ব্যাংকগুলো ই-ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকছে
স্কুলশিক্ষিকা কামরুন নাহার। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন। মুনাফার টাকা সরাসরি ব্যাংকে নিতে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার প্রয়োজন তার। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের এ সময় ব্যাংকের শাখায় গিয়ে হিসাব খোলা অনেক ঝামেলার। তাই ঝুঁকি নিয়ে শাখায় না গিয়ে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ঘরে বসে সহজেই অ্যাকাউন্ট খুলেছেন তিনি। এমন সুযোগ করে দিয়েছে সোনালী ব্যাংক।
‘সোনালী ই সেবা’ নামের মোবাইল অ্যাপস চালু করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটি। এ সেবার মাধ্যমে এখন থেকে ঘরে বসেই যেকোনো গ্রাহক মাত্র দুই মিনিটে সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন।
এভাবেই এখন হাতের মুঠোয় চলে আসছে ব্যাংক সেবা। ই-ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। চালু করছে ডিজিটাল সেবা। এতে করে গ্রাহক ঘরে বসেই সহজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেনদেন ও স্বাচ্ছন্দ্যে সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন। ফলে সময় এবং অর্থ দুটোই বেচে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘সোনালী ই সেবা’ নামে আমাদের মোবাইল অ্যাপ চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে ঘরে বসে হিসাব খোলা যাচ্ছে। অ্যাপ ব্যবহার করে সাধারণ লেনদেনের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেবামূল্য পরিশোধ করা যাচ্ছে। অ্যাপের মাধ্যমে খোলা হিসাবে এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ কোাটি টাকা জমা হয়েছে।
আতাউর রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপট ও গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে ক্যাশলেস লেনদেন ব্যবস্থা শতভাগ বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ব্যাংকে না গিয়েও গ্রাহক যেন সব ধরনের লেনদেন ও সেবা পেতে পারে আমরা সেই কার্যক্রম বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এরইমধ্যে ব্যাংকের সব শাখায় অনলাইন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সারাদেশে আমাদের এক হাজার ২২৪টি শাখায় এখন অনলাইন লেনদেন হচ্ছে। আগামীতে ক্যাশলেস লেনদেন চালুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সোনালী ব্যাংক।
মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের সহযোগিতায় নতুন সেবা চালু করেছে অগ্রণী ব্যাংক। এখন টাকা তুলতে কষ্ট করে শাখা পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় কোটি গ্রাহক এখন নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে বিকাশে কিংবা বিকাশ থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে অর্থ লেনদেন করতে পারবেন। এমনকি জরুরি প্রয়োজনে কিংবা ব্যাংক বন্ধ থাকাকালীনও বিকাশের মাধ্যমে দ্রুত অর্থ লেনদেন করা যাবে।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, মহামারি পরবর্তী সময়ে গ্রাহকদের নতুন নতুন চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে। এখন ঘরে বসেই ব্যাংকিং সেবা চাচ্ছেন। গ্রাহক ২৪ ঘণ্টা লেনদেন করতে চান। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছি। ই-ব্যাংকিংয়ে জোর দিচ্ছি।
তিনি বলেন, একসময় যে ব্যাংকের যত বেশি শাখা থাকত ওই ব্যাংককে তত বড় মনে করা হতো। ওই ধারণা পাল্টে গেছে। এখন যে তত সেবা দেয় সে তত বড়। মোবাইল ব্যাংকিং আরও ডিজিটাল ওয়ালেটে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে সহজে যত বেশি সেবা ও সুবিধা দেয়া যাবে গ্রাহক তত সন্তুষ্ট হবে। তাই এখন শাখা বাড়ানোর চেয়ে আমরা ডিজিটাল এসব সেবায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা বিকাশের সঙ্গে একটি সমঝোতা করছি। ইতোমধ্যে যেসব ব্যাংক বিকাশের সঙ্গে ব্যবসা করেছে। এটা হলো ওয়ানওয়ে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে শুধু বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যায়। আমরা একটি ইউনিক সিস্টেম আনছি। সেটা হলো ব্যাংক থেকে বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা যাবে আবার বিকাশ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে। দেশে প্রথমবারের মতো এই সেবা চালু হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে অগ্রণী ব্যাংকের সিঙ্গাপুরের একচেঞ্জ অফিস একটি অ্যাপ তৈরি করেছে। সিঙ্গাপুরের প্রবাসীরা ব্যাংকে না এসে অ্যাপের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এ ধরনের গ্রাহকবান্ধব সেবা আমরা চালু করছি।
রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা হাবিব। হঠাৎ টাকার প্রয়োজন তার। এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে যেতে হবে অনেক দূরে। তাই ভিসা কার্ড দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ঘরে বসেই বিকাশ অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার করে তুলে নিলেন পাঁচ হাজার টাকা।
হাবিব জাগো নিউজকে বলেন, সুবিধা আছে বলেই জরুরি প্রয়োজনে টাকা তুলতে সমস্যা হয়নি। আমি কম সময়ে দ্রুত টাকা পেলাম। তবে সব ব্যাংক যখন এ ধরনের সুবিধা চালু করবে তখন নগদ টাকা তোলারও প্রয়োজন হবে না। সরাসরি অ্যাকাউন্টে ফান্ড ট্রান্সফার করা যেত।
ই-ব্যাংকিং প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গ্রাহক এখন ঘরে বসেই সব সেবা চান। তাই খরচ কমানো এবং ব্যবসায় টিকে থাকতে অটোমেশনের বিকল্প নেই। পরিপূর্ণভাবে অটোমেশনে যেতে আমরা কর্মীদের দক্ষতা বাড়াচ্ছি।
তিনি বলেন, করোনায় অনেক দেশের গ্রাহক ব্যাংক শাখায় না এসেও সব সেবা নিতে পারছেন। আমরা সব সেবা দিতে পারছি না। কারণ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে আনার পরিকল্পনা করছি। এছাড়া কীভাবে কর্মীরা বাসায় বসেই কাজ করতে পারেন সেটা দেখা হচ্ছে। এতে আমাদের স্পেসটা কমে যাবে। ভাড়ার খরচও কমবে। খরচ কমলে কাস্টমারকে আমরা বিভিন্ন পণ্যের ওপর বাড়তি সুবিধা দিতে পারব।
বাসায় পণ্য ডেলিভারিতে নগদে মূল্য পরিশোধের পরিবর্তে ডিজিটাল পেমেন্ট সলিউশন ‘ক্যাশলেস পে’ সেবা দিচ্ছে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড। এতে করে অনলাইন ডেলিভারিতে ক্রেতাদের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছানোর সময় নগদ অর্থের পরিবর্তে ক্যাশলেস পেমেন্টের সুবিধা পাওয়া যাবে। এ সেবার জন্য কোনো পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিনের প্রয়োজন হবে না। ক্রেতারা পণ্যের দাম পরিশোধ করতে নিজেদের স্মার্টফোন ব্রাউজার ও তাতে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই সহজে ক্যাশলেস পে’র মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন।
এদিকে জরুরি প্রয়োজনে প্রথমবারের মতো দেশে ডিজিটাল ঋণ চালু করেছে সিটি ব্যাংক। জরুরি অর্থের প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে সিটি ব্যাংকের জামানতবিহীন ডিজিটাল ঋণ মিলবে বিকাশে। যেকোনো সময় যেকোনো স্থান থেকে মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে সঙ্গেই সঙ্গেই ঋণ পাওয়া যাবে। প্রাথমিকভাবে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সিটি ব্যাংকের এই ডিজিটাল ঋণ পাচ্ছে গ্রাহক।
সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মাসরুর আরেফিন বলেন, আমরা সবসময়ই গ্রাহকের প্রয়োজনে আরও কাছে থাকার চেষ্টা করি। আমাদের দেশে অনেকেরই, বিশেষত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হঠাৎই অর্থের প্রয়োজন হয়। সেটি কীভাবে আরও সহজে তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় এবং তারা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে সেই অর্থ ব্যবহার করতে পারেন, সেটি মাথায় রেখেই এই ডিজিটাল ঋণের যাত্রা। আমাদের এই পাইলট প্রকল্পটি নীরিক্ষামূলক, এই প্রকল্পে অর্জিত অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্রমোন্নয়নের মাধ্যমে গ্রাহকের জন্য আরও ভালো সেবা নিয়ে আসতে পারব।