বিপুল উৎসাহে চাঁদপুরে মহান বিজয় দিবস উদযাপিত
চাঁদপুরসহ সারাদেশে এবার মহান বিজয় দিবস ভিন্ন আমেজে, ভিন্ন মাত্রার আনন্দে উদ্যাপিত হয়েছে। এর পেছনে বিশেষত্ব হচ্ছে-যে ভাষণটি ছিলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল নিকনির্দেশনা, যে ভাষণে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়ে বাঙালি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এবার ইউনেস্কোর 'মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড' এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিশ্ব প্রামাণ্যের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ, বিশ্বে সততা ও পরিশ্রমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ রাষ্ট্রনায়কের অন্যতম হওয়ার গৌরব অর্জন করা এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত অসহায় রোহিঙ্গাদের এদেশে আশ্রয় দেয়ায় শেখ হাসিনার 'মাদার অব দ্যা হিউম্যানিটি' উপাধী লাভ। এই তিন বিশেষ অর্জনে বাঙালি এবার বিপুল উৎসাহে বিজয়ের ৪৬তম বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছে। চাঁদপুরেও এই উৎসাহ-আনন্দের কোনো কমতি ছিলো না। চাঁদপুর শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য 'অঙ্গীকার', চাঁদপুর স্টেডিয়াম ও বিজয় মেলাসহ জেলার যেখানেই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয়েছে সেখানেই সকল বয়সী ও শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নেমেছে।
১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য 'অঙ্গীকারের' সামনে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচির সূচনা হয়। এরপর শুরু হয় শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে 'অঙ্গীকার' বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ। প্রথমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডাঃ দীপু মনি এমপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। পরে পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মন্ডলের নেতৃত্বে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারের নেতৃত্বে পুলিশের কর্মকর্তাবৃন্দ, কমান্ডার এমএ ওয়াদুদের নেতৃত্বে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ওচমান গনি পাটওয়ারীর নেতৃত্বে কর্মকর্তাবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এমনিভাবে জেলা বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, চাঁদপুর পৌর পরিষদ, চাঁদপুর প্রেসক্লাব, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, বাসদ, গণফোরাম, চাঁদপুর রোটারী ক্লাব, সাহিত্য একাডেমী, সচেতন নাগরিক কমিটি-সনাক চাঁদপুর, ইনার হুইল ক্লাবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে 'অঙ্গীকার' বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়।
এছাড়া এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যথাযথ মর্যাদার সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সকাল সাড়ে ৮টায় চাঁদপুর স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মন্ডল। পতাকা উত্তোলনের পর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার পায়রা উড়ান। এ সময় অতিথিদের সারিতে উপস্থিত ছিলেন ডাঃ দীপু মনি এমপিসহ আরো বিশিষ্টজন। এছাড়া সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, বিএনসিসি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, কারারক্ষী, রোভার স্কাউটস্, স্কাউটস্, গার্লস গাইড ও কমিউনিটি পুলিশসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিশু-কিশোর সংগঠন কুচকাওয়াজ ও সালাম প্রদর্শন করে। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের শিশু-কিশোররা শরীরচর্চা, ডিসপ্লে প্রদর্শন ও ক্রীড়া প্রদর্শন করে। এসব অনুষ্ঠান শেষে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছ থেকে তারা পুরস্কার গ্রহণ করেন। বেলা ১১টায় চাঁদপুর সার্কিট হাউজে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ডাঃ দীপু মনি এমপি। এরপর পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত অন্যান্য কর্মসূচি পালিত হয়। রাতে বিজয় মেলা মঞ্চে 'সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তির সার্বজনীন ব্যবহার এবং মুক্তিযুদ্ধ' শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা সভায় জনপ্রশাসন পদকপ্রাপ্ত চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুস সবুর মন্ডল বলেছেন, কোনো বাঙালিই পাকিস্তানীদের কখনো ভাই বলে সম্বোধন করে না। কারণ, বাঙালিরা '৭১-এর করুণ দৃশ্য ভুলে নাই। ভুলে নাই ইসলাম পরিচয় দেয়া সত্ত্বেও ওই পাকিস্তানী নরপিশাচরা বাঙালি মুসলমানদের নৃশংস মৃত্যু ব্যতীত কোনো ছাড় না দেয়ার কথা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের দুটি পরাজয়। এক হলো নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা হত্যাকা- আর ২য়টি হলো ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-। দেশ এবং চাঁদপুরের উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর ১ নম্বর ওয়েব পোর্টালের দেশ এখন বাংলাদেশ। ১৪ কোটি সিম ইউজার রয়েছে এ দেশে এবং বাংলা ভাষা পৃথিবীর মধ্যে এখন ৪র্থ। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে এশিয়াতে মহাত্মা গান্ধী ব্যতীত আর কারো সাথে তুলনা করা যায় না। কারণ, বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন জাতীয় বীর। তাই আসুন, আমরা নাড়ির টানে জন্মভূমির জন্যে কাজ করি। তাহলেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সোনার বাংলা।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শওকত ওসমানের সভাপতিত্বে এবং জেলা কালচারাল অফিসার আবু ছালেহ মোঃ আব্দুল্লাহর পরিচালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল। তিনি বলেন, পাকিস্তানের পিশাচরা এখনো বেঁচে আছে, তারা মরে নাই। একাত্তরে পাকিস্তানীদের মদদদাতা শান্তি কমিটির লোকজন এখনো সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে মিটিং মিছিল করছে। তারা বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরো বলেন, আমরা আফগানিস্তান, সুদান হতে চাই না। আমরা নতুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে জাতির জনকের স্বপ্ন মোতাবেক তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক অসামপ্রদায়িক রাজাকারমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গঠন করবো।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কোনো দল-মতের নন, তিনি সবার। যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করবে না সে বাঙালি মনোভাবের মানুষ নয়। তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা হচ্ছেন দেশমাতা। তাই তিনি ধাপে ধাপে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এএসএম দেলোয়ার হোসেন, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী, জেলা প্রশাসকের সহধর্মিণী ও জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভানেত্রী আখতারী জামান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা। আলোচনা সভাশেষে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় এক মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
এ দিন বিকেল থেকে বিজয় মেলায় মানুষের ঢল নামে। এ ছাড়া বিজয় দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শহরের শপথ চত্বর ও ইলিশ চত্বর আলোকসজ্জা করা হয়। জেলার অন্যান্য উপজেলায়ও উপজেলা প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্যোগে বিজয় দিবস উদ্যাপিত হয়।
সূত্রঃ চাঁদপুর কন্ঠ