পদার্থবিজ্ঞান : টাইম ক্রিস্টাল
পদার্থের কত বিচিত্র অবস্থা! পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তিন ধরনের পদার্থ—তরল, কঠিন ও বায়বীয়। কিন্তু মহাবিশ্বে পদার্থকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় প্লাজমা অবস্থায়। এ ছাড়াও আছে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট, সুপার ফ্লুইড, সুপার সলিডসহ পদার্থের আরও নানা দশা। কিন্ত পদার্থের কি চতুর্মাত্রিক কোনো অবস্থা আছে, যা সময়ের ওপর নির্ভরশীল? উত্তর হলো, হ্যাঁ, আছে।
পদার্থের এরকম এক অবস্থার নাম টাইম ক্রিস্টাল। বাংলায় একে ‘সময়-স্ফটিক’ বলা যায়। টাইম ক্রিস্টাল বলতে সবচেয়ে কম শক্তিস্তরের কণাদের এক বিশেষ কোয়ান্টাম অবস্থাকে বোঝায়।
প্রথমে সাধারণ ক্রিস্টাল বা স্ফটিকের কথা ভাবুন। এতে পরমাণুগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে সজ্জিত থাকে। তাই এ ধরনের ক্রিস্টালকে স্পেস ক্রিস্টালও বলে। এদের সুনির্দিষ্ট ও সুষম জ্যামিতিক গঠন থাকে। উদাহরণ হিসাবে সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl) স্ফটিকের কথা বলতে পারি। ত্রিমাত্রিক স্ফটিকের ক্ষেত্রে প্রতিটি সোডিয়াম (Na) পরমাণু ৬টি ক্লোরিন (Cl) পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত থাকে। আবার প্রতিটি ক্লোরিন পরমাণুও যুক্ত থাকে ৬টি সোডিয়াম পরমাণুর সঙ্গে। এভাবে সোডিয়াম ও ক্লোরিন পরমাণুগুলো সুসজ্জিত থাকে পর্যায়ক্রমে নির্দিষ্ট বিন্যাসে।
টাইম ক্রিস্টাল কী, তা বুঝতে আমরা মহাকাশের একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারি। মনে করি, দুটি ভারী বস্তু সিস্টেমের ভরকেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরছে।
বরফের কথাই ভাবুন। বরফে পানির (H₂O) অণুগুলো ষড়ভুজাকার প্যাটার্ন তৈরি করে। এসব স্ফটিক ত্রিমাত্রিক। সময়কে বলা হয় চতুর্থ মাত্রা। তাহলে চারমাত্রিক ক্রিস্টাল কি বাস্তবে পাওয়া সম্ভব?
এক্ষেত্রেও উত্তর হলো, হ্যাঁ, সম্ভব। এগুলোই টাইম ক্রিস্টাল। টাইম ক্রিস্টাল ও স্পেস ক্রিস্টালের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই। এটি একধরনের কোয়ান্টাম সিস্টেম, যেখানে অনেকগুলো পরমাণু বা কণা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে থাকে। এই প্যাটার্নগুলো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়, তবে নির্দিষ্ট সময় পর আবার আগের দশায় ফিরে আসে।
টাইম ক্রিস্টাল কী, তা বুঝতে আমরা মহাকাশের একটা সিস্টেম বা ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারি। মনে করি, দুটি ভারী বস্তু সিস্টেমের ভরকেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরছে। বস্তু দুটোকে আমরা গ্রহ ধরে নিই। অর্থাৎ দুটো গ্রহই একটি সাধারণ বিন্দুকে কেন্দ্র করে দুটি ভিন্ন কক্ষপথে ঘুরছে। গ্রহ দুটির বেগ নির্দিষ্ট। তাহলে নির্দিষ্ট সময় পর পর সিস্টেমে আমরা গ্রহ দুটিকে একই অবস্থানে দেখতে পাব। টাইম ক্রিস্টালেও এরকম অনেকগুলো পরমাণু বা কণাদল থাকে, স্পেস ক্রিস্টালের মতোই নির্দিষ্ট নিয়মে সুসজ্জিত থাকে এগুলো। সময়ের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলে যায় তাদের দশা। এক সময় তারা আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
