১১ বছরের কষ্টকে শক্তি মনে করে এগিয়ে যেতে চায় শ্রাবণী
শ্রাবণী এখন মুক্ত বিহঙ্গ। আকাশে উড়তে পারার প্রথম দিনটি যেমন পাখির কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। তেমনি ১১ বছর পূর্বে হারিয়ে ফেলা উচ্ছ্বাস যেনো নূতনভাবে ফিরে পেলো সে। শ্রাবণীর নূতনভাবে ফিরে আসার গল্প তার পরিবার নয়, পুরো স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলিত করেছে। রেল দুর্ঘটনায় যেই মেয়েটি এক পা-বিহীন ক্র্যাচে ভর দিয়ে ঢাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পরে গ্রামের আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়মিত এসেছে। যার চোখে স্বপ্ন ছিলো, দুর্ঘটনায় একটি পা গিয়েছে তো কী হয়েছে, মনের জোর তো কমেনি। তার অসীম মনের জোরে মেধাবী শ্রাবণী আজ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার শিক্ষকদের দৃষ্টি পড়া এবং প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের সংগঠন চাঁদপুর ডিপিওডির সহায়তায় চট্টগ্রামের এ কে খান সিআরপি থেকে কৃত্রিম পা লাগিয়ে আসার পর শ্রাবণী এক নতুন জগতে প্রবেশ করে। তার চোখের ভাষা বলে দেয় সে নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। সমালোচনাকারীদের কাছে পা হারানো এই মেয়েটি পা লাগিয়েছে, এমন আর কি। কিন্তু পাঠকমাত্রই সকলকে অনুধাবন করতে হবে, বিষয়টিকে খুব সাদামাটাভাবে দেখলে ভুল হবে। প্রথমত শ্রাবণী দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করা এক পরিবারের সন্তান। দারিদ্র্যতা ও পঙ্গুত্বের সুযোগে অনেক পরিবারই হয়তো তার হাতে ভিক্ষের থলি ধরিয়ে দিতো। মেয়ে না হয়ে সে যদি ছেলে হতো তখন গল্পটা হয়তো একটু অন্যরকম হতো। কিন্তু এক পা হারিয়ে সে ঘরে বসে থাকেনি। অন্য ভাই-বোনদের সাথে সে নির্দিষ্ট বয়সেই স্কুলে গিয়েছে। ভালো ফলাফল করেছে। আর তাই শ্রাবণীর গল্পটা আজ অন্য যে কোনো কিছুর থেকে একটি আলাদা। চলুন এবার শুনি বিহঙ্গ শ্রাবণীর মুক্ত ইতিকথাÑ
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১০নং গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর মোল্লা বাড়ির ছেলে রফিক মোল্লা। তার এবং স্ত্রী নাছিমা বেগমের ৪ সন্তানের পরিবার। বর্তমানে বড় মেয়ে রাহিমা (বিবাহিত), মেঝ মেয়ে শ্রাবণী, ছোট মেয়ে মিম এবং একমাত্র ছেলে ছিদ্দিকুর রহমান। রফিক মোল্লা ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় বসবাস করতেন। কারওয়ান বাজারের উপর দিয়ে যাওয়া রেললাইনের একপাশে ছিল তাঁর ছোট্ট একটি কাঠের দোকান এবং বিপরীত পাশে একটু দূরে ছিল তার বাসা। সেখানেই থাকার সময় ২০০৮ সালের দিকে হঠাৎ করেই তার দ্বিতীয় মেয়ে তিন বছরের শ্রাবণী তথা শাবু হারিয়ে যায়।
হারিয়ে যাওয়ার তিন মাস পর কাকতলীয়ভাবেই খুঁজে পান শ্রাবণীকে। যদিও বিষয়টি নিয়ে ওই সময়ে পুলিশ অযথা আইনি ঝামেলা করেছিল। শ্রাবণীকে ফিরে পেয়ে মা-খালা-বাবা-ভাই-বোন সকলের মুখে আনন্দের বন্যা। খুঁজে পাওয়ার কয়েকদিন পরের কথা। ওই বছরের কোন একটি বুধবার বিকালের কথা। ছোট্ট থেকেই ফুটফুটে শ্রাবণী সকলের আদরের। তাই ওইদিন বিকালে সে মা-খালাদের সাথে ঘর থেকে বের হয়েছিল। রাস্তার এক পাশে বাবার দোকান, একটু দূরে তথা রেললাইনের অপরপাশে তাদের বাসা। খেলতে খেলতে শ্রাবণী হঠাৎ করেই রেললাইনের উপর ওঠে পড়ে। ওই সময়ে একটি ট্রেন অতিক্রমও করছিল সেই এলাকা। ফলে ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে বাম পা হারায় শ্রাবণী। প্রায় দুই বছর চিকিৎসার পর সে প্রাণে বেঁচে ফিরলেও ক্র্যাচই তার ভরসা হয়ে ওঠে।
