• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

শ্রী শ্রী মেহার কালীবাড়ি : বিশ্বের অদ্বিতীয় দশমহাবিদ্যাসিদ্ধ পীঠস্থান

প্রকাশ:  ০৮ জুন ২০২৩, ১১:২৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

বিশ্বের অদ্বিতীয় দশমহাবিদ্যাসিদ্ধ পীঠস্থান চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার মেহারে অবস্থিত। যা বর্তমানে শ্রীশ্রী মেহার কালীবাড়ি নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচিতি লাভ করেছে।
নিজমেহার গ্রামে অবস্থিত এক অনন্য সাধারণ শক্তিপীঠ, এক পরম পুণ্যময় স্থান। মেহার কালীবাড়ি সমগ্র বিশ্বের মধ্যে একমাত্র দশ মহাবিদ্যা সিদ্ধপীঠস্থান। ১৪২৬ খ্রিস্টাব্দে পৌষ সংক্রান্তি শুক্রবার রাত্রির শেষ প্রহরে মেহার কালীবাড়িতে তান্ত্রিকা আচার্য্য ঠাকুর সর্বানন্দদেব সাত জনম তপস্যার পর অষ্টম জনমে এসে মায়ের দশ মহাবিদ্যা রূপ দর্শন করেন। এর পূর্বে একমাত্র দেবাদিদেব মহাদেবই দক্ষযজ্ঞে মায়ের দশ মহাবিদ্যা রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
তৎকালে দাস বংশীয় রাজাগণ মেহার পরগনা শাসন করতেন। রাজাদের মধ্যে একজন ছিলেন শিবানন্দ দাস। রাজা শিবানন্দ 'দাসের গুরুদেব ছিলেন বাসুদেব ঠাকুর। যার আদি নিবাস ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার অন্তর্গত সুরধনী নদী তীরবর্তী সিংহলদী গ্রাম। বাসুদেব ভট্টাচার্য্য ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং মাতৃসাধক। একদিন তিনি তাদের ভৃত্য পূর্ণানন্দ সহ গঙ্গাতীরে বসে মায়ের শ্রেষ্ঠ মন্ত্র জপ করছিলেন। এমন সময় দৈববাণী হলো : “হে দ্বিজ শ্রেষ্ঠ! বঙ্গদেশে মেহার নামক স্থানে তোমার বংশে কেহ সিদ্ধিলাভ করবে”। দৈববাণী প্রাপ্ত হবার পর বাসুদেব ঠাকুর কালবিলম্ব না করে সপরিবারে মেহার চলে আসেন। মেহারে আসার পর রাজা শিবানন্দ দাস বাসুদেব ঠাকুরকে গুরুপদে বরণ পূর্বক প্রশস্ত নিষ্কর ভূমিতে বাসস্থান তৈরি করে দেন। পূজা অর্চনা, ধ্যান, জপ করে বাসুদেব ঠাকুরের দিন ভালভাবেই কাটতে লাগলো। বিপ্র বাসুদেবের প্রতি পুনরায় দৈববাণী হলো : ''ভূত্য পূর্ণানন্দ সহ তুমি কামাক্ষ্যা মায়ের মন্দিরে গিয়ে মায়ের সাধনা কর।” বাসুদেব ঠাকুর কামাক্ষ্যা মন্দিরে গিয়ে মায়ের সাধনা করতে লাগলেন। আবার দৈববাণী হল, “এ জনমে তোমার মনষ্কামনা সিদ্ধ হবে না। পুত্রের ঔরসে পৌত্ররূপে বঙ্গদেশের মেহার নামক স্থানের জীনবৃক্ষ মূলের সন্নিকটে পুরাকালে মাতঙ্গ মুনি যে মতদেশিবলিঙ্গ (কলিতে অপ্রকাশ্য) সংস্থাপন করেছেন, ওই স্থানে অর্ধরাত্রে বারোহনে মন্ত্র সাধনা করলেই সিদ্ধিলাভ হবে। প্রত্যক্ষ হবো আমি।'' বাসুদেব দৈববাণীর কথা সবিস্তারে ভৃত্য পূর্ণানন্দকে জানান। তিনি তৎক্ষণাৎ যোগবলে দেহত্যাগ করেন এবং অচিরেই তারই পুত্র শম্ভুনাথের ঔরসে পৌত্ররূপে মেহারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিণত বয়সে যিনি পরিচিত হলেন ভুবন বিখ্যাত তান্ত্রিকাচার্য্য ঠাকুর সর্বানন্দদেব হিসেবে। শম্ভুনাথের চারপুত্রের মধ্যে সর্বানন্দদেব ছিলেন দ্বিতীয়। সহজ, সরল, সদাচিন্তামগ্ন উদাসীন ও অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন সর্বানন্দদেব। অগ্রজ আগমাচার্য্য ছিলেন দাস রাজভার পণ্ডিত। আগমাচার্য্যরে অনুপস্থিতিতে একদিন সর্বানন্দদেব আগমাচার্য্যের প্রতিনিধি হিসেবে রাজসভায় যোগদান করেন। উপস্থিত পণ্ডিত মণ্ডলী রাজার সামনে সর্বানন্দকে প্রশ্ন করলেন, 'ঠাকুর আজ কোন্ তিথি?’ নির্ভীকভাবে সর্বানন্দব বললেন ‘আজ পূর্ণিমা।’ প্রকৃতপক্ষে সেদিন ছিল পৌষ সংক্রান্তির অমাবস্যা তিথি। পণ্ডিতমণ্ডলী অট্টহাসি হেসে বললেন, 'তুমি রাজার গুরু অথচ এমন মূর্খ। বাড়ি গিয়ে লেখাপড়া শেখ'। সজল নয়নে সর্বানন্দ বাড়ি ফিরে আসলেন। সর্বানন্দের মুখে রাজসভার বিবরণ শুনে বাড়ির লোকজন খুব তিরস্কার করলেন। এমনকি তাকে খেতে দেওয়া ভাতের সাথে ছাই দেয়া হয়েছিল। এ সমস্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সর্বানন্দের অন্তর মূর্খতার জন্যে দগ্ধ হতে লাগলো। তিনি লেখাপড়া শিখে মূর্খতা দূর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন এবং তালপাতা সংগ্রহের জন্যে তালগাছে উঠলেন। এমন সময় সন্ন্যাসী বেশধারী দেবাদিদেব মহাদেব অনেক অনুনয় বিনয় করে সর্বানন্দকে তাল গাছ থেকে  নামালেন। তখন সন্ন্যাসী সর্বসিদ্ধ মন্ত্র সর্বানন্দের কর্ণে প্রদান করে বললেন, বঙ্গদেশ শিবলিঙ্গ যে স্থানে ছিল ওই স্থানে শবারোহনে এ মহামন্ত্র জপ করলে তোমার মনস্কাম পূর্ণ হবে। এদিকে পূর্ণানন্দ কামাক্ষ্যা মন্দির থেকে মেহারে ফিরে আসলেন। পূর্ণানন্দ আসলে একজন ভৃত্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন দেবী পার্বতীর একনিষ্ঠ ভক্ত। অষ্টম জনমে সর্বানন্দের সিদ্ধিলাভ করার পরে সাধনসঙ্গী হিসেবে দেবী পার্বতী পূর্ণানন্দকে সর্বানন্দের ভৃত্য হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। সারাদিন সর্বানন্দকে না দেখে বাড়ির অন্যান্য লোকের ন্যায় পূর্ণানন্দও সর্বানন্দের খোঁজে বের হলেন। হঠাৎ বনমধ্যে দুজনের দেখা হলো। দুজনে মিলে গভীর বনে জীনবৃক্ষ মূল খুঁজতে লাগলেন। অমাবস্যার গভীর রাতে ঐ বনে তপস্যারত হযরত রাস্তি শাহ নামক একজন আউলিয়ার নির্দেশিত পথ ধরে তারা সাধনার স্থান খুঁজে পেলেন। অতঃপর সর্বানন্দের মনে সাহস সঞ্চার করে যোগবলে পূর্ণানন্দ নিজ দেহ থেকে আত্মাকে পৃথক করলেন। পূর্ণানন্দের পরামর্শ মত সর্বানন্দদেব পূর্ণানন্দের শবের ওপর উপবেশন করে মহাদের প্রদত্ত সর্বসন্ধি মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। সর্বানন্দের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে রাত্রির শেষ প্রহরে ইষ্টদেবী ষোড়শী চতুর্ভুজা ভক্ত বৎসলা মা ত্রিপুরা সুন্দরী আবির্ভূতা হলেন। মায়ের দর্শন পেয়ে