্যন্তরীণ কঙ্কাল গঠনে ক্যালসিয়াম অতি গুরুত্বপূর্ণ।
    * মাংশপেশী সমূহের সংকোচন-প্রসারণে ক্যালসিয়ামের ভূমিকা প্রধান।
    * ক্যালসিয়াম আমাদের রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
    * হৃৎপি-ের সংকোচন-প্রসারণে ক্যালসিয়ামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

রক্তে ক্যালসিয়াম ঘাটতির লক্ষ্মণ
    * মাংশপেশীর মোচড়
    * কাঁপুনি ও খিঁচুনি, টিটেনি
    * কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট
    * স্মৃতি বিলোপ ও কনফিউশান
    * মুখ, হাত-পা বিবশতা ও ঝিন ঝিন করা
    * বিষণœতা
    * হ্যালুসিনেশন
    * মাংশপেশীর কামড়
    * দুর্বল ও ভঙ্গুর নখ
    * সহজে ভঙ্গুর হাড়
    * মাংশপেশীর খোঁট
    * শিশুদের কার্পোপেডাল সিন্ড্রোম, নিঃশ্বাসে ঘর্ঘর আওয়াজ ও খিঁচুনি
    * টিটেনি ও ট্রুসো সাইনের উপস্থিতি

রক্তে ক্যালসিয়াম ঘাটতির কারণ :
    * রক্তে ক্যালসিয়াম আয়রনের স্বাভাবিক ঘনত্ব বজায় থাকা সত্ত্বেও অ্যালবুমিন নামক প্রোটিনের মাত্রা হ্রাস পাওয়া
    * প্যারাথাইরয়েড নামক নালীহীন গ্রন্থির নিঃসরণ হ্রাস পাওয়া
    * ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি তৈরি হওয়া
    * অলীক হাইপোপ্যারাথাইরয়েডিজম, যদিও রক্তে ক্যালসিয়াম এবং প্যারাথাইরয়েড হরমোন স্বাভাবিক থাকে কিন্তু মায়ের কাছ থেকে জন্মগত জীনত্রুটির কারণে ক্যালসিয়াম বিশোষণ কমে যায়।
    * দীর্ঘদিন ধরে বিশেষত শৈশব হতে খাদ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি
    * কতিপয় ঔষধ যেগুলো রক্ত হতে ক্যালসিয়াম শোষণে দেহকে বাধা দেয় তা সেবন
    * কারো কারো ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্যের প্রতি অসহনীয়তা
    * হরমোনজনিত পরিবর্তন
    * জীনগত সমস্যা বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে
    * দীর্ঘদিন ধরে বমি হলে রক্তে ক্যালসিয়াম ঘাটতি হয়

    * পারদ বিষক্রিয়ায় ক্যালসিয়াম ঘাটতি হয়
    * খাদ্যে জিঙ্কের পরিমাণ বাড়লে দ্রুত ক্যালসিয়াম ঘাটতি হয়
    * ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ জোলাপ দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা হ্রাস পায়
    * বিসফসফোনেট ও ক্যালসিটোনিন জাতীয় ঔষধের ব্যবহার
    * দীর্ঘস্থায়ী কিডনী রোগ
    * সক্রিয় ভিটামিন-ডি ঘাটতি
    * সূর্যালোকে উন্মুক্ত হওয়ার সুযোগ না থাকা
    * খিঁচুনি রোধকারী ঔষধ সেবন
    * ভিটামিন-ডি নির্ভর রিকেটস্
    * ক্ষুদ্রান্ত্রের বিশোষণ দুর্বলতা
    * টিউমার বিগলন সিন্ড্রোম বা র‌্যাবডোমায়োলাইসিস
    
