বেহাল দশা শিক্ষাঙ্গনের স্মৃতির মিনারগুলোর
স্বাধীন বাংলাদেশ নামের সঙ্গে সম্পর্কিত বাংলার মানুষের ত্যাগের ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য রক্ত দিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। দেশের জন্য, নিজের মায়ের ভাষার জন্য জীবন দেয়া শহীদদের স্মরণ রাখতে ও সম্মান জানাতে নির্মিত শহীদ মিনার। রাজধানী ঢাকার বিখ্যাত কয়েকটি কলেজের শহীদ মিনারের অবস্থা বেহাল।
ঢাকা কলেজের শহীদ মিনারটি নাজুক : শুধু দেশের শিক্ষার ইতিহাসেই নয়, জাতির ইতিহাসেরও এক অনন্য অধ্যায়ের নাম ঢাকা কলেজ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এ কলেজের ছাত্রদের অবদান গৌরবের বিজয়গাথাকে করেছে মহিমান্বিত। নানা পটভূমির পর ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা কলেজ। ১৭৫ বছর বয়সী ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে নেই কোনো স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ বা কোনো ভাস্কর্য। শহীদ মিনারটিও ক্ষতবিক্ষত। চারদিকে অসংখ্য ফাটলে যেন কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে শহীদ মিনারটি।
ঢাকা কলেজের বর্তমান শহীদ মিনারটি কয়েক বছর আগে ব্যাপকভাবে কাঠামোগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বছরের পর বছর শুধু ফেব্রুয়ারিতে রং মাখিয়ে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কলেজ সূত্র জানায়, ১৯৯৩ সালে কলেজের বর্তমান শহীদ মিনারটি স্থাপন করা হয়। আকারে অত্যন্ত ছোট এ শহীদ মিনারে ২০১৪ সালে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে বেদিটি দেবে যায় এবং বেশ কয়েক জায়গায় বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের কলেজে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের স্বাধীনতা স্মৃতি ভাস্কর্য নেই। আমাদের প্রাণের দাবি কলেজে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হোক। বর্তমানে প্রায় ধসে যেতে বসেছে শহীদ মিনারটি। যেহেতু শহীদ মিনারে যে কোনো ধরনের ছাত্র জমায়েত হয়ে থাকে তাই অতিদ্রুত শহীদ মিনারটি সংস্কার করা প্রয়োজন। না হলে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিনিয়ত শহীদ মিনারে অবমাননা হচ্ছে ভাষা শহীদদের। স্যান্ডেল পরে একেবারে মূলবেদিতে উঠে আড্ডা, গল্প গানসহ চলে রাজনৈতিক ভাষণ। অতিদ্রুত শহীদ মিনারটি নতুন জায়গায় আরও দর্শনীয় করে স্থাপন করার দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শহীদ মিনারের চারপাশে ময়লার স্তূপ আর পানি জমে আছে। মাসের পর মাস পরিষ্কার না করার ফলে শহীদ মিনারের সামনের অংশে শ্যাওলা পড়ছে।
ময়লার স্তূপের চাপা কবি নজরুল সরকারি কলেজের শহীদ মিনার : হাজী মুহাম্মদ মহসিনের হাতে ১৮৭৪ সালে গড়ে উঠা অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবি নজরুল সরকারি কলেজ। ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে লেখা মানুষগুলোর সঙ্গে রয়েছে এ কলেজের শিক্ষার্থীদের নাম। সদরঘাট এলাকার এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনারের অবস্থা অনেকটা ম্লান করে দেয় তাদের সম্মানজনক অবস্থানকে।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির শহীদ মিনারের পাশে ময়লার স্তূপ এবং জলাবদ্ধ অপরিষ্কার অবস্থা। ময়লার পরিমাণ ইঙ্গিত করে প্রতিনিয়ত ময়লা জমা করা হয় শহীদ মিনারের পাশে। অল্প জায়গাতে নির্মাণ করা শহীদ মিনারের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে দিনের পর দিন অবহেলার কারণে। মিনারের সামনের মাঠে বালি ফেলা হয়েছে, ফলে বর্তমানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় খুব সহজে। মিনারের পাশে দেয়াল ভাঙা থাকার কারণে মূল মিনারের বিভিন্ন স্থানে রং নেই বললেই চলে। বছরের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো ছাড়া শহীদ মিনার পড়ে থাকে অবহেলায়। এমন পরিবেশের কারণে শহীদ মিনারের আশপাশে শিক্ষার্থীদের দেখা মেলে না।
এ বিষয়ে কবি নজরুল সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোসফিখা বেগম যুগান্তরকে বলেন, শহীদ মিনারের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা হবে, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সবকিছুর পেছনে কারণ থাকে, প্রতিষ্ঠান পরিষ্কার করার জনবলের অভাবে এমটা হয়েছে। আমাদের উন্নয়ন কাজে বাজেট খুব সীমিত, ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না। প্রতিষ্ঠানের নিজেস্ব অর্থায়নে ছোট ছোট কিছু কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সামনে বিজয় দিবসের আগে শহীদ মিনারের সমস্যাগুলোর সমাধান হবে বলে আশা করি।
মিরপুর বাঙলা কলেজের শহীদ মিনার : রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত সরকারি বাঙলা কলেজ ঐতিহাসিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাংলাকে উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বের বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয় লাভ করলেও ঢাকার মিরপুর হানাদারমুক্ত হয় দেরিতে। মুক্তিযুদ্ধের দগদগে স্মৃতি বহন করছে কালের সাক্ষী মিরপুর বাঙলা কলেজ।
সরেজমিন মিরপুর বাঙলা কলেজের শহীদ মিনারে দেখা যায়, মিনারের চারপাশে দিনের পর দিন ফেলা হয়েছে ময়লা। নতুন স্থাপনা তৈরি করতে বালি রাখা হয়েছে ঠিক শহীদ মিনারের পাশে। শহীদ মিনারে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের জুতাসহ উঠার চিত্র ও দেখা যায়। গৌরবের ইতিহাস বহন করা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থী শহীদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। শহীদ মিনার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, শহীদ মিনারের মূল স্থাপনাটি মাসের পর মাস অবহেলায় পড়ে আছে। চারপাশে ঝোপঝাড়, নোংরা-আবর্জনা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী আঁখি বলেন, শহীদ মিনারে আমাদের যাওয়া হয় না, কারণ পরিবেশ একদম ভালো নয়। কলেজের কিছু ছেলে নিয়মিত ওখানে বসে তাই আমরা যাই না। জুতা নিয়ে শহীদ মিনারে উঠা আমাদের সবার জন্য লজ্জাজনক।
সূত্রঃ যুগান্তর