সর্বানন্দ মায়ের স্তব করতে লাগলেন। স্তবে তুষ্ট হয়ে মা সর্বানন্দকে বললেন, আমি তোমার স্তবে তুষ্ট হলাম। তুমি তোমার অভিপ্রেত বর প্রার্থনা কর। সর্বানন্দ বললেন, তোমার শ্রীচরণ পাদপদ্ম দর্শনে আমার সকল বর লাভ হয়েছে। তথাপি যদি তুমি বর দিতে চাও, আমি কিছুই অবগত নই। শবাসনে শায়িত পূর্ণদাদা জানে। দেবীর কৃপায় পূর্ণানন্দ সচেতন হলো। অতঃপর সর্বানন্দ ও পূর্ণানন্দ ভক্তিযোগে দেবীর দশরূপ দর্শনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলে দেবী এক এক করে তাঁর দশরূপে ভক্তের সম্মুখে প্রত্যক্ষা হলেন। উভয়ে মায়ের স্তব স্তুতি করে, আবারও প্রার্থনা দর্শন দান কর।' ভক্তবৎসল মা দু ভক্তকে তাঁর দশমহাবিদ্যারূপের একত্রে দর্শন দান করেন। এ যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শনের সমতুল্য। সর্বশেষ পূর্ণানন্দের মুখে রাজসভায় সর্বানন্দের অপমানের কথা শুনে মা তাঁর পবিত্র বাম হস্তের কনিষ্ঠাঙ্গুলির নখ দ্বারা ঘোর অমাবস্যার রাত্রিতে কলঙ্কবিহীন পূর্ণিমার চাঁদে জগৎ আলোকিত করলেন এবং মা জগৎবাসীকে দেখিয়ে দিলেন তাঁর ভক্ত সর্বানন্দ মূর্খ নয়। ধন্য মেহার। ধন্য মেহারের মাটি। ধন্য মেহারের জীনবৃক্ষমূল বনরাজি। মেহারের মাটিতে মাতঙ্গমুনি মা ভবানী দেবীর মন্ত্র সিদ্ধির নির্মিত প্রতিষ্ঠা করেন মতদেশ শিবলিঙ্গ। যা কলিতে পাতালগামী মেহারের মাটিতে পদস্পর্শ করেন দেবাদিদেব মহাদেব। একই দিনে এ মাটিতে প্রত্যক্ষা হন মা রাজরাজেশ্বরী মেহার। উদ্যানেই মা তাঁর দশবিধ রূপ পৃথক এবং একত্রে দর্শন করান ভক্তপ্রবর সর্বানন্দ ও পূর্ণানন্দকে। তাই ভুবনেশ্বরী মাতা মেহারেশ্বরী নামেও দেশে বিদেশে পরিচিত। ঠাকুর সর্বানন্দ দেবের সিদ্ধিলাভের পর হতে এ পুণ্যভূমি বিশ্বের সর্বত্র দশমহাবিদ্যাসিদ্ধ পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। ওই দিনেই সর্বাানন্দ হয় বাকসিদ্ধ। মেহার হয়ে যায় বিশ্বের এক মহাতীর্থ।
এখানে প্রতি বছর দীপাবলি (শ্যামা পূজা), পৌষসংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ, দশমহাবিদ্যা পূজা, দুর্গা পূজা, বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত দূর দূরান্ত হতে আগত ভক্তরা মায়ের আশীর্বাদ নিতে ছুটে আসে। ভক্তদের দুুপুরে অন্ন ভোগ বিরাজের ব্যবস্থা রেখেছে পরিচালনা পর্ষদ। তবে এই ভোগের প্রসাদের জন্য ১/২ দিন পূর্বে পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বশীলদের জানাতে হয়।
যাতায়াত ব্যবস্থা : বাসযোগে শাহরাস্তি গেইট (দোয়াভাঙ্গা) ও রেলযোগে মেহের স্টেশন এবং লঞ্চযোগে চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনাল, তারপর বাসস্ট্যান্ডে এসে বোগদাদ বাসে শাহরাস্তি গেইট (দোয়াভাঙ্গা) নেমে অটোরিকশা যোগে মেহার কালীবাড়ি নামতে হবে।
লেখক পরিচিতি : সাংবাদিক ও লেখক; সাধারণ সম্পাদক, শাহরাস্তি প্রেসক্লাব।

সর্বাধিক পঠিত