রক্তে ক্যালসিয়াম ঘাটতির অন্যান্য কারণ
    * রক্তে ভিটামিন-ডি-এর নি¤œমাত্রার কারণে ক্যালসিয়াম বিশোষণ কঠিন হয়ে পড়ে
    * ফেনিটয়েন, ফেনোবার্বিটাল, রিফামপিসিন,  কর্টিকোস্টেরয়েড ইত্যাদি ঔষধ সেবনকালীন দেহে ক্যালসিয়াম বিশোষণ কমে যায়
    * অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস নামক নালীহীন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির প্রদাহ
    * রক্তে ম্যাগনেসিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ বা নিম্ন হওয়া
    * রক্তে ফসফেটের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে হ্রাস পাওয়া
    * সেপটিক শক
    * পরিমাণে প্রচুর রক্ত পরিসঞ্চালন
    * কিডনী ফেইলিওর
    * হাইপার প্যারাথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত রোগীর প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি অপারেশন করে ফেলে দেয়ার পর ‘ক্ষুধার্ত অস্থি সিন্ড্রোম’-এর উদ্ভব হওয়া
    
রক্তে ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত বিভ্রাট :
    * দেহের প্রান্তীয় স্নায়ুগুলোর উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়
    * যদি রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা প্রতি ডেসি লিটারে ৮ মিলি গ্রামের চেয়ে কম হয় তবে টিটেনি নামে এক ধরণের খিঁচুনি হয়।
    * বাচ্চাদের ক্ষেত্রে একসাথে তিনটি লক্ষ্মণ প্রকাশ পায় যেমন : কার্পোপেডাল স্প্যাজম, আওয়াজযুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ এবং খিঁচুনি।
    * বয়স্কদের হাত-পা শিন্ শিন্,  ঝিন ঝিন করে।
    * প্যাপিলোইডিমা দেখা দেয়।
    * ইসিজিতে কিউ-টি মধ্যবর্তী সময় ব্যবধান বৃদ্ধি পায়।
    * হৃদযন্ত্রের অলিন্দ তালহারা হয়ে যায়।
    * চোখে ছানি তৈরি হয়।
    * শিশুদের রিকেটস্ ও বড়দের অস্টিওম্যালেশিয়া, অস্টিও পোরোসিস, অস্টিওপেনিয়া দেখা দেয়।

ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা:
    * ত্যাগ করা নিঃশ্বাস বায়ু একটা পলিথিন ব্যাগে ভরে পুনঃ শ্বাস নিলে টিটেনি ও রক্তে ক্ষারীয় মাত্রা কমে আসে।
    * ক্যালসিয়াম গ্লুকোনেট ইঞ্জেকশান অতি ধীরে ধীরে শিরায় দেয়া।
    * মুখে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ট্যাবলেট সেবনের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করা।
    * ক্যালসিট্রাইয়ল মুখে গ্রহণের মাধ্যমে ভিটামিন ডি ঘাটতি পূরণ করা।

ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার :
    কালো জিরা, সিম, সিমের বীচি, যাবতীয় ডাল, বাদাম, দুধ ও দুধজাতীয় খাদ্য যেমন পনির, দই, মাঠা, ঘোল ইত্যাদি, পালং শাক, ডুমুর, কলিজা ইত্যাদি।
    
নির্দেশিত ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট
    * ক্যালসিয়াম কার্বোনেট যাতে মৌল ক্যালসিয়ামের মাত্রা অধিক। এটা দামে কম।
    * ক্যালসিয়াম সাইট্রেট যা সহজে শোষিত হয়।
    * ক্যালসিয়াম ফসফেট যা সহজে শোষিত হয় কিন্তু কনস্টিপেশন করে না।

ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট ও কতিপয় ঔষধ
    * অ্যাটিনোলল জাতীয় প্রেশারের ঔষধ ক্যালসিয়াম শোষণ কমিয়ে দেয় যদি ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের দুই ঘণ্টার মধ্যে ঐ ঔষধ সেবন করা হয়।
    * অ্যালুমিনিয়াম সমৃদ্ধ এন্টাসিড ক্যালসিয়ামের শোষণ কমিয়ে দেয়।
    * ডিগক্সিন জাতীয় ঔষধ রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
    * হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড জাতীয় মূত্রকারক ঔষধ ক্যালসিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় কিন্তু ফ্রুসেমাইড জাতীয় মূত্রকারক রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
    * ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টের সাথে ফ্লুরোকুইনোলন (সিপ্রোসিন) জাতীয় ঔষধ সেবন বা টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় ঔষধ সেবন করলে ক্যালসিয়ামের শোষণ কমে যায়।

 

সর্বাধিক পঠিত