• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

আবাহনী আর অমলেশ সেন যেন একই সুতোয় বাঁধা

প্রকাশ:  ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ২০:২৩
ক্রীড়া প্রতিবেদক
প্রিন্ট

স্কুলজীবন থেকেই ফুটবলের প্রেমে জড়িয়ে আছেন অদ্যবধি। গোল কিপিং ছাড়া দলের প্রয়োজনে সব পজিশনে খেলতেই অভ্যস্ত ছিলেন। ছোট বেলায় ফুটবল প্র্যাকটিস করতেন টেনিস বল দিয়ে। ফুটবল বোদ্ধারা ওই ছোট টেনিস বলে তার নিয়ন্ত্রণ দেখেই আঁচ করতে পেরেছিলেন বড় হয়ে একদিন মাঠ কাঁপাবেন। তাদের কল্পনাকে ভুল প্রমানিত করেননি। একজন দক্ষ ফুটবলার হিসেবেই নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। কখনও ফুটবলার কখনও কোচ কখনও বা দলের অভিভাবক। বয়সের ভার স্পষ্ট চোখে মুখে পড়লেও এখনও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন ফুটবলের সঙ্গে। একজন সদালাপী নিরহংকার মানুষ বলতে যা বুঝায় তিনি তাই। সবার প্রিয় অমলেশ শেন। ফুটবল সমর্থকরা যাকে ডাকেন বা চিনেন অমলেশ দা হিসেবেই। শনিবার তিনি পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। 

জন্ম বগুড়ায় ২ মার্চ ১৯৪৩ সালে। বগুড়ার আলতাফুন্নেসা মাঠেই তার ফুটবলের হাতে খড়ি। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের সঙ্গে সখ্যতা। তৎকালীন বাইটন ক্লাবের হয়ে তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু। বগুড়ায় খেলেন পাঁচ বছর। তারপর পাড়ি জমান রাজধানীতে। ঢাকায় খেলেন ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস আর ইস্টএন্ডের হয়ে। ১৯৭০ সালে যোগ দেন ঢাকা মোহামেডানে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন অমলেশ শেন। ১৯৭২ সালে যোগ দেন ঢাকা আবাহনীতে। সেই থেকে টানা ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত খেলেছেন তার প্রিয় দলেই। অবসর গ্রহণের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি আবাহনীর সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। আর তাই তো সমর্থকরা তাকে আবাহনীর অমলেশ হিসেবেই জানেন।

গত বছরের ২৫ মে কথা হয়েছিল খ্যাতিমান এই ফুটবলারের সাথে। ফুটবল ক্যারিয়ারে স্মৃতিময় ঘটনা প্রসঙ্গে অমলেশ বলেন, বাংলাদেশ ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল আবাহনী-মোহামেডান। এই দুই দলের প্রথম মোকাবেলা থেকে আজ অবধি প্রত্যেকটা খেলায় উত্তেজনা বিরাজ করে। অনেক সমর্থকরা জানেন না প্রথম মোহামেডান-আবাহনীর মোকাবেলায় আবাহনী ২-০ গোলে জয়লাভ করে এবং প্রথম গোলটি আমার পা থেকেই আসে। দ্বিতীয়টি করেন কাজী সালাউদ্দিন। সেদিনের সেই আনন্দের মুহূর্তটা আজও মনে পড়ে। এখনও চোখে ভাসে সেই স্মৃতি। ১৯৭২ সালে আবাহনী-মোহামেডান প্রথম মোকাবেলা প- হয়ে যায়। ১৯৭৩ সালে মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ভাই তখন মোহামেডানের স্টপার ব্যাক। মোহামেডানের গোলরক্ষক বল ধরে বাম দিকে পিন্টু ভাইকে পাস দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি চেজ করি। আমাকে এগিয়ে যেতে দেখে পিন্টু ভাই আবার গোলরক্ষককে ব্যাক পাস দেন। কিন্তু বল গোলরক্ষকের কাছে যাওয়ার আগেই আমি দ্রুততার সঙ্গে ছোঁ মেরে বল ধরে নিয়ে গোল করি। আজও মনের কোণে পরিষ্কার সেই স্মৃতি। যখন অবসর সময় কাটাই তখন এই স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় আবাহনী খুব কোণঠাসা অবস্থায় পড়ে। সে সময় অনেকেই চলে গেলেও অমলেশ শেন তার গভীর মমতা আর ভালবাসা দিয়ে বুকে আগলে রাখেন ক্লাবকে। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন অন্তত এই আবাহনীকে টিকিয়ে রাখার। তার সে ইচ্ছা সফল হয়েছে বলেই তিনি মনে করেন। অমলেশ ক্যারিয়ারের শুরুতে খেলেন আক্রমণভাগে, পরবর্তীতে মধ্যমাঠ এবং সর্ব শেষে রক্ষণভাগে। সব পজিশনেই তিনি খেলেছেন দক্ষতার সঙ্গে। ফুটবল খেলতে বগুড়া থেকে ঢাকা আসা প্রসঙ্গে আবাহনী কিংবদন্তি বলেন, ‘আমি তখন বগুড়া জেলা দলে খেলি। ওই দলের ২-৩ জন খেলোয়াড় ঢাকায় দ্বিতীয় বিভাগ দলের ক্লাব ফায়ার সার্ভিসে খেলতেন। তারাই আমার ঢাকায় খেলার সুযোগ করে দেন। সেটা ১৯৬২ সালের ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার ছিলেন সাত্তার ভাই নামে একজন। তিনি নিজে আমাকে বগুড়ায় আনতে যান। আমার তখন শান্তাহারে একটা ম্যাচে খেলতে যাওয়ার কারণে ঠিক ওই সময় ঢাকা রওনা দিতে পারিনি। পরে উনিও আমার সঙ্গে শান্তাহার যান। খেলা শেষে তার সঙ্গে ঈশ্বরদী আসি ঢাকার ফ্লাইট ধরতে। আমার জীবনের প্রথম প্লেনে চড়া। আমার মনে আছে তখন প্লেন ভাড়া ছিল ২৭ টাকা। ঢাকায় এসে দামী রেস্তরাঁয় খাওয়া দাওয়া করি। প্রথম প্লেনে চড়া আর দামী রেস্তরাঁয় খাওয়ার বিষয়টা আমাকে খুব আনন্দ দিয়েছিল। তাছাড়া প্রথম ম্যাচেই আমি দুই গোল দিয়ে নিজের জায়গাটা পোক্ত করে নেই।’

