এলডিসি দেশের মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগের শীর্ষে বাংলাদেশ
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণে বাংলাদেশের বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত বা এলডিসি দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে। এলডিসিগুলোর মধ্যে বেশি বেড়েছেও বাংলাদেশে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বাংলাদেশের। সারা বিশ্বে ১৩ শতাংশ কমলেও গত বছর বাংলাদেশে আগের বছরের তুলনায় ৬৮ শতাংশ এফডিআই বেড়েছে। বহুজাতিক বেশ কয়েকটি কোম্পানির চুক্তি ও ঘোষণা থেকে চলতি বছরে আরও বেশি এফডিআই আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের সর্বশেষ বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০১৯-এ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৩৬০ কোটি ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। বাংলাদেশের স্থানীয় কোম্পানি ঢাকা টোব্যাকো কেনার মাধ্যমে গত বছর ১৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে জাপান টোব্যাকো। এই একক কোম্পানিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক অঞ্চল সামগ্রিকভাবে এফডিআইয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। 'বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল'কে আঙ্কটাড এ বছরের প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক অঞ্চলকেন্দ্রিক বিনিয়োগের ওপর আলাদা মূল্যায়ন করেছে আঙ্কটাড।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় এমন অনেক কাজ ইতিমধ্যে হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে শিল্প স্থাপনে জমির সংকট দূর হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের লেনদেন সহজ করতে আইন-কানুন শিথিল করা হয়েছে। সহজে ব্যবসা করার সূচকের উন্নয়নের লক্ষ্যে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির জন্য যেসব অনুষঙ্গ থাকা দরকার তা এখন দেশে আছে। অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রগতি হয়েছে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। পাশাপাশি তরুণ জনশক্তিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিদেশি উদ্যোক্তারা। আর্থসামাজিক অর্জনের কারণে বিদেশিদের আস্থা বাড়ছে। ফলে এফডিআই বাড়ছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পুরনো আইনের কারণে এখনও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। এগুলো সংশোধন ও সংস্কারের উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমান অগ্রগতির ধারাবাহিকতা থাকলে ও প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হলে আগামীতে এফডিআই আরও বাড়বে।
আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১৮ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। এই বিশাল বিনিয়োগের সিংহভাগ পেয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। দেশটিতে গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ ৬ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ২০০ কোটিতে ঠেকেছে। বাংলাদেশের মোট বিনিয়োগ কম হলেও বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।
আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এলডিসিগুলোতে মোট এফডিআইয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩৮০ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। এলডিসিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এফডিআই এসেছে বাংলাদেশে। মিয়ানমারও বাংলাদেশের সমপরিমাণ ৩৬০ কোটি ডলার এফডিআই পেয়েছে। তবে এই বিনিয়োগ মিয়ানমারের আগের বছরের বিনিয়োগের তুলনায় ১৮ শতাংশ কম। এছাড়া এফডিআই আকর্ষণে এলডিসির শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক ও কম্বোডিয়া। একক কোম্পানির বিনিয়োগ হিসেবেও বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।
সম্পূর্ণ নতুন বিনিয়োগ বা গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অন্যতম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তেল ও গ্যাস টার্মিনাল নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল ইলেকট্রিক, জাপানের মিৎসুবিশি ও সামিট যৌথভাবে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া জেনারেল ইলেকট্রিক বাংলাদেশে ফসিল ফুয়েল ইলেকট্রিক পাওয়ার খাতে ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। একই খাতে চীনের হুয়াদিয়ান করপোরেশন প্রায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া জেনারেল ইলেকট্রিক গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অন্য এক চুক্তি করেছে।
আঙ্কটাড জানিয়েছে, বিশ্বে ২০১৮ সালে এফডিআই ১৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পর বা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে চলতি বছর এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এফডিআই আরও বাড়বে বলে আশা করছে আঙ্কটাড। সংস্থাটি মনে করে, এই দুই মহাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক অঞ্চল এফডিআই আকর্ষণ করছে। বিডা আশা করছে, চলতি বছর শেষে দেশে ৩৭০ কোটি ডলার এফডিআই আসবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল করতে সরকার বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বা বেজা গঠন করেছে। ৩০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ২৪টি নির্মাণাধীন। ৪টি অর্থনৈতিক অঞ্চল আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া আরও ৬০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আগে থেকেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮টি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১টি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগের ৭২ শতাংশ হয়েছে এসব রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে। আর দেশের মোট রফতানি পণ্যের ২০ ভাগ উৎপাদন হচ্ছে এসব অঞ্চলের কারখানা থেকে।