ই-কমার্স প্রতারণায় সরকার ও মিডিয়া প্রভাবকদের দায়
নিজের কর্তৃত্ব, জ্ঞান, সামাজিক অবস্থান বা তার শ্রোতাদের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অন্যের ক্রয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা যিনি রাখেন তিনি মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সের বা প্রভাবক। সে কারণে সারাবিশ্বে সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে শুরু করে ধর্মীয় গুরু-হুজুর- নানান ক্ষেত্রের তারকারা পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টাকার বিনিময়ে কাজ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে টাকা নয় সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তারা এসব কাজ করেন। পণ্যের পক্ষে তারকা বা প্রভাবক যে কথাগুলো বলছেন তা কতটা সত্য, দায় তাকে নিতে হয়। ক্রেতার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং বেআইনি বলে অনেকে এখন আর তামাকজাত পণ্য, মদের বিজ্ঞাপনে অংশ নেন না কিংবা শুভেচ্ছাদূত হন না। খারাপ পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়া তারকার ইমেজের জন্য যেমন খারাপ তেমনি ভালো পণ্যের বিজ্ঞাপন মডেল বা শুভেচ্ছাদূত হওয়া অনেক সময় তারকার ইমেজের জন্য ইতিবাচকও। বিশ্বের অনেক দেশে পণ্যের প্রচারে তারকাদের দায়বদ্ধ করার আইন আছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও আইন আছে। ভারতে ভোক্তা সুরক্ষা আইনে প্রস্তুতকারক এবং সেবাপ্রদানকারীর মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনে ভোক্তার ক্ষতির জন্য দুই বছরের জেল ও ১০ লাখ রুপি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অপরাধের পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে প্রতিবারের জন্য সাজা বাড়বে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা ৫০ লাখ রুপি। ভুয়া বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে সব দেশে তিরস্কৃত হন তারকারা বা প্রভাবকরা। বাংলাদেশে সে সম্পর্কিত আইনে তারকাদের সাজার বিষয়টি নির্ধারণ করা নেই। সে কারণে হয়তো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের প্রতারিত গ্রাহকরা এর শুভেচ্ছাদূত জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এমপির বাড়ি ঘেরাও করা পর্যন্ত কর্মসূচি নিতে পারেন কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ কম। আলেশা মার্টে প্রতারিত হয়ে সাকিব আল হাসান কিংবা ধামাকার পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারিত হলে আরেক ক্রিকেটার মুস্তাফিজের বিরুদ্ধে প্রতারিত গ্রাহকদের করার তেমন কিছু নেই। শুধু ই-প্রতিষ্ঠান নয়, নানা ধরনের পণ্যে তারকারা আসেন, প্রভাবিত করেন এবং সাজা হয় না বলে অবাধে খারাপ পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন। পিরোজপুরের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন রাগীব আহসান। মাদরাসার এক ছাত্রকে ধর্ষণের ঘটনায় ইমামতি থেকে বহিষ্কার হয়ে ঢাকার একটি এমএলএম কোম্পানিতে ৯০০ টাকা বেতনে চাকরি নেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এমএলএম কোম্পানি এহসান গ্রুপ খোলেন। কওমি মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক ও মসজিদের ইমামদের কোম্পানিতে নিয়োগ দেন। ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে গ্রাহকের ব্যবস্থা করে দেন তারাই। এভাবে ১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন রাগীব আহসান। এই এহসান গ্রুপের পক্ষে হাফিজুর রহমান কুয়াকাটা হুজুর নামের জনপ্রিয় একজন হুজুর দীর্ঘদিন প্রচারণা চালিয়েছেন। বলেছেন, এহসান গ্রুপ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, যদি সন্দেহ কর তাহলে তুমি মুনাফিক। এহসান গ্রুপ নাকি বাংলাদেশ নয় গোটা জগতের জন্য রহমতস্বরূপ! বাংলাদেশি ভোক্তা অধিকার আইনে এই হুজুরকেও জেলে দেওয়ার কি ব্যবস্থা আছে? উনিও কিন্তু প্রতারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে একজন প্রভাবক। বাংলাদেশের ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা আইন ২০০৯-এর ৪৪ ধারায় মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের প্রতারণার সাজা এক বছরের জেল কিংবা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। তবে ভারত ও বাংলাদেশের আইনে বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ ও পণ্য বা সেবা অনুমোদন অথবা সুপারিশের জন্য তারকাদের ব্যক্তিগত দায় নির্ধারণ করা নেই। ই-অরেঞ্জের শুভেচ্ছাদূত মাশরাফি বলেছেন ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তার চুক্তি শেষ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের