আওয়ামী লীগ: বাঙালির নেতৃত্বে, বাঙালির জন্য, বাঙালির পক্ষে
উপমহাদেশের যে ক’টি রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট কিছু অর্জন রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগকে আমরা বলতে পারি অন্যতম ‘চ্যাম্পিয়ন’ একটি রাজনৈতিক দল, যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। একথা বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও রয়েছে আওয়ামী লীগের অবদান। এরসঙ্গে কেবল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকেই তুলনা করা যেতে পারে, এর বাইরে আর কোনও রাজনৈতিক দল দেখা যায় না, যাদের একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অতীত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ ৬৯ বছরে পা রাখছে, দলটি নিঃসন্দেহে সবার কাছ থেকে অভিনন্দন পাওয়ার দাবি রাখে।
১৯৪৯ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারত-উপমহাদেশের পাকিস্তান রাষ্ট্রে কেন একটি ধর্মবাদী রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমের বাইরে একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি আলোচনা করতে গেলে বিশদ লিখতে হয়। তবে এক কথায় বলতে গেলে একথা বলতেই হবে, জিন্নার নেতৃত্বে যে মুসলিম লীগ ভারত ভাগে নেতৃত্ব দিয়েছে, তার ওপর আর কেউ আশা-ভরসা রাখতে পারছিল না। বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম সমাজ। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে জিন্নার অবস্থানকে কেউ কেউ এর অন্যতম কারণ হিসেবে ভাবলেও মূল কারণটি সেটি ছিল না যে, মুসলিম লীগে মূলত বাঙালি ‘ভয়েস’ ভারত থেকে পাকিস্তানকে ছিনিয়ে এনেছিল সেখানে তারাই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠছিলেন। আর সে কারণেই বাঙালির নেতৃত্বে, বাঙালির জন্য, বাঙালির পক্ষে কাজ করার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অসীম হয়ে উঠেছিল। এরই ফলে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তাতেও যে সমস্যা ছিল, তা মাত্র ছয় বছরের মাথায় উপলব্ধি করে দলটি নিজের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটিকে বাদ দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক ও বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাধা-বিঘ্ন তাতে কম আসেনি, কিন্তু নাম বদলে দলটি যে সব দাবি নিয়ে বাঙালির সামনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে শুরু করে, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি, একটি সংবিধান, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং সর্বোপরী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন। এসব দাবিকে জোরালো করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাকি দলগুলোকে একত্রিত করে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম গঠন করতেও দলটি কখনও দ্বিধান্বিত হয়নি। যুক্তফ্রন্ট নামে যে শক্তিটি পাকিস্তানের ভীতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তারা যদি আরও কিছুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারতো, তাহলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। কিন্তু সে সুযোগ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেয়নি।
শুধু তাই-ই নয়, আওয়ামী লীগ যাতে ঐক্যবদ্ধ না থাকতে পারে, সে লক্ষ্যেও পাকিস্তানি শাসকরা কাজ করে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি তার নিজস্ব রাজনৈতিক নেতারা সমেত দল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। এরপরও আওয়ামী লীগ টিকে আছে, দাঁড়িয়ে থেকেছে বাঙালির রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক আর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে মুখে নিয়ে। ৬-দফাকে সামনে নিয়ে যে আন্দোলন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সঙ্গী নেতারা শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতা যে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও তারই ফলে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এখন আর সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে মাত্র ৩ বছর ১ মাস আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন ছিল, তার মধ্যে ১৩ মাস সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হিসেবে ছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা যে পরিমাণ জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তার তুলনাও এই উপমহাদেশে বিরল। এক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তার জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাবন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন। মাত্র ৫৪ বছর বেঁচেছিলেন তিনি। সে হিসেবে বাংলাদেশে কেন পৃথিবীর অনেক দেশেই তার মতো স্বাধীনতা-সংগ্রামীর উদাহরণ পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মতো একটি ইতিহাস-সমৃদ্ধ রাজনৈতিক দলই কি খুঁজে পাওয়া যাবে? আজকে যারা আওয়ামী লীগকে পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় দেখে মনে করছেন, দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে; তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, দীর্ঘ ৬৯ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল কত বছর? আর কত বছর দলটি বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে?
