• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক

গণপরিবহনের চরম সঙ্কট : জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে যাতায়াত

প্রকাশ:  ২০ মে ২০১৯, ১০:০৮
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলার সেতুবন্ধন হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়ক। এক সময় কুমিল্লা জেলার এ অংশটুকু বর্তমানে চাঁদপুর জেলা হিসেবে পরিচিত। এখনও বৃহত্তর কুমিল্লা হিসেবে অনেকেই চাঁদপুরকে মনে করে থাকেন। বর্তমানে চাঁদপুর একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা, যা ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের জনগণ প্রমাণ করতে পেরেছে। চাঁদপুরের সাথে নদী পথে ঢাকা ও বরিশালসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেও জেলার অধিকাংশ জনগণ সড়কের উপর নির্ভরশীল। চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের যে কোনো প্রান্তে সড়ক যোগে যাতায়াতের উত্তম মাধ্যম উক্ত সড়ক। ব্রিটিশ আমলে এ সড়কটির যাত্রা শুরু হয়েছে বলে অনেকেই জানান। প্রথমে এ সড়কটি ছিলো কাঁচা, এরপর ইট দিয়ে সলিং করা হয়। মহান স্বাধীনাতার আগেও সড়কটি ছিলো আধাপাকা সড়ক। এরপর সড়কটি আস্তে আস্তে আঞ্চলিক মহাসড়কে রূপ নেয়।
৮২ বছর বয়সের হাজী সুলতান আহম্মেদ জানান, তিনি পাট মন্ত্রণালয়ে চাকুরি করতেন। সেই সময় তিনি ১২-১৫ টাকা দিয়ে শাহরাস্তি থেকে বাসে ঢাকায় যেতেন। সকালে বাসে উঠলে সন্ধ্যায় নামিয়ে দিতো। সেই সময় কোন স্পেশাল সার্ভিস ছিলো না, বেশ কয়েকটি লোকাল বাস ছিল। যাত্রীদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিলো বাস। এছাড়া চাঁদপুর থেকে কুমিল্লাগামী যাত্রীদের জন্য কুমিল্লা ট্রান্সপোর্টের লোকাল বাস ছিল একমাত্র অবলম্বন। এটি কয়েক যুগ আগের কথা। তখনকার সময় এই লোকাল বাসের মাধ্যমে যাত্রীগণ প্রতিদিন চাঁদপুর ও কুমিল্লায় যাতায়াত করে থাকতো। অনেকেই এই বাসটিকে মুড়ির টিন নাম দিয়ে আনন্দ পেতেন, পরবর্তীতে অনেকের কাছে এ লোকাল বাসটি মুড়ির টিন হিসেবেই পরিচিতি পায়। ১৯৮৬-৮৭ সালে এ সড়কে স্পেশাল সার্ভিস হিসেবে যাত্রা শুরু করে ‘বোগদাদ‘। বোগদাদ যাত্রা শুরু করার পর সড়কটিতে যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত টাকা দিয়ে যাতায়াত করলেও নির্দিষ্ট কিছু স্থানে দাঁড়ানোর কারণে এবং দ্রুত যাতায়াত করতে পারায় ‘বোগদাদে’র প্রতি যাত্রীরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। পাশাপাশি চাঁদপুর থেকে কচুয়া পর্যন্ত যাত্রা শুরু করে ঈগল সার্ভিস ও কচুয়া থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত আজমীর পরিবহন। পাড়া-মহল্লা বেবী-টেম্পুর দখলে থাকলেও আঞ্চলিক সড়কটি ছিল বাস, ট্রাকের দখলে। জেলার কয়েক লক্ষ জনগণের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিলো বাস তথা গণপরিবহন। সম্প্রতি এ সড়কে আর গণপরিবহনের দাপট আগের মতো দেখা যায় না। বর্তমানে বেশ কিছু দূরপাল্লার বাস সার্ভিস থাকলেও আঞ্চলিক তথা চাঁদপুর-কুমিল্লার জনগণের যাতায়াতের জন্যে নেই পর্যাপ্ত গণপরিবহন। বেশ কয়েক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে মুড়ির টিন নামে খ্যাত লোকাল বাস। গত কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে কচুয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল স্পেশাল সার্ভিস। একই ধারাবাহিকতায় বন্ধ হয়ে যায় আজমীর পরিবহন। বর্তমানে বোগদাদ স্পেশাল ছাড়া এ সড়কে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লায় যাতায়াতের কোনো প্রকার গণপরিবহন নেই। তাও শুধু নির্দিষ্ট কিছু এলাকার জন্যে সীমাবদ্ধ।
চাঁদপুর থেকে কুমিল্লার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এখানে ছোট-বড় স্টেশন রয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি। বর্তমানে এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করা বোগদাদ ট্রান্সপোর্ট মাত্র ১০টি স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা করিয়ে থাকে। বাকি ২০ টি স্টেশনের যাত্রীদের গণপরিবহনের মাধ্যমে যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই।
