স্টিমারে ঢাকা-চাঁদপুর আনন্দ ভ্রমণ
নৌপথে ভ্রমণ আসলেই আনন্দের। লঞ্চ, স্টিমার, জাহাজ হলে তো কোন কথাই নেই। দেশের বেশকয়েকটি অঞ্চলে নৌপথে ভ্রমণ করার সুযোগ রয়েছে। স্টিমার প্রাচীন নৌযান হলেও এর ভ্রমণ খুবই আনন্দদায়ক। বিস্তারিত জানাচ্ছেন মরিয়ম আক্তার-
মামার মুখে স্টিমার ভ্রমণের আনন্দের কথা অনেক শুনেছি। শুনেছি স্টিমারের পূর্ব ও বর্তমান ইতিহাস। তাই এবার ভেবেছি, যেভাবেই হোক স্টিমার ভ্রমণের আনন্দটা উপভোগ করবই। কিন্তু লঞ্চের মত প্রতিদিন স্টিমার ছাড়ে না। স্টিমার ছাড়ার সময় প্রতি শনিবার, রোববার, মঙ্গলবার ও বুধবার। আমাদের ঢাকা থেকে সোমবার ফেরার কথা থাকলেও স্টিমার ভ্রমণের জন্য সোমবার বিরতি দিয়ে মঙ্গলবার রওনা দিয়েছি। সন্ধ্যা ছয়টা ত্রিশ মিনিটে স্টিমার ছাড়ার সময়।
ভ্রমণ কথাটি স্বভাবতই প্রফুল্লপূর্ণ। বাংলাদেশের মানুষ ভ্রমণপ্রিয়াসী। আর সে ভ্রমণ যদি হয় নৌপথে, তাহলে তো কোন কথাই নেই। নৌপথে লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সাধারণত কম-বেশি সবারই থাকে। কিন্তু স্টিমার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সবার ভাগ্যে জোটে না। আমরা ছয়টার মধ্যেই ঢাকার সদরঘাট পৌঁছে গেলাম। মনের ভেতর একটি কৌতূহলী আনন্দ। জীবনের প্রথম স্টিমার ভ্রমণের আনন্দ। মামা আমাদের জন্য তিনটি টিকিট কেটে দিয়েছেন। আমি, আমার মা, আর ছোট ভাই। মামা আমাদের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির ননএসি কেবিন ভাড়া করে দিলেন। ছয়টা ত্রিশ মিনিটে স্টিমার ছেড়ে দিয়েছে। মামা আমাদের স্টিমারে উঠিয়ে বিদায় জানালেন। আমরা নিজেদের কেবিনে অবস্থান করছি। কিন্তু আমার মন কেবিনে টিকে থাকতে চাইছে না।
পুরো স্টিমারটি ঘুরে দেখার কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসেছে। সাথে আমার ছোট ভাইও। মাকে অনেক বুঝিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে স্টিমারটি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম। যখন রাত আটটা-নয়টা বাজে, স্টিমারটি নারায়ণগঞ্জ শহরকে পাশ কাটিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী পাড়ি দিয়ে মেঘনা নদীতে পৌঁছেছে। আমি স্টিমারের এক কোণায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি চারপাশের ধবল জ্যোৎস্নার আলো। মেঘনা নদীর টলটল জলে যেন চাঁদের আলোয় খেলা বেশ জমে উঠেছে। খুব ভালোই লাগছে আমার।