আগেই বলেছি যে, পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ মাত্র তিন বছর এক মাস রাষ্ট্র ক্ষমতায় দায়িত্ব পালন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সর্বস্তরের বাঙালির অর্জন। এই অর্জনে নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ থাকলেও দেশের আপামর জনসাধারণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে দ্রুত যে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়, তা ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি অভাবনীয় অর্জন। শূন্য থেকে দেশের জিডিপি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ মতান্তরে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা চাট্টিখানি কথা নয়। একইসঙ্গে পরাজিত পাকিস্তান ও পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবের বিরুদ্ধবাদী আচরণ বাংলাদেশকে যে ক্ষতির মুখোমুখি করে তুলেছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তা বাংলাদেশের যেমন ছিল ভয়ঙ্কর, তেমনই দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য সময়টা ছিল নিষ্ঠুরতার কাল। এখনও আওয়ামীবিরোধী অপপ্রচারে যে কথাটি সবার আগে উচ্চারিত হয়, তাহলো ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা তখন কোমর বেঁধে নেমেছিল, তারা আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতেই চেয়েছিল। তারা সফলতা অর্জন করে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশে সামরিক শাসন-যুগের সূচনাও করে।
অনেকেই মনে করেছিল, আওয়ামী লীগের পক্ষে আর টিকে থাকা সম্ভব হবে না। প্রথম সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগকে কেবল তার শত্রু মনে করেই বসে ছিলেন না, সরকারি খরচে রাজনৈতিক দল গঠন করে, স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে রাজনীতির মাঠে ‘মুড়ি-মুড়কি’র একদর করে দেন। একইসঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অতীতকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করেন। দুর্নীতিকে এমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন যে, এরপর থেকে দুর্নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজনৈতিক নেতা ক্রয়-বিক্রয়ের হাট বসিয়ে দেন তিনি এদেশে। ঠিক তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ করার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, কারণ কেউই মনে করেননি–আওয়ামী লীগ আর কোনোদিন ক্ষমতায় ফিরতে পারবে। জিয়ার পর জেনারেল এরশাদ আরেক কাঠি সরেস, আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব শেখ হাসিনাকে এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী একাধিকবার হত্যা চেষ্টা করেছে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই যে, জিয়া-গঠিত রাজনৈতিক দলটিও সেই চেষ্টাই অব্যাহ রাখে। সেটি ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার কৌশল। পঁচাত্তরের পরে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, ইতিহাস আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল বলে কেউ মনে করেন না। তবু কী করে দলটি টিকে রইলো? একাধিকবার ক্ষমতায় আসতে পারলো?
এই প্রশ্নের উত্তরও মূলত দীর্ঘ। কিন্তু সহজ কথায় বলতে গেলে একথা আওয়ামী লীগের শত্রু-মিত্র দুই পক্ষই স্বীকার করবেন যে, আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই কখনও গণবিচ্ছিন্ন হয়নি। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে জনগণের সঙ্গে দলটির তৈরি হয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই সম্পর্ক দলটি ক্ষমতায় গেলে একটু ক্ষুণ্ন হয় বটে কিন্তু এখনও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের হাতেই দলটির নেতৃত্ব থাকায় এই বিচ্ছিন্নতা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে না, দ্রুত দলটি আবার জনগণের কাছে ফিরে যায়। অনেক সময় কিছু সিদ্ধান্ত জনগণের মতের বাইরে গিয়ে নিলেও অতি দ্রুত সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করে নেয় আওয়ামী লীগ। বিস্ময়কর যে, দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পরও যতখানি জনরোষে পড়ার কথা (উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে বলা যায়) কোনও রাজনৈতিক দলের, ঠিক ততখানি জন-বিরোধিতার মুখে আওয়ামী লীগ এখনও পড়েনি। এর অর্থ এটাই যে, ক্ষমতায় গিয়েও দলটি জনগণের কাতার থেকে সরে যায় না।
আওয়ামী লীগের কি দোষ নেই? আছে এবং সেই তালিকাও দীর্ঘ। কিন্তু আজকে তাদের দোষ নিয়ে লিখতে বসিনি। মজার ব্যাপার হলো, দলটিকে গালাগাল দিয়ে সকাল-বিকাল নাস্তা করতে না পারা মানুষের তালিকাও বিশাল। আবার কিছু চাইতে হলে, দেশের জন্য কিছু পেতে চাইলে তারাও আসলে আওয়ামী লীগের ওপরই নির্ভর করেন। এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দলটির প্রবল শত্রুও একথা স্বীকার করে যে, বাংলাদেশে একমাত্র আওয়ামী লীগই আছে, যাদের রয়েছে একটি সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অতীত। সরকারি অর্থায়নে, ক্ষমতায় ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই দলটি জন্মেছে। টিকে আছে। এ কারণে দলটিকে বিরোধী দলেই বেশি মানায় বলেও কেউ কেউ বলে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের মৌলিক অর্জন যা কিছু, তাও যে আওয়ামী লীগের হাত ধরেই সেটুকু স্বীকার না করলেও মিথ্যাচার করা হবে।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী? এ রকম প্রশ্ন দিয়ে যদি নিবন্ধটি শেষ করি, তাহলে এর উত্তরে বলতে হয় যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যেমন, আওয়ামী লীগেরও ভবিষ্যৎ তেমনই। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ একই রেখায় চলমান–কখনও সমান্তরাল, কখনও মিলে-মিশে একাকার।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি
[email protected]