এক হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা হয়েছে। এরপর আদালতে জামিনের জন্য গেলে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমানকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মাশরাফি জানিয়েছেন, ই-অরেঞ্জের সঙ্গে চুক্তি শেষ হলেও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর তিনি এর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের মামলায় সহায়তা করেছেন। মাশরাফি ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে গ্রাহকরা যেতে পারেনি বলে তাদের নিউজ প্রকাশিত হয়নি কিন্তু নিজ থেকে ওইসব তারকা বিবৃতিও দেননি। ইভ্যালির সঙ্গে অভিনেতা তাহসান, তার সাবেক স্ত্রী মিথিলাসহ আরও বেশ কিছু মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সের জড়িত আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি হচ্ছে কিন্তু তারকারা কোনো দায়িত্ব নিচ্ছেন না। তারা সাময়িক অর্থ পাচ্ছেন সত্য কিন্তু নিজেদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন সেদিকে খেয়াল রাখছেন না। এই সমস্ত কাজে শুধু তারকা, প্রভাবকদের দোষ দিয়ে আমরা রেহাই পেতে পারি না। ইভ্যালি, ধামাকা, আলেশা মার্টের নামে বিজ্ঞাপন যাচ্ছে দেশের প্রায় সব মিডিয়ায়। টিভি খুললে এদের বিজ্ঞাপণের জন্য অনুষ্ঠান দেখা যায় না। নিউজ এবং টক শোর ব্র্যান্ডিং করছে প্রতারণায় অভিযুক্ত এসব প্রতিষ্ঠান। সেখানে কি মিডিয়ার কোনো দায়িত্ব নেই? নাকি টাকা দিলেই প্রতারক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে? নাকি তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতারণার অভিযোগ আসলে নিউজ করবেন এবং একইসঙ্গে বিজ্ঞাপন প্রচার করে টাকাও কামাবেন? আরও বিস্ময়ের ব্যাপার আমাদের জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক উদ্যোগে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিসিসির সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইভ্যালি। এর আগে ২০১২ সালে বিপিএল ক্রিকেটে টাইটেল স্পন্সর করেছিল আরেক প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কোম্পানি ডেসটিনি। তাদেরও কি কোনো দায়িত্ব নেই? যখন কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রতারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সাধারণ জনগণ প্রতারিত হওয়ার সম্ভবনা আরও বেড়ে যায়। এদিকে সবকটি মিডিয়ার খবর দেখলাম ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আর দায়িত্ব নেবে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এখন থেকে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। ১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালিসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হবে বলেও জানান তিনি। হাফিজুর রহমান বলেন, ইভ্যালির টাকা কোথায় গেছে, সেটা জানা যায়নি। দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করছে। প্রাথমিকভাবে ইভ্যালি ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপে গেলেও পরবর্তীতে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, বুম বুম, সিরাজগঞ্জ শপ, আলাদিনের প্রদীপ, কিউ কম, আদিয়ান মার্ট, নেট ডট কম এবং আলেশা মার্টের বিষয়ে মন্ত্রণালয় একই পদক্ষেপে যাবে উল্লেখ করেন। গ্রাহকের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আজ পর্যন্ত পণ্য দেয়নি, মার্চেন্টের পাওনাও তারা পরিশোধ করেনি- এমন সব অভিযোগের বিষয়ে তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের আইনি পদক্ষেপে যেতে বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে থার্ড পার্টি অডিটর নিয়োগ দেওয়া হবে কিনা এই প্রশ্নে হাফিজুর রহমান বলেন, থার্ড পার্টি অডিটর নিয়োগের এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। কারণ মন্ত্রণালয় থেকে সব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন বা ব্যবসায়িক লাইসেন্স নেয়নি। বাজারে ই-কমার্স নামের কিছু প্রতারণা প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে, তার বিরুদ্ধে সরকারি পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছা কতটুকু বা সরকার এ নিয়ে কতটা দায়িত্ব পালন করছে সেটা অনুমেয়। একদিকে সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সেররা মানুষকে প্রতারিত হতে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে, মিডিয়ায় প্রতারকদের নিউজ-বিজ্ঞাপন সমানে চলছে; অন্যদিকে ই-কমার্সের প্রতারণার দায়িত্ব নিচ্ছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিন্তু তাদের বাণিজ্যেও বাধা নেই। তাহলে সাধারণ মানুষদের পথ দেখাবে কারা?