গৌরবের সৌধের পবিত্রতা রক্ষা করা যাচ্ছে না
সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রতিদিন আসেন হাজার হাজার মানুষ। সরেজমিন দেখা যায়, স্মৃতিসৌধের প্রথম গেটে আসার আগেই এবং তিন নাম্বার গেটের আশপাশে দেয়ালে অনেকে মলমূত্র ত্যাগ করছে প্রতিনিয়ত। স্মৃতিসৌধ ঢাকা-আরিচা মূল মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ার ফলে এমন দৃশ্য নজরে পড়ে। ফলে ইতিহাস ও গৌরবের স্থান সম্পর্কে জানতে শিশুদের আগ্রহ থাকছে না।
স্মৃতিসৌধের প্রায় চার দিকেই রয়েছে লেক। লেকগুলোর বেহাল অবস্থা। দেখা যায় লেকে গাছের পাতা ও ময়লা পড়ে পানি দূষণের মাত্রা এমন হয়েছে যে ভাসমান লাল শাপলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। দূষণের মাত্রা অধিক হওয়ার ফলে লেক ইজারা নেয়া মানুষের লোকসান গুনতে হচ্ছে। স্মৃতিসৌধ এলাকাতে অনেক স্থানে শ্যাওলা জমে চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। পরিষ্কার কর্মীদের এসব পরিষ্কার করতে দেখা যায় না মাসের পর মাস। সরেজমিন দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে গাছের পাতাসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারের অবশিষ্টের স্তূপ। এতে স্মৃতিসৌধের ভিতরে কিছু কিছু স্থান দিয়ে চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে।
স্বল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা : বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত হলেও স্মৃতিসৌধ এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে হতাশ জনসাধারণ। স্মৃতিসৌধের সব থেকে কাছের এলাকা নবীনগরের কুড়গাও এবং ডেন্ডাবর। এই এলাকার কিছু সংখ্যক বখাটের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় স্মৃতিসৌধের মতো স্থানে। দূর থেকে আসা মানুষগুলো তাদের মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। স্মৃতিসৌধের পিছনের পশ্চিম অংশে তাদের উপদ্রবের শিকার হন বেশিরভাগ মানুষ। স্মৃতিসৌধের ভিতরে নিরিবিলি স্থানে দুজন ছেলে, মেয়েকে একসঙ্গে পেলে তাদের সর্বস্ব লোপাটের ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত।
বিশেষ দিনগুলোতে মানুষের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। তবে বিশেষ দিনগুলোতে এই চক্রগুলো ভিন্ন পন্থা অনুসরণ করে থাকে। স্মৃতিসৌধের মূল ফটকেট সামনে এবং ভিতরে যেমন করে লুট, তেমনি তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ঘুরতে আসা মেয়েরা। দেশ ও দেশের মানুষের গৌরবের ইতিহাস ধারণ করা পবিত্র স্থানে এসে নিজে অসম্মানিত হয়েও মুখ খুলতে চান না ভুক্তভোগীরা।
নেশাখোরদের আনাগোনা : লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের সম্মান নষ্ট করছে কিছু বখাটে যুবক। নেশাগ্রস্ত যুবকদের দেখা মিলে স্মৃতিসৌধে। তারা বেশিরভাগ সময় নিরিবিলি স্থানে গ্রুপ আকারে নেশা গ্রহণ করে থাকে। স্মৃতিসৌধে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য সুজন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এখন এমন ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। স্মৃতিসৌধের ভিতরে আমাদের নিয়মিত টহল থাকে। তবে দেয়াল টপকে কিছু ছেলে প্রবেশ করে নেশা করতে পারে, এমন কিছু হলে আমরা দ্রুত তা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সাভারের মালেক হাসান বলেন, স্মৃতিসৌধ এলাকার সব থেকে বড় সমস্যা হল, যে কোনো স্থানে আশপাশের এলাকার ছেলেদের নেশা করা। এদের প্রভাব এত বেশি যে অনেক সময় নেশার টাকার জন্য ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে এখানে।
চরম অব্যবস্থাপনা ও যত্নহীনতা : ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে সাভার, নবীনগরে ৮৪ একর জমির উপর স্থাপিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। দেখা যায় স্মৃতিসৌধের বিশাল এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ করতে নিয়জিত কর্মচারীদের সন্ধ্যান মেলে না বেশিরভাগ সময়। সংরক্ষিত এলাকার ভিতরে অনেকের বসবাস করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করে সৌধ এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর আগে রঙিন করা হলেও সারা বছর গুরুত্ব থাকে না স্মৃতিসৌধ এলাকার। কোনো কোনো স্থানে দেখা যায় রং উঠে গেছে। মূলত অনেক দিন আগের তৈরি স্থাপনাগুলোকে সংস্কার করা হয় না। কিছু কিছু স্থানে দেয়ালগুলো ভেঙে যাওয়ার অবস্থায় রূপ নিয়েছে। নানামুখী অব্যবস্থাপনার কারণে দিন দিন স্মৃতিসৌধে আসা মানুষের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
টাঙ্গাইল থেকে ঘুরতে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার অ্যাডভোকেট শহিদুল রহমান শাহজাহান যুগান্তরকে সার্বিক বিষয়ে বলেন, স্মৃতিসৌধ আমাদের দেশের মানুষের সব থেকে সম্মানজনক ও গৌরবের স্থান আর এমন অব্যবস্থাপনা সত্যি কষ্টের বিষয়। সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অপমান হবে। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতেও আগ্রহ হারাবে।
সূত্রঃ যুগান্তর