কিডনী-পাথর
ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
রক্ত-মাংসে গড়া দেহে যখন মন হয়ে যায় পাষাণ তখন মনুষ্যত্ব চলে যায় দূরে। কিন্তু যখন পাষাণ বা পাথরই এ দেহকে আক্রান্ত করে তোলে তখন আর মানুষের জীবন সুখের থাকে না, হয়ে যায় বেদনাময়। পাথরের বেদনা যে কী ভীষণ তা যে ভোগেনি তার পক্ষে অনুধাবন করা কষ্টকর। মানবদেহে পিত্তথলির পাথর আর কিডনীর পাথরের চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু আছে বলে মনে হয় না।
কিডনীর সাথে পরিচিত নয় এমন মানুষ বিরল। মানুষের দেহে পিছনের দিকে বামে ও ডানে মেরুদ-ের দুই পাশে একটি করে মোট দুটি কিডনী থাকে। বাম কিডনীর অবস্থান ডান কিডনীর লেভেলের চেয়ে কিছুটা উচ্চে। কিডনী দেখতে আকৃতিতে অনেকটা শিমের মতো বা বরবটির বিচির মতো। কিডনীর কাজ হলো দেহের রক্তকে ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিশোধন করা। দেহের মধ্যে বিপাক ক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন উৎপাদ, উপজাত ও বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়। কিডনীর কাজ হলো সেইসব নাইট্রোজেনজনিত বর্জ্য পদার্থকে ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেহ হতে বের করে দেয়া ও দেহকে সংশ্লিষ্ট বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাব হতে মুক্ত রাখা। কিডনী যদি কোন কারণে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ছাঁকন কার্যে অসমর্থ হয় তবে তাকে বলা হয় কিডনী ফেইলিওর। তখন দেহে বিপাক প্রক্রিয়াজনিত কারণে উৎপন্ন বর্জ্য বৃদ্ধি পায় ও দেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিটি কিডনী নেফ্রন নামে বার লক্ষ ক্ষুদ্র ছাঁকন যন্ত্র দিয়ে তৈরি।
কিডনী-পাথরের উপাদান ও আকৃতি
কিডনী-পাথরের অধিকাংশই ক্যালসিয়াম অক্সালেট নামক খনিজ হতে গঠিত হয়। কিছু কিছু কিডনী-পাথর ইউরিক এসিডের ইউরেট লবণ হতে তৈরি হয়। ক্যালসিয়াম ফসফেট জাতীয় খনিজ হতে কিছু কিছু কিডনী-পাথর তৈরি হয়। ইউরিক এসিড ও ক্যালসিয়াম অক্সালেটের মিশ্রণ হতে কিছু কিছু কিডনী-পাথর তৈরি হয়। এছাড়াও সিস্টিন জাতীয় অ্যামাইনো এসিডের কারণে স্ট্রুভাইট জাতীয় কিডনী-পাথর তৈরি হয়। মূলতঃ কিডনী-পাথরগুলো এক ধরনের কেলাস যা কিডনীর দুর্বল ছাঁকন প্রক্রিয়ার কারণে উৎপন্ন হয়। এদের আকার কখনো এমন ছোট হয় যে তা স্বতঃ উপায়ে মূত্র ত্যাগের সময়ে দেহ হতে নির্গত হয়ে যায়। কিছু কিছু কিডনী-পাথর আকারে বেশ বড় হয়। কিছু কিছু কিডনী-পাথর হরিণের শিং-এর মতো বাঁকানো থাকে। ইউরিক এসিড হতে উৎপন্ন কিডনী-পাথর হিমোগ্লোবিন সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে লালচে কমলা হয়।
কিডনী-পাথরের কারণ
* দৈনিক প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পান করা।
* মূত্রে জীবাণুর সংক্রমণ
* ক্রন্স ডিজিজ
* ইরিটেবল বাওয়েল ডিজিজ
* মেডুলারি স্পঞ্জ কিডনী
* কিডনীর নালিকাস্থিত তরলে এসিডের মান বৃদ্ধি
* হাইপার প্যারথাইরয়েডিজম
* ডেন্ট'স ডিজিজ
* ক্রনিক ডায়রিয়া
কিডনী-পাথরে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষ্মণ
* পিছনে কিডনী-এরিয়ায় তীব্র ব্যথা বোধ হওয়া
* ব্যথা পিছন হতে সামনে ছড়িয়ে পড়া
* ব্যথা কিডনী-অঞ্চল হতে নিম্নদিকে মূত্র নির্গমন পথ বরাবর ছড়িয়ে পড়া
* মূত্রে রক্ত নির্গমন
* মূত্র ত্যাগে জ্বালা অনুভব হওয়া
* বমি ও বমিভাব
* কাঁপুনিসহ তীব্র জ্বর
* বার বার প্র¯্রাবের বেগ হওয়া
* মূত্র ত্যাগের পরেও মূত্র ত্যাগের অনুভূতি বজায় থাকা
* মূত্রের পরিমাণ হ্রাস পাওয়া
কিডনী-পাথর নিরূপণের পরীক্ষণ
* কিডনী-অঞ্চলে রোগীর তীব্র ব্যথা
* কিডনী ও মূত্রথলি-অঞ্চলের এক্সরে
* মূত্র পরীক্ষণ
* মূত্রতন্ত্রের আল্ট্রাসনোগ্রাম
* তলপেটের সিটি স্ক্যান
* ক্ষেত্রবিশেষে আইভিইউ
কিডনী-পাথরে কারা ঝুঁকিপূর্ণ
* যারা দৈনিক আট গ্লাসের চেয়ে কম পানি পান করে
* অতি স্থুল দেহ-কাঠামো
* যারা অলস ও পরিশ্রমযুক্ত কাজে অনাগ্রহী
* নারীর চেয়ে পুরুষ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ
* যাদের বয়স তিরিশ হতে পঞ্চাশের মধ্যে
* উচ্চ রক্তচাপ বহনকারী
যে সকল ঔষধ কিডনী-পাথর তৈরিতে দায়ী
* টপিরামেট জাতীয় মাইগ্রেনের ব্যথা উপশমকারী ঔষধ
* দীর্ঘদিন ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি গ্রহণ
যে সকল খাদ্য কিডনী-পাথর থেকে রক্ষা করে
* শিম, বরবটির বিচির তরল স্যুপ
* আপেল
* ডালিম
* ভিটামিন বি-৬ বা পাইরিডক্সিন যা ঔষধ হিসেবে পাওয়া যায়
* আঙ্গুর
কিডনী-পাথর হতে বাঁচার উপায়
* দৈনিক আট থেকে দশ গ্লাস পানি পান
* শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম
* উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
* শিম জাতীয় খাবার গ্রহণ বাড়িয়ে দেওয়া
কিডনী-পাথরের চিকিৎসা
* ছোট ছোট পাথরগুলো আপনা-আপনি প্রস্রাবের সাথে নির্গত হয়ে যায়
* বড় পাথর লিথোট্রিপসি প্রক্রিয়ায় চূর্ণ করে বের করা হয়
* বড় পাথর ও হরিণ-শিং আকৃতির পাথর সরাসরি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা হয়।
কিডনী-পাথরের পরিণতি
* মূত্রপথে স্বতঃ নির্গমন
* কিডনী ফেইলিওর
* রক্তচাপ বৃদ্ধি
* মূত্রপথে দীর্ঘ দিনের রক্তক্ষরণ
* কিডনী ফেইলিওর ও মাল্টি অর্গান কলাপ্সজনিত মৃত্যু