কুসুমকলিদের ফুটে ওঠা
কিশোর বয়স জীবন বিকাশের সন্ধিক্ষণ। শৈশব অতিক্রম করে এই বয়স থেকে শুরু হয় নিজেকে গড়ে তোলার সচেতন ধারণা। সৃজনশীলতা এই বয়সে স্বপ্নের বিন্যাস। তাই সৃজনশীল কিশোর সময়কে ব্যাপ্ত পরিসরের বহুমুখী পরিচর্যায় ভরে তুলতে হয়। শুরু হয় দিগন্তছোঁয়ার যাত্রা।
আমার শৈশব-কৈশোরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীদের আলোকিত করেছিলেন, সে কথা এখানে উল্লেখ করছি। স্কুলটির নাম ছিল লতিফপুর প্রাইমারি স্কুল। আমার বাবার চাকরি সূত্রে তখন আমরা বগুড়ায় ছিলাম। স্কুল শুরু হওয়ার সময় প্রধান শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বলতেন, আমি দুটি লাইন বলব। তোরা আমার সঙ্গে চিৎকার করে বলবি। তিনি বলতেন, 'পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল / কাননে কুসুমকলি সকলই ফুটিল।'
প্রথম লাইনটি সবাই মিলে চিৎকার করে বলার পরে তিনি হাত তুলে থামাতেন। বলতেন, তোরা হলি পাখি। তোদের জীবন থেকে অন্ধকার দূর হয়ে যাক। তোরা অন্ধকারের বিরুদ্ধে কলরব করবি। পরের লাইন চিৎকার করে বলার পরে তিনি বলতেন, তোরা সবাই কুসুমকলি। তোদের ফুটে উঠতে হবে। প্রকৃত মানুষ হওয়ার সাধনায় ফুটে উঠবি সবাই।
এভাবে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চেতনায়- বোধে সৃজনশীলতার মাত্রা সঞ্চারিত করেন। তাঁর কাছে শিক্ষা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করা নয়। তিনি যাঁদের প্রস্ম্ফুটিত হতে বলেছেন, তাদের মানবিক চেতনায় মানুষ হওয়ার ধারণা দিয়েছেন অনবরত। বলতেন, কেউ যদি প্রাইমারি স্কুলের পরে আর পড়তে না পারে, তাতে কিছু এসে যায় না। তোরা একজন দিনমজুর হতে পারিস, একজন কৃষক হতে পারিস; কিন্তু তোদের খাঁটি মানুষ হতে হবে। অন্যায় কাজ করবি না। চুরি-ডাকাতি করবি না। দাঙ্গা লাগলে ছুরি হাতে দৌড়াবি না। মানুষ খুন করবি না। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
একজন শিক্ষক এভাবে নিজেকে আলোকিত রাখেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক না হয়েও যে কেউ এমন কাজ করতে পারেন। শুধু গান গাইতে পারা, ছবি আঁকতে পারা, লিখতে পারার মতো কাজই সৃজনশীলতা নয়। সৃজনশীলতার বিন্যাস জীবনের সব ক্ষেত্রকে আলোকিত করে। কিশোর বয়স থেকে সৃজনশীলতাকে পরিচর্যা করতে হয়। এ সময় থেকে শুরু হয় বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা। মানবিক চেতনা নিয়ে বড় হতে না পারলে ভুল পথে চলে যাওয়ার ভয় থাকে। এই ভয় থেকে কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েদের রক্ষা করতে হবে। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার পাশাপাশি নিজের নান্দনিক বোধকে তীক্ষষ্ট করার ধারণাটিও সৃজনশীল কিশোরের মাঝে বিকশিত হবে। সৃজনশীলতা জীবনের পরিসরের ব্যাপ্তি ঘটায়। একজন কিশোর নিজের দুয়ারে দাঁড়িয়ে যখন দিগন্ত দেখবে, তখন তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উচ্চতা তাকে আকাশ ছোঁয়াবে। বিস্তৃত হবে তার মেধার জগৎ, যে মেধা দিয়ে সে শুধু জিপিএ ৫ অর্জনে সচেষ্ট থেকে শিক্ষার বাকি দিকটা শূন্য রাখবে না। এখানেই সৃজনশীলতার গুরুত্ব। পারিপার্শ্বিকের নানা দিক নিয়ে তার জিজ্ঞাসার উচ্চারণ তাকে সামাজিকতার বিষয়টি বুঝতে অনুপ্রাণিত করবে।
