তিনদিনের বৃষ্টিতে কৃষকের স্বপ্ন মাটি আর পানির সাথে মিশে গেছে
নিন্মচাপের প্রভাবে গত ক'দিনের বৃষ্টিতে কৃষকের স্বপ্ন মাটি আর পানির সাথে মিশে গেছে। বৃষ্টির কারণে রোপণকৃত আলু নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে জেলায় আলু উৎপাদনে ধস নামার আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে। জমিতে জমে থাকা এই পানি শুকানো পর্যন্ত আলু রোপণের সময় শেষ হয়ে গেলে এবার এ জেলায় আলু উৎপাদনে মারাত্মক ধস নামবে। এদিকে এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় শীতের বিকল্প ফসল আবাদের পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি অফিস। আলু রোপণের জন্যে জমি তৈরি ও বীজ রোপণ শেষে এই বৃষ্টির কারণে কৃষকদের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। তারা ধার-দেনাসহ নানা প্রস্তুতি নিলে এখন সব ভেস্তে যেতে বসেছে বলে চাঁদপুর কণ্ঠকে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত বহু কৃষক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, চলিত বছর চাঁদপুর জেলায় আলু চাষাবাদের জন্যে ১২ হাজার ৮শ' ৯০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ইতোমধ্যে সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়েছে। আবাদের লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে হাজীগঞ্জে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩শ' ৪০ হেক্টর। এই বৃষ্টিতে রোপণকৃত প্রায় ৩শ' হেক্টর জমির আলু পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। এমনিভাবে ফরিদগঞ্জে আলু আবাদ হয়েছে ৩০ হেক্টর, পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১৫ হেক্টর। কচুয়ায় ৩ হাজার ৯শ' ৪০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত প্রায় ৪শ' হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে গত তিনদিনের টানা বর্ষণের কারণে ১শ' হেক্টর জমির আলু পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। টানা বৃষ্টিতে আলু চাষাবাদের জমির এমন হতাশার চিত্র জেলার অন্য সকল উপজেলার।
গতকাল সোমবার সরজমিনে জেলার সদর উপজেলার কুমারডুগী, কৃঞ্চপুর ও হাজীগঞ্জের কুচির বিল ঘুরে দেখা যায়, কুমারডুগী ও কৃঞ্চপুর এলাকায় বিলের পর বিল জমির ৮০ ভাগ অংশে সবেমাত্র আলু রোপণ শেষ হয়েছে। বাকী ১০ ভাগ জমি আলু রোপণের জন্যে তৈরি করা হয়েছে আর বাদবাকি ১০ ভাগ জমিতে আলুর চারা গজিয়েছে। গত ক'দিনের বৃষ্টিতে এ সকল জমির রোপণকৃত আলুর বীজ মাটিচাপা পড়ে পচে গেছে। যার মধ্যে অধিকাংশ জমির লাইনে (আইল) পানি জমে রয়েছে আর কিছু জমিতে পুকুরের মতো পানি জমে রয়েছে। এ সকল জমির মালিক অধিকাংশ কৃষক মনের কষ্টে জমির কাছে আসেননি। আবার অনেকে এসে জমি দেখে ক্ষতির পরিমাণ মনে মনে নিরুপণ করে শুধু হায় আফসোস করছেন।
এদিকে একইদিন হাজীগঞ্জের কুচির বিল এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পুরো ২শ' ৪০ একর বিশালাকৃতির বিলসহ তৎসংলগ্ন এলাকার জমিগুলোর চারদিকে থৈ থৈ করছে পানি আর পানি। এর মধ্যে চলিত মৌসুমের ধানের বীজতলা, রোপণকৃত ধান, চাষের কুমড়াগুলোসহ সকল জমি পানির নীচে। এই বিলের পানি নামার ব্যবস্থা থাকার পরও প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে পানি আটকে গিয়ে পুরো মাঠের ফসল হুমকির মুখে পড়েছে।