ঢাকা প্রথম বিভাগ লীগে অমলেশের অভিষেক হয় ১৯৭০ সালে ঢাকা মোহামেডানে। সাদা-কালো শিবিরে খেলার সুযোগ করে দেন ওই সময়ে মোহামেডানের ফুটবল দলের ম্যানেজার ফারুক ভাই। সেবার ঢাকা মোহামেডান রানার্সআপ হয়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে খেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অমলেশ জানান, কৃষ্ণনগরে স্বাধীন বাংলা দলের প্রথম ম্যাচ। তখনও বাংলাদেশকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। এজন্য বাংলাদেশের পতাকা উড়াতে বাধা দিয়েছিলেন নদীয়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু আমরা বলি বাংলাদেশের পতাকা না উড়াতে দিলে আমরা খেলব না। পরে তিনি রাজি হন। আমরা শুনেছিলাম এ কারণে তাকে নাকি সাসপেন্ড করা হয়েছিল।

আবাহনীতে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে। কোলকাতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিল হকি খেলতে। আমি সেই খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখা হয় প্রতাপ সঙ্কর হাজরার সঙ্গে। তিনি আমাকে ঢাকায় ফিরে মোহামেডানে যোগ দেয়ার কথা বলেন। মজার ব্যাপার হলো তখন তানভির মাজহার তান্না আবাহনীর জন্য জার্সি কিনতে কোলকাতায় যান। সেখানে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, কাজী সালাউদ্দিন ও গোলাম সারোয়ার টিপু আবাহনীতে যোগ দিয়েছেন। আমি কোথায় খেলব এই নিয়ে একটু টেনশনে পড়ে যাই। পরে ঢাকায় এসে আবাহনীতেই রেজিস্ট্রেশন করি। আবাহনীকে আধুনিক ফুটবলের জনক বলা প্রসঙ্গে অমলেশ বলেন, সালাউদ্দিনের সহযোগিতায় ১৯৭৪ সালে আবাহনীর কোচ হিসেবে যোগ দেন উইলিয়াম বিল হার্ট। সেবার বিশ্বকাপে হলান্ড যে খেলাটা খেলেছিল ঠিক সেই ধাঁচেই তৈরি করেছিল আবাহনীকে। সেই থেকেই শুরু আধুনিক ফুটবলের ছোঁয়া।