          বোগদাদ ট্রান্সপোর্টের লাইন সুপারভাইজার হাজী মোঃ জসিম জানান, প্রায় ২৩ বছর যাবৎ এ সার্ভিসের সাথে তিনি জড়িত। প্রতিদিন তিনি এ সড়কে যাতায়াত করে থাকেন। প্রতি ৭ মিনিট পর পর তাদের বাস মূল স্টেশন ত্যগ করে। তিনি আরো জানান, তাদের সার্ভিস ধ্বংসের কাছাকাছি রয়েছে। তাদের গাড়ির সংখ্যা ৯০টি হলেও প্রতিদিন ৫৮ টি বাস যাতায়াত করে থাকে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বেশ ক’টি সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেছে। তার অন্যতম কারণ সড়কে অতিরিক্ত সিএনজি স্কুটারের আধিপত্য। যাত্রীগণ সিএনজি স্কুটার যোগে যে কোনো স্থানে যেতে পারছেন। চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়ক ছাড়াও যে কোনো পাড়া মহল্লায় যেতে পারছেন। সে কারণে যাত্রীরা বাসে না উঠে সিএনজি স্কুটারে উঠে পড়ছেন। বোগদাদ সার্ভিস আন্তঃ জেলার হওয়ায় এবং সিএনজি স্কুটার জেলার বাইরে যেতে না পারায় বোগদাদ সার্ভিস এখনো যাত্রী পরিবহন করে যাচ্ছে।
চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের চানখার দোকান, ঘোষেরহাট, কুমারডুগী, দেবপুর, বলাখাল, এনায়েতপুর, উয়ারুক, মেহের, কাকৈরতলা, জগৎপুর, খাজুরিয়া সহ বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনের যাত্রীদের গণপরিবহন না থাকায় বাধ্য হয়েই উঠতে হচ্ছে সিএনজি স্কুটারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে। এতে করে প্রতিদিন সড়কে বাড়ছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা, গণপরিবহন সংকটের কারণে মহাসড়কটি দখল করে নিয়েছে সিএনজি স্কুটার।
এছাড়া জেলার ফরিদগঞ্জ, মতলব উত্তর ও দক্ষিণ, হাজীগঞ্জ, কচুয়া, শাহরস্তি উপজেলার হাজার হাজার জনগণ বিভিন্ন কাজে প্রতিদিন জেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়। গণপরিবহনের অভাবে যথা সময়ে কাজে হাজির হতে পারছেন না অনেকেই। বেশ কয়েক জন যাত্রীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ে যাতায়াত করতে না পারায় তাদের অনেক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে আদালতে হাজিরা দিতে, অফিসে হাজির হওয়া সহ গুরুত্বপূর্ণ কজে যথা সময় উপস্থিত হতে না পেরে অনেকেই বিপদে পড়তে হয়। এছাড়াও স্পেশাল বাসের জন্যে সকাল বেলা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ওঠা সম্ভব হয় না। তাই বাধ্য হয়েই সিএনজি স্কুটারের মাধ্যমে যাতায়াত করতে হচ্ছে যাত্রীদের।
অনেক সময় সিএনজি স্কুটারের বেপরোয়া চলাচলের কারণে যথা সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। শাহরাস্তি থেকে যেখানে পৌনে ১ ঘন্টায় চাঁদপুর যাওয়া যেতো, সেখানে এখন প্রায় সোয়া ঘন্টারও বেশি সময় যানবাহনে বসে থাকতে হয়। সম্প্রতি চাঁদপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় বেশ ক’জন প্রাণ হারানোর পর সাধারণ যাত্রীদের মাঝে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। অনেকেই সিএনজি স্কুটারের বিকল্প যানবাহন খুঁজছেন। কিন্তু নিরুপায় হয়েই গন্তব্যে পৌঁছার তাগিদে সিএনজি স্কুটারে উঠছেন যাত্রীগণ।
এ ব্যাপারে জানার জন্যে চাঁদপুর জেলা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি বাবুল মিজির সাথে কয়েক বার যোগাযোগ করে তাকে পাওয়া যায়নি।
      সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সিএনজি স্কুটারের দৌরাত্ম্য কমাতে গণপরিবহন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী যাত্রীগণ। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শুধু মুখেই নয় বাস্তবে রূপ দিতে যথাযথ কর্যকর ব্যবস্থাগ্রহণ করবে প্রশাসন-এটাই চাঁদপুরবাসীর প্রত্যাশা।

 

সর্বাধিক পঠিত