ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে যা বললেন বিশেষজ্ঞরা
ব্লু হোয়েল গেমে ‘আসক্ত হয়ে সম্প্রতি আত্মহত্যা’ করেছে বাংলাদেশি এক কিশোরী। তার নাম অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিল সে। রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ হায়ার সেকেন্ডারি গার্লস স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল। সেখানে সব সময় মেধাতালিকায় প্রথম ছিল স্বর্ণা। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত পড়ছিল অষ্টম শ্রেণিতে।
রাজধানীর ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাটের বাসা থেকে গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে স্বর্ণার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এর পর থেকেই তার পরিবারের সন্দেহ যে তাঁদের মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর ‘ব্লু হোয়েল’ গেমসে আসক্ত হয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন নানা রকম সফটওয়্যার ও মেকানিজম আবিষ্কার করেছে। ফলে তরুণরা বেশি আকৃষ্ট হয়েছে, কারণ এই সফটওয়্যার ও মেকানিজমগুলোর যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, তার সঙ্গে তরুণদের জীবনযাপন ও বৈশিষ্ট্যগত মিল থাকায় তরুণরা বেশি আকর্ষিত হয়। কিন্তু ব্যাপার হলো, বেশ কিছুদিন থেকে দেখছি বাংলাদেশ যত বেশি ইন্টারনেটের প্রসার বাড়ছে, তত বেশিই কিন্তু অনলাইনের আকর্ষণটা বাড়ছে। সেই অনলাইনের মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণই হচ্ছে আজকের এই ব্লু হোয়েল গেমস।
তিনি বলেন, এই গেমসের সঙ্গে যারা আসক্ত, তাদের আত্মহত্যার সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জায়গায় আমাদের অভিভাবকদের একটি শক্ত ভূমিকা পালন করার কথা রয়েছে। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বা কলেজ পাস না করা পর্যন্ত কোনো ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল যেন তাদের সন্তানদের না দেন। ফোন করার জন্য কম দামি ফোন ব্যবহার করতে পারে। আর আমাদের দেশের শহরে যে অভিভাবকরা থাকেন, তাদের সন্তানদের স্বাধীনতার নামে যেসব সুবিধা দেন, সেগুলো কিন্তু অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়।
তৌহিদুল হক বলেন, বলা হয় যে এই গেমসটি আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। অর্থাৎ যারা এই গেমসে আসক্ত হয় ধারণা করা হয়, তারা একসময় আত্মহত্যা করবেই। সমাজের সঙ্গে, অভিভাবকের সঙ্গে এবং যারা গেমস ব্যবহার করছে, সেই সন্তানদের সঙ্গে কিন্তু একটি বড় ধরনের গ্যাপ রয়েছে। কাজেই আমাদের আইসিটি মন্ত্রণালয় আছে, তারা এ বিষয়টি নিয়ে একটি নীতিমালা করবে। আমাদের দেশের নাগরিকদের ইন্টারনেটের ব্যবহার বা এক্সেস কতটুকু হবে, এটা মনে হয় রাষ্ট্রের এখন বেঁধে দেওয়ার সময় হয়েছে। সাধারণ জনগণ কোন কোন অ্যাপস, সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করতে পারবে, তার একটা নীতিমালা করতে হবে। এমন ঘটনার পরে সারা দেশে কিন্তু একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে। কাজেই সরকার ও অভিভাবককে সচেতন হতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আর সারা দেশে স্থানীয় নেতা, ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষকদের মাধ্যমে এই সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল ও কলেজের তরুণরা বেশি আসক্ত হয়। এই গেমসের মূল বিষয় হলো নিজের প্রতি নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। সে কারণে আসক্ত ব্যক্তিকে ফেরানো কঠিন। পরিবার যেন প্রত্যেককে হাসিমাখা একটি পরিবেশ দেয়। তবেই প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সুন্দর দেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, এটি মূলত গেমস না, একজন ক্যাপ্টেন পেছন থেকে এটি পরিচালনা করে। এর মোট ৫০টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ৫০তম ধাপে গিয়ে বলা হয়, আত্মহত্যা করতে। আর প্রতিটি ধাপেই ব্যবহারকারীকে একটি করে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। কোনো মানুষ এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকুক, এটা কেউ চায় না। আমাদের এখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে যদি এটি ঢুকে, তবে জাতীয়ভাবে এর গেটওয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ভারতে এরই মধ্যে যেসব এলাকায় এর লিংক আছে, তা মুছে দেওয়া হয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অবশ্যই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, ইন্টারনেটের গেটওয়ে সরকারের হাতে। আমরা শুধু সচেতনতা বাড়াতে পারব। এটি ব্লক করে দেওয়ার চাবি সরকারের হাতে।