• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

হাইমচর থানার পুলিশ সদস্য মোশারফ নিহতের ঘটনা কি তাহলে ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে?

প্রকাশ:  ০১ মে ২০১৯, ১৩:০৩
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

হাইমচর থানার পুলিশ সদস্য মোশারফ হোসেন নিহত হওয়ার ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। ঘটনার সময়কার নানা দিক বিশ্লেষণ করে অনেকটা তাই মনে হচ্ছে। সেদিন কি সত্যিই জেলেদের হামলায় পুলিশ সদস্য মোশারফ নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন নাকি ঘটনা অন্যরকম কিছু, সেটি নিয়েই এখন চলছে জল্পনা-কল্পনা। খোদ পুলিশ বিভাগের মধ্যেই এখন এ ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় চলছে। তাদের মাঝেই ঘটনাটি রহস্যাবৃত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আর এই রহস্যাবৃত হওয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে।
ঘটনার পেছনে যে প্রশ্নগুলো এখন খুব ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে সেগুলো হলো-ঘটনার সময় পুলিশকে বহন করা দুটি নৌযান অক্ষত, নৌযানে যারা ছিলেন চালক, অপর পুলিশ সদস্যরা, সোর্সসহ আরো ক’জন সবাই অক্ষত, অথচ কনস্টেবল মোশারফ নদীতে পড়ে নিখোঁজ হয়ে গেলেন, তা কতটুকু বিশ^াসযোগ্য হতে পারে।  জেলেরা হামলা করলে নৌযানসহ কারোরই কোনো ক্ষতি হলো না, অথচ একজনই (কনস্টেবল মোশারফ) নিখোঁজ হয়ে গেলেনÑএটি কোনোভাবেই বিশ^াসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করলেন নিহতের স্ত্রী শামীমা আক্তার। নিহত মোশারফের স্ত্রীর ভাষ্যমতে ঘটনাটি ঘটেছে সেদিন রাত সাড়ে ৮টার পর থেকে ১১টার আগে। আর পুলিশ যদি জেলেদের দ্বারা আক্রান্ত হতো তাহলে শুরুতেই পুলিশ কেনো গুলি করলো না। যদিও থানার অফিসার ইনচার্জ  সেদিন বলেছেন, পুলিশ সদস্যরা ৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু গত ক’দিন সরজমিনে ঘটনাস্থলে বিচরণ করে আশপাশের কেউই গুলির শব্দ পেয়েছে এমন তথ্য জানাতে পারে নি। তাছাড়া রাতে নদীপথে অভিযানে যাবে, তাও উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে, এ সময় লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই কি পুলিশ সেদিন অভিযোনে গিয়েছে? আর ঘটনার পর থেকে হাইমচর থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসির) সোর্স রবিউল পলাতক কেনো-এসব নানা প্রশ্ন এখন কনস্টেবল মোশারফ নিহতের ঘটনার নেপথ্যে আসল রহস্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে নিহত কনস্টেবল মোশারফের স্ত্রী হাইমচর থানার নারী পুলিশ কনস্টেবল শামীমা আক্তার হাইমচর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাটি ঘটেছে ২৬ এপ্রিল শুক্রবার রাত আনুমানিক ১০ থেকে ১২টার মধ্যে, শামীমা আক্তার মামলা করেছেন শনিবার রাতে। তিনি জানিয়েছেন, শনিবার রাতে মামলা এন্ট্রি হয়েছে। মামলায় ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৩০ জনকে আসামী করা হয়েছে। আর ১৬ জন আসামীর নামের তালিকা থানার ওসিই করেছেন বলে জানা গেছে।
গতকাল শামীমা আক্তারের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। ঘটনার আগ পযন্ত তাঁর যতটুকু জানা সে থেকে তিনি বলেন, ২৬ এপ্রিল শুক্রবার দিনের বেলা সারাদিন আমার স্বামী মোশারফ বাহেরচর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে ডিউটিতে ছিলেন। বিকেলে বাসায় আসেন, খুবই ক্লান্ত ছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তার মোবাইলে একটি ফোন আসে। তখন তিনি বিছানা থেকে উঠে পুলিশের পোশাক পরতে থাকেন। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, কোথায় যাও? তখন তিনি বললেন, সুমন স্যার ফোন করেছেন, অভিযানে যেতে হবে। এ কথা বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে আমি তাকে ফোন দেই। তখন সে বলে, ‘আমরা এখন ট্রলারে উঠেছি, নদীত নামতেছি, পরে আবার কথা হবে।’ এটা তার (স্বামীর) সাথে আমার শেষ কথা। এরপর রাত ১১টা বাজার কিছু আগে আবার আমি ফোন দেই। কিন্তু তখন ফোন ঢুকে নি। এরপর যতবার ফোন দিয়েছি ফোন ঢুকেনি।
