‘স্বাধীন নন প্রধান বিচারপতি’
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার কথা আছে। কিন্তু আজ এই স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রধান কর্তাব্যক্তি প্রধান বিচারপতি (সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) নিজেই স্বাধীন নন। তিনি পরাধীন। উনাকে সরকার বলপ্রয়োগ করে ছুটিতে পাঠিয়েছে।
শনিবার দুপুরে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে জয়নুল আবেদীন এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারলেও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতাদের বাধা দেয়া হয়েছে। এটাই প্রমাণ করে প্রধান বিচারপতি স্বেচ্ছায় ছুটিতে যাননি, তাকে বাধ্য করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতে বাধা দেয়ার প্রতিবাদ এবং বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি রক্ষার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনে পাঁচ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন সমিতির সভাপতি। সে অনুযায়ী আজ থেকে সুপ্রিমকোর্ট ও জেলা বারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করবেন আইনজীবীরা।
সংবাদ সম্মেলনে এর আগে বক্তব্য দেন সমিতির সম্পাদক ব্যরিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। বাবু নিতাই রায় চৌধুরী, গাজী কামরুল ইসলাম সজল, মির্জা আল মাহমুদ, ব্যারিস্টার এহসানুর রহমান, আরিফা জেছমিন, উম্মে কুলসুম রেখা, আয়শা আক্তার, শামীমা সুলতানা দীপ্তিসহ শতাধিক আইনজীবী সম্মেলনে ছিলেন। তবে সমিতিতে নির্বাচিত সরকার সমর্থক আইনজীবীদের কেউ ছিলেন না। ওই অংশের নেতা অ্যাডভোকেট নুরে-ই আলম উজ্জ্বল যুগান্তরকে জানান, আমরা রোববার (আজ) দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের অবস্থান জানাব।
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, জাতি খুব কষ্টে আছে, আইনজীবীরা খুব কষ্টে আছে। দেশের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যা চলছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আইনমন্ত্রী বলেছেন তিনি (সিনহা) অসুস্থ, মারাত্মক অসুস্থ, ক্যান্সারের রোগী। এ জন্য তিনি এক মাসের ছুটি চেয়েছেন। কিন্তু আজকে পাঁচ দিন হয়ে গেল, তার হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনই পড়ল না। এতেই প্রমাণিত হয় তিনি সুস্থ। আর সুস্থ বলেই তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিতে যেতে পেরেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনেও গিয়েছিলেন। সরকার তাকে জিম্মি করে ছুটিতে যেতে বাধ্য করেছে।
মাহবুব উদ্দিন বলেন, রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুস্থ বলেই তার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে, তিনিও বলেছেন উনি (সিনহা) সুস্থ। সমিতির সম্পাদক প্রশ্ন করেন- দেশের মানুষ কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা অন্যায়ের শিকার হলে প্রতিকার চাইতে সুপ্রিমকোর্টে আসে। সুপ্রিমকোর্ট অথবা প্রধান বিচারপতির কাছে বিচার চায়। এখন প্রধান বিচারপতি যদি গৃহবন্দি হন বা ভিকটিম হন তাহলে যাবেন কোথায়?
মাহবুব উদ্দিন বলেন, ক্ষমতায় থাকতেই সরকার প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠিয়েছে। আজ প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটল এর অনেক পুনরাবৃত্তি হবে। ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রধান বিচারপতিকে চাপ প্রয়োগ করে, জিম্মি করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে আজকে তাকে আটকে রেখেছে। ভবিষ্যতে এ ঘটনা ঘটলে সুপ্রিমকোর্টের কোনো বিচারক বিচার করবে না।
বিচারপ্রার্থীদের বিচার না পেয়ে চলে যেতে হবে। নিন্ম আদালতের বিচারকরাও সরকারের যে কোনো লোক টেলিফোন করলেই সে অনুযায়ী বিচার করতে হবে। বিচার না করলে তারও চলে যেতে হবে। জাস্ট এরকম ধমক দিবে অস্ত্রধারীরা বা আটকে রাখবে কিংবা তিনি অসুস্থ, ছুটি।
মাহবুব উদ্দিন আরো বলেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠিয়ে তারা যদি সফল হয় তাহলে অনেকের ছুটি হয়ে যাবে। বাংলাদেশে আর কখনও ন্যায়বিচার হবে না। বিচার বিভাগ পরাধীন হয়ে গেল এ ঘটনায়। আফটার এ মান্থ এটার এচিভ হবে, সীমাহীন, ভয়ঙ্কর!’
সমিতির সম্পাদক বলেন, আমরা আস্থা রেখেছিলাম মাননীয় ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির প্রতি। উনাকে নাকি আইনমন্ত্রী বলেছেন. ‘প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে কাউকে বাধা দেয়া হবে না।’ এর ওপর আস্থা রেখেই আমরা শুক্রবার গিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের বাধা দিয়েছে। সরকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও প্রতারণা করেছে। তার সঙ্গে অসত্য কথা বলেছে। তিনি বলেন, ‘কী চায় রাষ্ট্র? রাষ্ট্র চায় বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ হোক, বিচার নিয়ন্ত্রণ হোক গণভবন থেকে, সংসদ থেকে। সেটা বিচার হবে না, সালিশ হবে। সিদ্ধান্ত যেমন আসবে, সে অনুযায়ী রায় হবে।
পরে জয়নুল আবেদীন এসকে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার পথে পুলিশি বাধার বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তারা (সরকার) প্রধান বিচারপতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তিনি অন্তরীণ। একমাত্র সরকার নির্দেশিত ব্যক্তিরাই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারবে, অন্যরা নয়।
সভাপতি বলেন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে সম্পাদকসহ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা শুক্রবার বিকাল ৫টায় প্রধান বিচারপতির বাসার দিকে রওনা দিই। বার কাউন্সিল ভবনের সামনে ট্রাফিক লাইটে পুলিশ আমাদের গাড়িবহর আটকে দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকধারী ও সাদা পোশাকধারী ৩০-৩৫ জন বার সভাপতির গাড়ি ঘিরে ফেলে। তারা জানতে চায় বার সভাপতি কোথায়। আমি তখন অন্য গাড়িতে ছিলাম। সভাপতির গাড়িতে থাকা সমিতির সদস্যদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হই।
জয়নুল আবেদীন আরো বলেন, প্রধান বিচারপতির ছুটির যে চিঠি প্রকাশ করেছে, সেই চিঠিতে অনেক বানান ভুল। চিঠি নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ জানিয়েছে। প্রধান বিচারপতির মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কিভাবে ৫টি বানান ভুল থাকা চিঠিতে স্বাক্ষর করতে পারেন!
সাংবাদিকদের উদ্দেশে সমিতির সভাপতি বলেন, সাংবাদিকরাও দেশের নাগরিক। তাদেরও দায়দায়িত্ব আছে। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখার জন্য প্রধান বিচারপতির (এসকে সিনহা) স্টেটমেন্ট (বক্তব্য) কী সেটা জানুন।