বৈধতা পাচ্ছে বিতর্কিত দারুল ইহসানের সনদ!
তবে কি আদালতের রায়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিতর্কিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিলের আগে নেওয়া সব সনদের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে?—শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও শিক্ষা প্রশাসনের একটি অংশই এ প্রশ্ন তুলেছেন। তারা অভিযোগ করে বলেছেন, সারা দেশে শতাধিক অবৈধ শাখা ক্যাম্পাস চালিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি টাকার বিনিময়ে স্নাতক, বিএড, এলএলবি, স্নাতকোত্তরসহ প্রায় সব ধরণের সনদ বিক্রি করেছে। ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রনালয় কর্তৃক গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনেও বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থের বিনিময়ে সনদ বিক্রির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া এই প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধেরও সুপারিশ করেছিল কমিশন। অথচ সম্প্রতি এই শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকেই শিক্ষা অধিদপ্তরকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএড সনদ নিয়ে একটি হাইস্কুলে শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়া একজনকে এমপিওভুক্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার ঘনিষ্টজনরা দারুল ইহসানের সনদে চাকরি করছেন। তাদের চাকরি রক্ষায় আদালতের রায়ের একটি অংশের সুযোগ নিয়ে এই বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই সুযোগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের কিছু অসত্ কর্মকর্তা দারুল ইহসানের সনদধারীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধাও নিচ্ছেন।
দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের বৈধতাদান বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধিদের নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার বৈঠক করেছে। তবে মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব সালমা জাহান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, আলোচনা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব শাখা অননুমোদিত ছিল, সেগুলোর বৈধতা পাওয়ার সুযোগ নেই।’ গতকালের বৈঠকে উপস্থিত এক সদস্য ইত্তেফাককে বলেন, বৈঠকে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিলের আগের সব সনদের বৈধতা বিষয়ে আলোচনা ইতিবাচক ছিল। আদালতের রায় মেনে বৈধতা দেয়া যায় সে বিষয়ে অনেকেই মত দিয়েছেন।
আদালতের রায়ের বিষয় তুলে গতকালের বৈঠকে বলা হয় যে, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে যদি কেউ কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে থাকেন তবে ওই ব্যক্তির সনদ গ্রহণ করবে কি করবে না এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। অর্থাত্ সনদটি গ্রহন করা না করার এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। রায়ের আলোকে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিলের আগে নেওয়া সব সনদের বৈধতা দেওয়া যায় বলেও কেউ কেউ মত দেন।
সনদের বৈধতা দেওয়া প্রক্রিয়া হিসেবে দুটি চিঠিকে উদাহরণ উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, গত ১ নভেম্বর মাউশি মহাপরিচালক বরাবরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুসরাত জাহান বানু স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, ‘পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলাধীন নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে আদালতের (২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল) তারিখের আদেশের আগে যোগদানকারী এবং ২০০৮ সালের বিএড সনদ অর্জনকারী কেএম নাসির উদ্দীনকে এমপিওভুক্ত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
দ্বিতীয়ত, চলতি মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবরে মাউশি’র পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়, ‘মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার উত্তর রমজানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সিরাজুল হক সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ২০১৫ সালের ২৫ মে যোগদান করেন। তিনি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শাখা (ঢাকা) থেকে ২০০৮ সালে বিএড সনদ অর্জন করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক দারুল ইহসান সনদ সংক্রান্ত (২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল) চূড়ান্ত আদেশের আগেই তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এমতাবস্থায়, উল্লিখিত বিষয়ের আলোকে নিয়োগকৃত সহকারী প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হকের এমপিওভুক্তির বিষয়ে পরবর্তী সদয় নির্দেশনা কামনা করে তথ্যাদি প্রেরণা করা হলো।’
মাউশির পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ইত্তেফাককে বলেন, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়টি খারাপ মানের ছিল সেটি আদালতও বলেছে। তবে সনদের বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রজ্ঞাপন থাকা দরকার বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে সনদের বৈধতা দেওয়া নৈতিকতা বিরোধী। টাকার বিনিময়ে কেনা সনদের বৈধতা দেওয়ার মানে অন্যায়ের সাথে আপস করা।
মাউশি’র তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে মোট ৩২ হাজার নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসায় একটি করে গ্রন্থাগারিকের পদ রয়েছে। এই পদে নিয়োগ পাওয়া অনেক ব্যক্তিই দারুল ইহসানের সনদধারী। সম্প্রতি আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকদের সনদ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণে এ প্রতিষ্ঠানের সনদ যাচাইয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে বিশ জনের বেশি শিক্ষক দারুল ইহসানের সনদধারী।
প্রসঙ্গত, মালিকানার দ্বন্দ্ব, আইন বিষয়ে উত্তীর্ণদের বার কাউন্সিলে অ্যাডভোকেটশিপ সনদ পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ বন্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ে দারুল ইহসানের বিষয়ে হাইকোর্টে বিভিন্ন সময়ে ১২টি রিট দাখিল করা হয়। এসব রিটের শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল হাইকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধের রায় দেন। ওই রায়ে আদালত বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টিদের ১০ লাখ টাকা করে জরিমানা ও শিক্ষার্থীদের ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেন। হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় আপিল করেছিল। পরে শুনানি শেষে আপিল খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ।
ফিরে দেখা: ১৯৯৩ সালে ধানমন্ডিতে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়টি সরকারের সাময়িক অনুমোদন পায়। পরে পরিচালকরা চারগ্রুপে বিভক্ত হয় মালিকানা দাবি করে পৃথক পৃথকভাবে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচালনা এবং দেশব্যাপী আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করে সার্টিফিকেট বিক্রি শুরু করে। ২০০৭ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ জারি পর ২০০৬ সালের ২ এপ্রিল একটি হাইকোর্ট বিভাগে রিট দরখাস্ত দাখিল করে একটি পক্ষ। এর মাধ্যমে তারা ২৯টি আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা সম্পর্কে স্থগিতাদেশ নিয়ে ক্যাম্পাস পরিচালনা করে। ঐ স্থগিতাদেশের সুযোগ নিয়ে অপর ৩টি মালিক দাবিদাররাও বিভিন্ন স্থানে শতাধিক আউটার ক্যাম্পাস পরিচালনা করে।
এভাবে সনদ বিক্রির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এক প্রকার প্রকাশ্যেই তারা সনদ বিক্রি করে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিরুদ্ধে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর বিচার বিভাগীয় একটি কমিশন গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সূত্রঃ ইত্তেফাক