শামীমা জানান, এর আগে যতবার আমার স্বামী মোশারফ অভিযানে গিয়েছে, প্রত্যেকবারই রাতে একাধিকবার আমার সাথে তার কথা হতো। তিনি আরো জানান, ঘটনার রাত অর্থাৎ শুক্রবার রাত প্রায় ২টার সময় তিনি জানেন তার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার খবর। থানার কয়েজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং কনস্টেবল রাত প্রায় ২টার দিকে তার বাসায় এসে তাকে তার স্বামী মোশারফ নদীতে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি প্রথম জানান।
এদিকে পুলিশ সদস্য মোশারফ নিহত হওয়ার ঘটনায় সেদিন রাতে তার সাথে থাকা এএসআই সুমন সরকার ও কনস্টেবল শাহাদাতকে হাইমচর থানা থেকে প্রত্যাহার করে চাঁদপুর পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর মোশারফ হত্যা মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে জেলা ডিবি পুলিশকে। এদিকে হাইমচর থানার ওসির সোর্স রবিউলকে পুলিশ সুপার গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। রবিউল ঘটনার পর থেকে পলাতক। তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। হাইমচর থানার বর্তমান ওসি এই থানায় যোগদানের দিন থেকেই এই সোর্স রবিউল ওসির সাথে থাকছেন। সে ওসির সোর্স হিসেবে কাজ করে থাকে। এরই মধ্যে রবিউল এলাকার কিছু খারাপ লোক অর্থাৎ অপরাধ শ্রেণির লোকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে বলে জানান হাইমচর থানার আশপাশের লোকজন।
এদিকে ঘটনার দিন রাতের সেই অভিযানের বিষয়ে নানা মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে, সোর্স রবিউলের মাধ্যমেই সেই রাতে নীলকমল ইউনিয়নের চরকোড়ালিয়া এলাকায় থানার (জিআর) মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী ধরতে গিয়েছিলো এএসআই সুমন সরকারের নেতৃত্বে ক’জন জন পুলিশ সদস্য। সাথে ছিলো সোর্স রবিউল। তারা দুটি ট্রলারে ছিলেন। পথিমথ্যে হাইমচর কলেজঘাট এলাকায় মেঘনা নদীতে জাটকা নিধনকারী জেলেদের দ্বারা নাকি তখন পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হন। আর তখনই কনস্টেবল মোশারফ নিখোঁজ হন। হাইমচর থানার ওসি সেদিন সংবাদকর্মীদের জানালেন, জেলেরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুলিশের উপর হামলা চালায়। আর পুলিশ তখন আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়। তিনি সেদিন আরো জানান, জেলেদের ইঞ্জিনচালিত নৌযান পুলিশের ট্রলারের উপর উঠিয়ে দেয়। এতে মোশারফ নিখোঁজ হন। এখন প্রশ্ন হচ্ছেÑএতো বড় ঘটনা ঘটলো, অথচ কনস্টেবল মোশারফ ছাড়া অপর পুলিশ সদস্যরা, সোর্স ও ট্রলারের চালকসহ স্টাফ সবাই অক্ষত রইলো, এটা কীভাবে বিশ^াসযোগ্য হয়? আর কনস্টেবল মোশারফ কি নদীতে পড়েই ডুবে গিয়েছেন? তিনি কি চিৎকার দেননি? অথচ মোশারফ সাঁতার জানতেন বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী। তাছাড়া লাইফ জ্যাকেট ছাড়া কেনইবা তারা রাতে নদীপথে অভিযানে গেলেন-এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
এখন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এএসআই সুমন সরকার, কনস্টেবল শাহাদাত হোসেন, ওসির সোর্স রবিউল ও ট্রলার চালকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে। প্রয়োজনবোধে হাইমচর থানার অফিসার ইনচার্জকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। কারণ ওসির নির্দেশনা ছাড়া তো থানার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামী ধরতে যেতে পারে না পুলিশ। তাও তার নিযুক্ত সোর্সসহ। সর্বোপরি অধিকতর তদন্তে এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে জনমনে জেগে ওঠা ওইসব প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন সচেতন মহল।

 


সুত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ

সর্বাধিক পঠিত