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, নলেজের চেয়ে ইমাজিনেশন অনেক বেশি পাওয়ারফুল। লেখাপড়া করে জ্ঞান মানুষকে অর্জন করতে হয়। লেখাপড়া না করলে আরাধ্য জ্ঞান অর্জন করা যায় না। কিন্তু ইমাজিনেশন মানুষের সৃজনশীলতার দিক। মানুষ মেধায়-মননে-সাংস্কৃতিক বোধে কল্পনার বিশ্ব অবারিত করে। একজন চাষি যখন নতুন ধানের বীজ খুঁজে পান, তখন তার ধারণাগত বলয় থেকে সে খুঁজে পাওয়া তার কল্পনাশক্তিকে আলোর পথের সন্ধান দেয়। আইনস্টাইন যখন এমসিকিউ সূত্র আবিস্কার করেন, সেখানে চিন্তার জগতের তোলপাড় ওঠে। এভাবে সৃজনশীল কিশোর তার সময়কে নির্মাণ করেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কিশোর জীবনে মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গা নিজে চেতনার আলোকে গ্রন্থিত করেছিলেন। একজন স্কুলের বন্ধুকে বৃষ্টিতে ভিজে আসতে দেখে নিজের ছাতাটি ওকে দিয়েছিলেন। এই চেতনা তিনি পাঠ্যবই থেকে পাননি। নিজের ভেতরের সৃজনের সূত্র থেকে উন্মোচিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু একজন বৃদ্ধকে শীতে কাঁপতে দেখে নিজের গায়ের চাদর খুলে দিয়েছিলেন। এটা সামাজিক সূত্রের বড় জায়গা। মানুষকে আপন ভেবে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
বাংলা ভাষার একজন অসাধারণ লেখক অন্নদাশংকর রায়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছিলেন কালজয়ী কবিতার পঙ্ক্তি- 'যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা / গৌরী যমুনা বহমান / ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।'
ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষের মূল্যায়ন তিনি করেছেন সৃষ্টিশীলতার অসাধারণ মাত্রায়। তার জন্য নির্ধারণ করেছেন ইতিহাসের পৃষ্ঠা।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তিনি যে বইটি লিখেছেন তার নাম- 'কাঁদো প্রিয় দেশ'। এ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : 'গান্ধীজির সংস্পর্শে এসে আমি এই শিক্ষা লাভ করি যে মানুষের প্রাণ রক্ষা করা মানুষের মানবিক কর্তব্য। এখানে রাজনীতির প্রশ্ন ওঠে না। ওঠে না শত্রু-মিত্রের প্রশ্ন। অথবা বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-অহিন্দু, ভারতীয়-অভারতীয়ের প্রশ্ন। কলম হাতে আসার পর থেকে যখনই বিচলিতবোধ করছি, তখনই এ কাজ আমি করেছি, কখনও প্রবন্ধ আকারে, কখনও কবিতা আকারে, কখনও-বা অন্য কোনোরূপে। হয়তো সেটা বন্য হংসীর পশ্চাদ্ধাবন। তলোয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারবে কেন কলম? তা সত্ত্বেও আমি নিরস্ত হইনি। কারণ আমি বিশ্বাস করি যে, তলোয়ারের চেয়ে কলম আরও শক্তিমান।' কলমকে শক্তিমান ভাবার মেধা সৃষ্টিশীলতা থেকে বিকশিত হয়।
বন্ধুত্বের স্বরূপ বোঝা তার সম্প্রীতির বন্ধন তৈরির বড় দিক। বন্ধুত্বের মাঝে বিকশিত হয় সামাজিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদির নানা ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা সৃজনশীল কিশোরের জন্য একটি জরুরি বিষয়। অন্যকে সম্মান প্রদর্শন করা বেঁচে থাকার শর্ত। বন্ধুত্ব এই শর্তকে অমলিন করে। মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো সাহস অর্জন করে। বলতে পারে, চলো সবাই মিলে অন্যায়ের জায়গা পরিহার করি। ন্যায়ের পক্ষে থাকি। সুন্দরের সাধনা করি। সততা দিয়ে মানুষের সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করি। এভাবে পথ চলাকে মসৃণ করতে পারে সৃজনশীলতা। কিশোরদের জন্য এটি একটি অনিবার্য দিক।