কুমারডুগী এলাকায় চাষাবাদ করা বিলের কৃষক কৃঞ্চপুর গ্রামের আরশাদ গাজী কুমারডুগী ও কৃঞ্চপুর মাঠে ৩শ' ৬০ শতাংশ জমিতে এবার আলু রোপণ করেছেন। রোপণ পর্যন্ত তার ৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। বর্তমানে জমির পানি নেমে মাটি শুকানো পর্যন্ত যে সময় লাগবে সে সময় আলু রোপণের সময় শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া তখন পর্যন্ত আলুর বীজ বাজারে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কম। আর ফের এতো টাকা ব্যয় করে আলু লাগানোর ইচ্ছে মোটেই নেই। কারণ, বিভিন্নজন থেকে হাওলাত, লোনসহ নিজের সর্বস্ব খরচ করে আলু রোপণের পর এখন বৃষ্টিতে সকল স্বপ্ন মাটির সাথে মিশে গেছে।
কুমারডুগী গ্রামের জামাল বেপারী বাড়ির মুরাদ জানান, গত মৌসুমে আলু উত্তোলনের কদিন আগের টানা বৃষ্টিতে পুরো আলু নষ্ট হয়ে গেছে। সব কষ্ট ভুলে এবারো ১শ' ২০ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করেছি। ৪ দিনের বৃষ্টিতে লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই বিলের (কুমারডুগী) পানি নামার কোনো ব্যবস্থা নেই বিধায় সকল জমিতে পানি জমে রয়েছে। যে কারণে রোপণকৃত আলু মাটির নীচে পচে গেছে। এতো ক্ষতির পরও এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগের কেউ আমাদেরকে পরামর্শ দেয়ার জন্যে আসেন নি।
হাজীগঞ্জের কুচির বিলের কৃষক বলাখাল উত্তর হাজী বাড়ির মোতাহের হোসেন, বেপারী বাড়ির আঃ খালেকের ছেলে স্বপন ও বকাউল বাড়ির জামাল বকাউল এরা সবাই কেউ কুমড়া কেউ ধান চাষ করেছেন। গত কদিনের বৃষ্টিতে জমে থাকা উক্ত মাঠের পানি নামার পর্যাপ্ত খাল থাকার পরও খালের পানি নামার পথে প্রতিবন্ধকতার কারণে এ মাঠে পানি আটকে আছে। রেল ব্রিজ পার হয়ে বলাখাল মাদ্রাসার সামনে দিয়ে বলাখাল বাজারের উত্তর পাশের খালে দলিল লেখক লোকমান হোসেন মুন্সী বাড়ির কাজ করতে গিয়ে মাটি দিয়ে খাল ভরাট করে ফেলেছেন। একই খালের সামনে সড়ক বিভাগের বাইপাস সড়ক নির্মাণে ও বিএডিসির নির্মাণাধীন পানি নিষ্কাশনের ক্যানেলের কারণে পানি নামতে পারেনি। ঠিক কবে এই পানি নামার ব্যবস্থা করবে তা কর্তৃপক্ষ ভালো জানে। উপরোক্ত কৃষককুল আরো জানান, পানি নামার বিষয় বা ফসল রক্ষার বিষয়ে কোনো ধরনের সহযোগিতার জন্যে কোনো কৃষি কর্মকর্তা আমাদের কাছে আসেন নি।
কুচির বিলের একাংশের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা স্বপন চক্রবর্তী জানান, আমি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে যাইনি এমন দাবি কৃষকদের সঠিক নয়। আমি এ বিষয়ে আমাদের স্যারের সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দিল আতিয়া পারভীন জানান, বৃষ্টির পানি জমি থেকে নামার পর মাটি না শুকানো পর্যন্ত আরো ১৫ দিন সময় অতিক্রম হয়ে গেলে আলুর সিজন প্রায় শেষ হয়ে যাবে। সেই সময় আলু চাষের দিকে নজর না দিয়ে শীত মৌসুমের আগাম ফসল ফলানোর সিদ্ধান্ত সবচে ভালো হবে।
কচুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আহসান হাবীব বলেন, এ বছর আমাদের উপজেলায় ৩ হাজার ৯শ' ৪০ হেক্টর জমিতে আলু চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের কৃষক ভাইয়েরা ৩শ' ৭৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষাবাদ করেছেন। তিন-চার দিনের বর্ষণে প্রায় ৫০ হেক্টর আলুর জমি পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছি যাতে জমি থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাঁদপুর-এর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আলী আহাম্মদ জানান, বৃষ্টিতে আলুসহ যে সকল ফসলের ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
সূত্রঃ চাঁদপুর কন্ঠ