টাইম ক্রিস্টাল কেমন, তা আরও ভালোভাবে বুঝতে ঘড়ির কথা ভাবতে পারেন। ঘড়ির তিনটি কাঁটা থাকে—সেকেন্ডের কাঁটা, মিনিটের কাঁটা ও ঘণ্টার কাঁটা। অ্যানালগ ঘড়িতে যেরকম থাকে আরকি। ঘণ্টার কাঁটা ১২ ঘণ্টা পরপর একই অবস্থানে ফিরে আসে। একইভাবে মিনিটের কাঁটা ৬০ মিনিট ও সেকেন্ডের কাঁটা ৬০ সেকেন্ড পরপর আগের অবস্থানে ফেরে। ‘ঘড়ি’ নামের সিস্টেমে তিনটি কাঁটা ভিন্নভাবে চলে। সে জন্য কাঁটা তিনটির গতিবিধি একসঙ্গে ভাবলে ঘড়ির পুরো সিস্টেম আবার আগের অবস্থায় ফিরতে, অর্থাৎ এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে ১২ ঘন্টা সময় লাগে। টাইম ক্রিস্টালের বিষয়টাও অনেকটা এ রকম। আমরা ঘড়ির তিনটি কাঁটাকে ক্রিস্টালের তিনরকম পরমাণু চিন্তা করি। তিন রকমের পরমাণু তিনভাবে চলে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, নির্দিষ্ট সময় পর পর তাদের অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
অনেকে আবার একে অবিরাম গতিযন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। এটা একধরনের কাল্পনিক যন্ত্র। কল্পনা করা হয়, এ যন্ত্র কোনো শক্তি ব্যয় করা ছাড়াই কাজ সম্পাদন করতে পারে। এতে তাপগতিবিদ্যার সূত্রের লঙ্ঘন হয়। কিন্তু টাইম ক্রিস্টাল কোনো কাজ করে না।
টাইম ক্রিস্টালে গতি আছে, এর ভেতরের কণাগুলো গতিশীল। তবে এটি কোনো গতিশক্তি দেখায় না। একে আমরা তাই শক্তিহীন গতি বলতে পারি। এই সিস্টেম বাইরে থেকে কোনো শক্তি শোষণ করে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের দশার পরিবর্তন ঘটায়। আর আগের যেমন বলেছি, টাইম ক্রিস্টাল সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের কোয়ান্টাম অবস্থা। সে জন্য এটি কোনোরকম শক্তি নিঃসরণ করে না। কিংবা বলা যায়, এর কোনো শক্তি হ্রাস পায় না।
স্পেস ক্রিস্টালের আকার ছোট হবে, নাকি বড়; তা নির্ভর করে এর প্যাটার্নে কতবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, তার ওপর। ইতিমধ্যেই আমরা সোডিয়াম ক্লোরাইডের স্পেস ক্রিস্টাল দেখেছি। সেটার কথা ভাবলে বিষয়টা সহজে বোঝা যায়। আর টাইম ক্রিস্টাল আকারে ছোট হবে, নাকি বড়; তা নির্ভর করে এর প্রতিটি দশার স্থায়ীত্বের ওপর। এর দশার পরিবর্তন হয় সাধারণত কয়েক মিলিসেকেন্ডে।
অনেকে আবার একে অবিরাম গতিযন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করেন। এটা একধরনের কাল্পনিক যন্ত্র। কল্পনা করা হয়, এ যন্ত্র কোনো শক্তি ব্যয় করা ছাড়াই কাজ সম্পাদন করতে পারে। এতে তাপগতিবিদ্যার সূত্রের লঙ্ঘন হয়। কিন্তু টাইম ক্রিস্টাল কোনো কাজ করে না।
আমরা সবাই জানি, বল প্রয়োগের ফলে সরণ ঘটলে তাকে কাজ বলে। কিন্তু টাইম ক্রিস্টালে কোনো বাহ্যিক বলের প্রয়োজন হয় না। মানে, টাইম ক্রিস্টাল পদার্থবিজ্ঞানের কোনো সূত্র ভঙ্গ করে না। তাই টাইম ক্রিস্টালকে আমরা অবিরাম গতিযন্ত্র বলতে পারি না। বরং এর সঙ্গে সুপারকন্ডাকটরের সাদৃশ্য আছে। সুপারকন্ডাকটরের রোধ শূন্য। তাই একবার বিদ্যুৎ প্রবাহ শুরু হলে তার কোনো ক্ষয় হয় না। অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হতে পারে। টাইম ক্রিস্টালও স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনন্তকাল ধরে পরিবর্তন করতে থাকে।