বিতর্ক করতে শিখলে যুক্তির ধারণা তৈরি হয়। অপরের বক্তব্যকে যুক্তি সহকারে শোনার মানসিকতা তৈরি হয়। তারপর গ্রহণ-বর্জনের সিদ্ধান্তও তার জন্য সহজ হয়। যুক্তির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখা সৃজনশীলতার বড় পরিসর। যুক্তি মানুষকে বলিষ্ঠ করে। দীপ্ত সচেতন করে। এটাও সৃজনশীলতার অন্যতম দিক। যুক্তিনির্ভর হলে বিপদগামী হওয়ার সুযোগ থাকে না। যুক্তি দিয়ে যেমন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তেমনই অপরের মতামতে সহনশীল হওয়ার ধৈর্য লাভ করার সুযোগ পাওয়া যায়। এভাবে সৃজনশীল চিন্তা মানুষের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখে। শুভবোধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। অন্যায়কে প্রতিরোধ করে। যুক্তির পাশাপাশি কেউ যদি নিজের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটায়, সেটা তাকে এক উচ্চতায় তুলে দেয়। আসামের খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা অনেক বছর আগে দাঙ্গাবিধ্বস্ত আসামের দাঙ্গা থামানোর জন্য নিজের গান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন দাঙ্গায় আক্রান্ত এলাকায় জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও- উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছেন, 'মানুষ মানুষের জন্য- জীবন জীবনের জন্য- একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না'।
সৃজনশীলতার এই মাত্রা মানবসভ্যতার জন্য বিশাল উচ্চারণ। গানের বাণীর সঙ্গে সুরের ধারার সম্মিলনে গায়কের কণ্ঠস্বর মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করলে মানুষ নিজের নৃশংসতা থামায়। এমনকি নিজের নৃশংসতার দিকে চোখ ফেরায়। কাজটি সঙ্গত হয়েছে নাকি অসঙ্গত হয়েছে, এই মূল্যায়ন করারও চিন্তা করতে পারে। নানা কারণে সমাজে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মানুষের বিবেকহীনতা যেমন এসব কাজে সক্রিয় থাকে, অন্যদিকে মানুষের সৃজনশীল মানবিক বোধ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে নৈরাজ্যের অবসান ঘটানোর জন্য। সমাজ এভাবে চলে। কিন্তু যদি সৃজনশীল মানুষরা সংখ্যায় বেশি থাকে, তাহলে নৈরাজ্যের ব্যাপক মাত্রা থেকে রেহাই পায় মানুষ। এ জন্য সৃজনশীলতা পরিচর্যা কিশোর বয়সী ছেলেমেয়ের জন্য খুবই জরুরি।
কিশোর বয়স থেকে বিকশিত হয় মেধা খোঁজার তৃষ্ণা। সৃজনশীলতা এই তৃষ্ণার দিগন্ত বিস্তারিত পরিসর। কিশোর বয়সীদের এই পথে এগোতে হবে। এই পথ খোঁজার বিকল্প পথ আর নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নোবেল পুরস্কারের ভাষণে বলেছিলেন, 'আপনাদের কাছ থেকে আমি যে অর্থ পেয়েছিলাম, তা আমি আমার স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ব্যয় করেছি এবং আমার মনে হয়েছে, আমার এই বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে পাশ্চাত্যের ছাত্ররা যাবে তাদের প্রাচ্যের ভাইদের সঙ্গে মিলিত হতে। তারা একত্রে সত্যের সন্ধানে কাজ করবে। শত শত বছর ধরে প্রাচ্যে যে ভাবসম্পদ তৈরি হয়েছে, তাকে তারা বুঝে নেবে, প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে হৃদয়ঙ্গম করে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে তারা কাজ করবে।'
আন্তর্জাতিক পৃথিবীকে বোঝাও সৃজনশীলতার বড় দিক। কিশোর বয়সীদের নিয়ে পিকেএসএফ যে সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে, নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় কর্মযজ্ঞ। তৈরি হবে প্রজন্ম শুভ-মঙ্গলের ধারায়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
সূত্র : সমকাল।