অনলাইন ক্লাশ এবং ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট অর্জন।
বিশ্বব্যপি কোভিট ১৯ সংক্রমনের ফলে যখন সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে , লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রী যখন অলস সময় কাটাচ্ছে তখন শিক্ষামন্ত্রনালয়ের একটি যুগান্তকারি সিদ্ধান্ত হলো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা টিভি এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য অনলাইনে ক্লাশ নিয়া। এর কোন বিকল্পও ছিল না কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে সেটা ছিল অনিশ্চিত।
মন্ত্রনালয় এবং মাউশির সিদ্ধান্ত মোতাবেক কিছু সংখ্যাক প্রতিষ্ঠান কলেজের নিজস্ব ফেসবুক পেজে বা গ্রুপে ক্লাশ নেয়া শুরু করে। এতে করে প্রথম পর্যায়ে ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেলেও সময় অতিক্রান্তের সাথে সাথে অনলাইন ক্লাশের প্রতি ছাত্র ছাত্রীদের আগ্রহ বেড়েছে এবং ক্লশে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের অনেকগুলো দেশ প্রতিষ্ঠান বন্ধকালীন সময়ে অনলাইনে ক্লাশ নিশ্চিত করেছে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অনলাইনে ক্লাশের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট অর্জনে অনলাইন ক্লাশের কোন বিকল্প নেই। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বাংলাদেশে জন্য একটি সুযোগ। একটি দেশের জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক কাঠামো অনুযায়ী কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৫৯ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে) ছাড়িয়ে যায় তখন সে দেশে একটি সুযোগের সৃষ্টি হয় ।
জনসংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন সোনালি সময় পার করছে। আমাদের নির্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি। জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী এখন শতকরা ৬৮ ভাগ। জনমিতির পরিভাষায় এটাই হলো একটি দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ। কোন জাতির ভাগ্যে এ ধরনের জনমিতিক সুবর্ণকাল একবারই আসে যা থাকে কমবেশি ৩০-৩৫ বছর। বাংলাদেশ এই সোনালি সময়ে পদার্পণ করেছে ২০১২ সাল থেকে যা শেষ হবে ২০৪০ এর দিকে।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব ফেলে। এজন্য অনেক চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই একটি দেশকে জনসংখ্যার এই সুযোগ নিতে হয়। চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় সফলতার ওপরই নির্ভর করে এই সুযোগ কতটা জাতির জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। তাই জনগোষ্ঠীর কর্মক্ষম বিশাল অংশকে মানবসম্পদে পরিণত করে উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে কাজে লাগানোই মুখ্য বিষয়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়টিই বার বার বলার চেষ্টা করেছেন। এর ওপরই নির্ভর করে জনমিতির সুযোগ ঘরে তোলা না তোলা। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সে প্রেক্ষাপটে বলেছেন আমাদের তরুন প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ট অর্জন করতে হবে। এ প্রজন্ম যাতে করে একটি মুহূর্তও হেলায় নষ্ট না করে তাই তিনি অনলাইন ক্লাশের প্রতি জোর দিয়েছেন।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসে অনলাইন ক্লাশের প্রতি জোড় দিয়েছে। কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকার পরও তাতে ব্যপক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। সঠিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে মানসম্মত মানবসম্পদ গড়ে তোলা খুবই অপরিহার্য। একটি দেশ তার প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষকে মানবসম্পদ বানাতে পারবে কি-না সেটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জটি এখন আমাদের সামনে। এ চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।