২০১৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার নরম্যান ইয়্যাও স্পিনসিস্টেম ব্যবহার করে টাইম ক্রিস্টাল তৈরির একটি ভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা বলেন। এর মধ্যে একটি ছিল ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ক্রিস্টোফার মনরোর দল।
২০১২ সালে এমআইটির অধ্যাপক ও নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ফ্র্যাঙ্ক উইলচেক প্রথম তাত্ত্বিকভাবে টাইম ক্রিস্টালের অস্তিত্বের কথা বলেন। ২০১৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যানোইঞ্জিনিয়ার জাং জোং ও তাঁর দল চার্জিত আয়নের তৈরি নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘূর্ণনশীল রিং দিয়ে টাইম ক্রিস্টাল তৈরির প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে টাইম ক্রিস্টালকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেন অনেক গবেষক। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিক ব্রুনো ও জাপানের নাসাকি ওশিকাওয়া বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা দেখান, স্পেস-টাইম ক্রিস্টাল বাস্তবে সম্ভব নয়।
২০১৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার নরম্যান ইয়্যাও স্পিনসিস্টেম ব্যবহার করে টাইম ক্রিস্টাল তৈরির একটি ভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা বলেন। এর মধ্যে একটি ছিল ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ক্রিস্টোফার মনরোর দল। ২০১৬ সালের অক্টোবরে তাঁরা প্রথম স্বতন্ত্র টাইম ক্রিস্টাল তৈরি করেন। তাঁরা ইটারবিয়াম আয়ন দিয়ে তৈরি করেন এই টাইম ক্রিস্টাল। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মিখাইল লুকিনের দলও একই বছর টাইম ক্রিস্টাল তৈরি করে। ২০২০ সালে আল্টো ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক প্রথমবার দুটো টাইম ক্রিস্টালের ভেতরের কণা-প্রবাহের মিথস্ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। ২০২১ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইন্টেলিজেন্ট সিস্টেম ম্যাগনোনের টাইম ক্রিস্টাল তৈরির কথা বলে। একই বছর নভেম্বরে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল পদার্থবিদ ও গুগল যৌথভাবে ঘোষণা করে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মধ্যে টাইম ক্রিস্টাল তৈরির কথা। টাইম ক্রিস্টাল নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
বর্তমানে টাইম ক্রিস্টালের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কোয়ান্টাম মেকানিকস গবেষণায় এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ভবিষ্যতে এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহৃত হতে পারে। সিলিকন চিপ ও কোয়ান্টাম প্রসেসর তৈরির ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে ভবিষ্যতে। ব্যবহৃত হতে পারে অ্যাটমিক ক্লকেও। গবেষকরা ইলেকট্রনিকসের মতো টাইম ক্রিস্টাল নিয়ে পদার্থবিদ্যার একটি নতুন শাখা তৈরির সম্ভাবনার কথা ভাবছেন। এর নাম হতে পারে টাইমট্রনিকস।
সূত্র: আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি, পপুলার সায়েন্স, উইকিপিডিয়া, স্পেকট্রাম ও নেচার
লেখক: শিক্ষার্থী, পুলিশ লাইন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, যশোর