খেলোয়াড় হিসেবে এবং কোচ হিসেবে সেরা সাফল্য প্রসঙ্গে অমলেশ বলেন, ১৯৭৭ সালে আবাহনীর তেমন কোন কোচ ছিল না। সাদেক ভাই আর আমি দল চালাতাম। সাদেক ভাই ছিলেন মূল কোচের ভূমিকায় আর আমি খেলোয়াড় কাম সহকারী কোচ। সেবার আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। সরাসরি কোচ হিসেবে সাফল্য পেশাদার ফুটবলে হ্যাটট্রিক লীগ চ্যাম্পিয়ন। আপনাদের সময়ের ফুটবলার আর এখনকার ফুটবলারের মধ্যে তফাৎ কোথায়? প্রশ্ন শেষ না হতেই তিনি জানান ‘অর্থ’। অমলেশ বলেন, আমাদের সময় আমরা অর্থের জন্য খেলিনি তা নয় কিন্তু আমাদের ক্লাবের প্রতি দরদ ছিল অগাধ। এখনকার খেলোয়াড়দের ক্লাবের প্রতি কোন দরদ নেই। তাদের কাছে মনে হয় অর্থটাই মুখ্য। এ প্রসঙ্গে তিনি যোগ করেন ১৯৮২-১৯৮৩ সালে যখন আবাহনীর পাকির আলি আর অশকাকে টাকা দিতে হবে তখন ফান্ডে টাকার স্বল্পতা। আমি তখন ক্লাবে পাই চার লাখ টাকা। আমি ওই টাকা তাদের দিয়ে বিদায় করতে বলি। আমাদের ক্লাবের প্রতি মমতা ছিল। এরকম অনেকেই করেছেন। আজ এসব কোথায় পাবেন।

ফুটবলে ‘কষ্ট’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একটু আবেগি হয়ে অমলেশ বলেন, না আমার কোন কষ্ট নেই। আমি কোনদিন টাকার পিছনে দৌড়াইনি। টাকার জন্য দলবদল করিনি। এভাবেই তো জীবন পার করে দিলাম। অনেকেই অনেক কিছু করেছে। আমি জীবনে কিছুই করতে পারিনি। কখনও ভাবিনি কিছু করতে হবে। আবাহনী ক্লাবসহ অন্যান্য ক্লাবের খেলোয়াড় কর্মকর্তারা সবায় আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। এই সম্মান নিয়েই যেন চলে যেতে পারি। আমার কোন আক্ষেপ নেই। বর্তমানে দর্শক খরা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন আবাহনী-মোহামেডানের খেলায় দর্শক হাতেগোনা যাবে। অনেকে জানেই না মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ কবে। বড়ই পরিতাপের বিষয়। অথচ এক সময় ছিল যখন এমন কোন বাড়ি ছিল না যে দুই দলের পতাকা উড়েনি। ৫টায় খেলা হলে ১২টায় গেট বন্ধ। ভাবাই যায় না। আমি মনে করি বাংলাদেশ ফুটবলের জাগরণে আবাহনী-মোহামেডানের বিকল্প নেই। এখনও যদি মোহামেডান-আবাহনী ভাল দল গঠন করে ভাল মানের বিদেশী আনে অবশ্যই ফুটবল আবারও জেগে উঠবে আমি নিশ্চিত। কারণ বাংলাদেশের ফুটবলের সমর্থক এখনও এই দুই ভাগেই বিভক্ত।

ফুটবল ক্যারিয়ারে দীর্ঘ সময় খেলেছেন আবাহনীতে। মাঝখানে ১৯৯০-১৯৯৫ পর্যন্ত কোচ হিসেবে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধায়। ১৯৯৬ সালে আবার তিনি আবাহনীর কোচের দায়িত্ব পালন করেন এবং এ পর্যন্ত আবাহনীর সঙ্গেই আছেন। ফুটবল ছাড়াও তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বগুড়া একাদশের ওপেনিং ব্যাটসম্যান। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। তাছাড়া ১৯৯৮ সালে পান জাতীয় পুরস্কার। স্ত্রী আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে অমলেশ সেনের সংসার। ছোট ছেলে ইশান সেন নর্থ সাউথে পড়ে কম্পিউটার সায়েন্সে। মেয়ে অহনা সেন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। বড় ছেলে অর্ণব সেন এক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেলে পড়াশুনা থেকে কিছুদিন বিরত ছিলেন।

দাড় টানা মাঝি যেমন ঝড় বৃষ্টি রৌদ্র উপেক্ষা করে বেয়ে চলে তার তরী, অমলেশ সেন তেমনিভাবেই খেলোয়াড়ি জীবন থেকে এখন পর্যন্ত নিরলস প্রচেষ্টায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন তার প্রিয় ক্লাব আবাহনীকে। ক্লান্তি কিংবা অর্থের মোহ কখনই তাকে বিচ্যুতি হতে দেয়নি আবাহনী থেকে। ক্লাবের সুসময় আর দুঃসময় সব সময়েই হাল ধরেছেন একজন দক্ষ সেনাপতির মতো। ক্লাবের বহু জয়-পরাজয়ের হিসাব মিলিয়েছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন আবাহনী ক্লাবে। যেন একই সুতোয় বাঁধা আবাহনী আর অমলেশ সেন।