দেখলাম ডেকের যাত্রীরা কেউ কেউ রাতের খাবার খাচ্ছেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আনন্দ করছে। শুনেছি স্টিমারের বাটলারদের রান্নার খুব সুনাম। তাই বাটলারকে ডেকে রাতের খাবার অর্ডার করলাম। সাধারণত দুই ধরনের সেট মেন্যু থাকে। একটি হলো- ভুনা খিচুরি, চিকেন, ডিম আর অন্যটি হলো- সাদা ভাত, চিকেন আর দু’ পদের ভর্তা। আমরা প্রথম মেন্যুটি অর্ডার করলাম। দাম দুশ’ টাকা। খুব মজা করেই খেলাম।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি আবারও কেবিনের বাইরে চলে এলাম। নদীর তরঙ্গায়িত পানির দিকে একনজরে তাকিয়ে ছিলাম। কোন কূল-কিনারা দেখা যাচ্ছে না। মামার কাছ থেকে শোনা স্টিমারের ইতিহাসের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। এক অজানা কারণে স্টিমারের অন্যতম একটি নাম ‘রকেট’। বিশ্বে যে কয়েকটি স্টিমার রয়েছে, তারমধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে পাঁচটি। এগুলো হলো- মাসহুদ, অস্ট্রিচ, লেপচা, এমবি বাঙালি ও টার্ন।
এমবি বাঙালি সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক। রকেট স্টিমার সামনের দিকে এগোনোর জন্য দুই পাশে বড় বড় দুটি প্যাডেল থাকে। যার জন্য একে প্যাডেল স্টিমারও বলা যায়। শুনলাম, শুরুর দিকে নাকি স্টিমারগুলো কয়লা দ্বারা উৎপন্ন স্টিমে চলতো বলে এর নাম স্টিমার। কিন্তু এখন আর স্টিমে চলে না। অনেকটা এমন যে, ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ, ডিম নয় তবু অশ্বডিম্ব।’
এখন চলে ডিজেলে; তবুও এর নাম রয়ে গেছে স্টিমার। আবার রকেট ডাকা হতো হয়তো তখনকার সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির নৌযান ছিল বলে। নৌপথে চলাচলের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হলো স্টিমার। বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত স্টিমার ডোবার খবর শোনা যায়নি। সৃষ্টিকর্তা যদি না চান, তবে এমন কথা শোনাও যাবে না। কারণ স্টিমার গতিতে লঞ্চ থেকে ধীর হলেও সবচেয়ে নিরাপদ নৌ-পরিবহন।
স্টিমারের আশপাশ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই লঞ্চ আসা-যাওয়া করছে। তার চেয়েও মনমুগ্ধকর দৃশ্য হলো- নদীতে ইলিশ ধরার দৃশ্য। প্রচণ্ড ঢেউয়ে জেলেদের নৌকা যেন ডুবুডুবু করছে। দেখে ভয়ে আমার শরীর শিউরে উঠলো। ছোট ছোট নৌকাগুলোতে নিভু নিভু করে বাতি জ্বলছে। এ সময়ের মধ্যে অনেক যাত্রীর সাথেই আমার পরিচয় হয়ে গেল। খুবই ভালো লাগছিল তাদের সাথে কথা বলে।
এভাবেই আনন্দে সময় কেটে গেল স্টিমারে। কতক্ষণ পরই চাঁদপুর ঘাটে এসে ভিড়ল স্টিমার। তখন রাত প্রায় এগারোটা ত্রিশ মিনিট। চারদিক থেকে মানুষ হুড়মুড় করে আসতে লাগলো। কেউ চাঁদপুর নামবে কেউবা উঠবে স্টিমারে। কেননা স্টিমারের গন্তব্য এখানেই শেষ নয়। স্টিমারের গন্তব্য বরিশালের দিকে। শুনেছি বরিশাল ঘাটে নাকি সকাল সাড়ে ৬টায় ভিড়বে। কিন্তু আমাদের গন্তব্য চাঁদপুরেই শেষ। আমরা কেবিন থেকে ব্যাগ গুছিয়ে বের হয়ে এলাম চাঁদপুর ঘাটে। নদীর ঢেউ, জ্যোৎস্নার আলোর খেলা দেখতে দেখতেই শেষ হলো স্টিমার ভ্রমণ।
লেখক: শিক্ষার্থী, কড়ৈতলী উচ্চ বিদ্যালয়, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।