এবার একটু আলোকপাত করা যাক অনলাইন ক্লাশের সুবিধা অসুবিধাগুলো।
১। স্মার্ট ফোন : কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যে পরিমান ছাত্র ছাত্রী আছে বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী তাদের ৯০% ছাত্র ছাত্রী স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এছাড়া অনেকেই লেপটপ এবং ট্যাব ব্যবহার করে। অনলাইন ক্লাশে এ সুবিধাটা নিশ্চিত ভাবে একটি ইতিবাচক দিক।
২। ইন্টারনেট সংযোগ : এখন গ্রাম পর্যায়ে বিভিন্ন ফোন কোম্পানীগুলোর নেটওয়ার্ক রয়েছে। অনায়াসে শিক্ষার্থীরা সে সুযোগটি নিতে পারে। তবে কোন কোন যায়গায় নেটওয়ার্কের দুর্বলতা রয়েছে। তবে তা একেবারে সামান্য।
৩। শিক্ষকদের দক্ষতা : অনলাইনে ক্লাশ নেয়ার কিছু শিক্ষকের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি কিন্তু আমাদের অনেক প্রবীন শিক্ষক এ পদ্ধতির সাথে নিজেদের খাপখাইয়ে নিতে পারেনি। কারো কারো ক্ষেত্রে অনাগ্রহও দেখা যায়। কিন্তু যেহেতু এ পদ্ধতি বর্তমান সময়ে অত্যাবশ্যক তাই যেকোন উপায়ে হোক উক্ত শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে এ কাজে সামিল হতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
৪। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ : বর্তমানে অনলাইনে ক্লাশ নেয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো সফটওয়ার আছে। যেমন ফেসবুক লাইভ ইউ টিউব লাইভ , জুম , কোর্সেরা , গুগল ক্লাশরুম, মাইক্রোসফট টিম, হ্যাংআউট, অভিএস স্টুডিও এর মত সফটওয়ার এখন হাতের নাগালে রয়েছে। এছাড়া মোবাইলে পাওয়াও পয়েন্ট এবং স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়েও ক্লাশ রেডি করা যায়। কিন্তু এ পদ্ধতিগুলো অনেক শিক্ষক এখনো রপ্ত করতে পারেনি বা আগ্রহ নেই। তাই সল্প সময়ের ট্রেনিং এর মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়।
৫। সুবিধা : ক্লাশরুমে শিক্ষকরা যেভাবে ক্লাশ নেয় তার চেয়ে অনলাইনে ক্লাশ শিক্ষার্থীদের নানামূখি সুবিধা দিচ্ছে।
ক) শিক্ষকরা যখন অনলাইনে ক্লাশগুলো নেয় তখন শিক্ষার্থী লাইভে প্রশ্ন করলে শিক্ষক তা এড্রেস করতে পারে।
খ) ক্লাশটি অনলাইনে রেকর্ডেড থেকে যায় । শিক্ষার্থী কোন কারণে লাইভে অংশ নিতে না পারলে তার সুবিধামত সময়ে ক্লাশটি দেখে নিতে পারে।
গ) কলেজে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাশ নিতে হয়। কিন্তু অনলাইনে শিক্ষক রাতের বেলায়ও ক্লাশ এটেন্ড করতে পারে এবং শিক্ষার্থীরা সেই সময়ে অংশ নিতে পারে।
সবেচেয়ে বেশী দরকার যেটি সেটি হলো আমাদের মাইন্ডসেট। একটি প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষকরা যদি একটি টিমওয়ার্কে কাজ করে তবে অনলাইন পদ্ধতিটির অনেক সুফল পাবে শিক্ষার্থীরা। নানারকম সীমাবদ্ধতার পরও এর কোন বিকল্প নেই। অনলাইনে ক্লাশ নেয়াটা সকল প্রতিষ্ঠানে পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে এর ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা যাবে।
নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই একাজে এগোতে হবে। দক্ষ জনসংখ্যার সুযোগ কাজে লাগানোর মাধমেইজাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া আজ উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। চীনের মতো রাষ্ট্র তাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত করেই আজ এতদূর এগিয়ে গেছে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এই সুযোগ কাজে লাগাতে শিক্ষামন্ত্রনালয়ের এ পদক্ষেপের মাধ্যমেই ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসাবে আমরা আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হব।
অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার এর ফেসবুক থেকে।