• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

কোথায় গেলো পত্রমিতালী

প্রকাশ:  ১০ আগস্ট ২০১৮, ২১:৪১ | আপডেট : ১০ আগস্ট ২০১৮, ২১:৪৮
মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
ছবি : প্রতিকী।
প্রিন্ট

পত্রমিতালী বা পেন ফ্রেন্ড কথাটি ক্রমশ আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় বাজারে দেশ-বিদেশের ছেলে-মেয়েদের ঠিকানাসম্বলিত গাইডবই পাওয়া যেতো। ঠিকানা নিয়ে চিঠি লিখতে হতো। চিঠির ইতিবাচক উত্তর এলে ধরে নেয়া হতো মিতালী বা বন্ধুত্ব হয়েছে। পত্রমিতালীর মাধ্যমে বন্ধুত্ব ছাড়াও বিয়ে পর্যন্ত সম্পর্ক গড়াতো। ভিন্ন দেশের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে হলে ইংরেজিতে দক্ষতা প্রয়োজন ছিলো। সেজন্যে এই মাধ্যমে দক্ষতা প্রদর্শনে ইংরেজি শেখার বাধ্যবাধকতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার সুযোগও এনে দিত।


সেই ধারণাটিকে সম্বল করে আজকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক। ফেসবুকের একটি অপশন ম্যাসেঞ্জারে যেন হারিয়ে গিয়েছে পত্রমিতালী। মার্ক জুকারবার্গ, যার বয়স মাত্র ৩২, বাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, পড়াশোনা হার্ভার্ডে আর বিয়ে করেছেন চায়নাতে এবং ফেসবুকের মাত্র ২৮ শতাংশের মালিক এই তরুণটি নাকি বর্তমান পৃথিবীর ৬ষ্ঠ ধনকুবের ও ১১তম ক্ষমতাধর ব্যক্তি। প্রযুক্তিতে তার এই নতুন মাত্রা সংযোজনে আমরা অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেখাপড়া, যোগাযোগ, শিল্পকলা, নন্দনতত্ত বহুকিছুতে খুব সহজেই প্রবেশাধিকার ও কর্ম সম্পাদনের সুযোগ পাচ্ছি। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা অতি দ্রততম সময়ের মধ্যে নানাকিছুর আদান-প্রদান করতে পারি। ফেসবুকের অপব্যবহারও যে হচ্ছে না, তা নয়। এর নেতিবাচক ব্যবহার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি একটি আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। পত্রমিতালীর স্থানটি এখন ম্যাসেঞ্জার এমনভাবে দখল করেছে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ তার বন্ধুর প্রেরিত ছবি বা চিঠি দেখতে পারে না। তদুপরি, প্রতিনিয়ত আপডেট ভার্সন আসছে বিভিন্ন নামে। যেমন : হোয়াটস অ্যাপ, লাইন, উইচেট, ইমু, স্কাইপি, ভাইবার, টেঙ্গু, ফ্রিং, বিগু প্রভৃতি।
বিনোদনের একটি মাধ্যমও ছিল পত্রমিতালী। আশির দশকে এটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। যেমন : এখনকার কোনো তরুণকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, টাইপরাইটিং মেশিন দেখেছো? অধিকাংশ তরুণই হয়তো উত্তর দেবে নেতিবাচক। তেমনি পত্রমিতালী সম্পর্কেও আজকের তরুণরা নিরুত্তর।
তবে পত্রমিতালীর আবেদন আমাদের স্মৃতি থেকে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। গতবছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বিতর্ক পরিষদের একটি অনুষ্ঠানে ‘বন্ধুত্বের একাল-সেকাল’ অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। আগে বন্ধু যদি বাড়িতে আসতো, সব কিছু বন্ধ রেখে বন্ধুর আদর-যতে নিয়োজিত হতো বাড়ির সবাই। আর আজ কৃত্রিমতায় ভরপুর এই সমাজে বন্ধুর সাথে দেখা হলেও নানা বাহানা ও মিথ্যাচার করে তাকে এড়িয়ে যাওয়াই যেন আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
বন্ধুত্বের সেই জাগয়াটিকে ফিরিয়ে আনা দরকার। অকৃত্রিম বন্ধুত্ব আমরা আবারও ফিরে পেতে চাই। ফেসবুকের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি, ১০ লক্ষ বন্ধু তৈরি করা কোন অলৌকিক ঘটনা নয়, অলৌকিক ঘটনা হলো ১ জন বন্ধু তৈরি করা, যে ১০ লক্ষের মোকাবেলায় তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে। এমন বন্ধুত্ব এখনও হারিয়ে যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনষ্টিটিউটের প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, তার প্রতি তার এক বন্ধুর অবদানের কথা। বললেন- ফাইনাল পরীক্ষার দিন মা মারা গেলেও সেকথা বন্ধু তাকে জানায়নি। পরীক্ষার পর জানিয়েছে। কারণ, বন্ধুর স্বপ্ন ছিল আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হব। সে বুঝতে পেরেছিল, দুঃসংবাদটি পেলে আমি আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণই করতাম না।
এমন বন্ধু খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যাবে। এমন বন্ধুত্বের মধ্যে কার্লমার্কস’র বন্ধু ফ্রেডারিক এঙ্গেলস্ এর নাম উল্লেখ করা যায়। জীবদ্দশায় যথেষ্ট সহযোগিতার পরও কার্লমার্কস’র মৃত্যুর পর তাকে ও তার লেখনীকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করতে লাশের সামনে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে এঙ্গেলস্ বলেন, পৃথিবীর এই বিশাল জনরাশি থেকে একটি মাত্র প্রাণ হারিয়ে গেল, যে কিনা ছিল বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষ। এই কথাগুলোই কার্লমার্কস্কে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়। কৌতূহল সৃষ্টি হয় তার লেখা বই পড়তে। কেউ কেউ বন্ধুর কল্যাণে সীমাহীন আত্মত্যাগের উদাহরণ রেখে গিয়েছেন জগৎবাসীর জন্য। এমনকি কেউ কেউ বন্ধুকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে বিপদ-আপদ নিজে বরণ করতেন হাসি মুখে। আগামী দিনে সুন্দর পৃথিবীর জন্য এমন নিবেদিত কিছু বন্ধু চাই। পত্র মিতালী হারিয়ে গিয়েছে, যাক। যেন অকৃত্রিম বন্ধুত্ব হারিয়ে না যায়।

 

সূত্র : ইত্তেফাক

সর্বাধিক পঠিত