কিন্তু সে থেমে যায়নি। চালিয়ে গেছে পড়ালেখা এবং জীবনের সাথে করেছে যুদ্ধ। পিতার আর্থিক অনটনের কারণে ঢাকা থেকে গ্রাম ফরিদগঞ্জের গোবিন্দপুর গ্রামে চলে আসে। প্রাথমিকের গ-ি পেরিয়ে মাধ্যমিকে এসেছে। বর্তমানে সে গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সদ্য যোগদানকৃত সহকারী প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কান্তি সরকার প্রতিদিন সকালে বিদ্যালয়ের এসেমব্লি চলাকালে শ্রেণিকক্ষের জানালার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রাবণীর মলিন মুখটি তার দৃষ্টি কাড়ে। এক পা না থাকায় সে অংশ নিতে পারতো না।
তার পা হারানোর সব কিছু শুনে তাকে পা ফিরে পাওয়ার আশ্বাস দিয়ে জেএসসিতে ভালো ফলাফল করার জন্য লেখাপড়ার কথা বলেন। শুরু হয় শ্রাবণীর জীবন সংগ্রাম, রাত দিন কঠোর পরিশ্রম এবং স্কুল ফাঁকি না দিয়ে কঠোর অধ্যাবসায়। জেএসসিতে সে এ মাইনাস পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়।
এরই ফাঁকে সহকারী প্রধান শিক্ষক বিপ্লব কান্তি সরকার যোগাযোগ করেন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন সংগঠন চাঁদপুর-ডিপিওডির পরিচালক মমতাজ উদ্দিন মিলনের সাথে। তিনি শ্রাবণীর বিষয়ে জানতে সরেজমিন যান। তার অবস্থা দেখে চট্টগ্রামের এ কে খান সিআরপিতে যোগাযোগ করলে তারা সাড়া দেয়। গত ২৮ জানুয়ারি শ্রাবণী মা নাছিমা বেগমকে নিয়ে নতুন স্বপ্নের উদ্দেশ্যে রওনা চট্টগ্রাম। বাম পায়ে নতুন একটি পা সংযোজন করে এবং চলাফেরার প্রশিক্ষণ নিয়ে এক মা নয়দিন পর ফিরে আসার পর গত ৬ মার্চ বুধবার সে সকালে ক্র্যাচ ছাড়াই দুই পায়ে হেটে স্কুলে যায়। শুরু হয় শিক্ষক ও সহপাঠীদের উচ্ছ্বাস। সকলের চোখে মুখে শ্রাবণীর ফিরে আসার কথা বলাবলি হচ্ছে। অনেকেই এই বিষয়টি গতানুগতিক বলে বাতিলের খাতায় ফেললেও ভিন্ন চোখে দেখেছেন কেউ কেউ। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামনে তার সাবলীল কথা, প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে চোখে মুখে নিজেকে আরো দূরে ছাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রধান শিক্ষক কবির আহাম্মদ, চাঁদপুর-ডিপিওডির পরিচালক মমতাজ উদ্দিন মিলনের মধ্যেও আলোড়িত করেছে।
তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রাবণী তার চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে বলে, গত ১১টি বছরের কষ্টকে শক্তি মনে করে এগিয়ে যেতে চাই। পরিবারের জন্য এবং সমাজের জন্য কিছু করে জানান দিতে চাই পা হারালেও আমরা পিছিয়ে নেই। সে জানায়, ঢাকার বাসা থেকে অনেকটা দূরে বিজি প্রেস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্র্যাচে ভর করেই যেতে হতো। পরে অভাবের কারণে পিতা তাদেরকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে, সে বাড়িতে এসে বাড়ির পাশের মধ্য গোবিন্দপুর আব্দুল লতিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে এসে ভর্তি হয়। সেখান থেকেই পিএসসি পরীক্ষায় পাস করে ভর্তি হয় গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। বর্তমানে তার বাড়ির সামনে থেকে উভয় স্কুলের সামনে পর্যন্ত সড়ক পাকা হলেও কয়েক মাস পুর্বেও ছিল কর্দমাক্ত। ফলে ক্র্যাচের উপর ভর দিয়ে তাকে কষ্ট করে তাকে প্রতিদিন স্কুলে আসতে হতো। কিন্তু নিতান্ত শারীরিক অসুস্থতা না হলে, সে একটি দিনের জন্যেও স্কুল ফাঁকি দেয়নি।
বাবা রফিক মোল্লা জানান, তিনি ১১ বছরের পূর্বের শ্রাবণীকে ফিরে পেয়েছেন। এখন তার ইচ্ছা অদম্য মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করা। আনন্দাশ্রু নিয়ে মা নাছিমা বেগমের মতো দাদী আফিয়া বেগমও কথা বলতে পারেননি। শুধু বলেছেন, শাবু আমাদের পরিবারে নূতন স্বপ্নের সঞ্চার করেছে।
এবারের নারী দিবসের শ্লোগান ছিলো সবাই মিলে ভাবো নূতন কিছু করো। যেই কাজটি আরো আগে সম্ভব ছিল, সেই কাজটিই স্কুল কর্তৃপক্ষ, চাঁদপুর-ডিপিওডি ও চট্টগ্রামের এ কে খান সিআরপি কর্তৃপক্ষ করলেন ফরিদগঞ্জের শ্রাবণীর জন্যে। নূতন করে বুনে দিলেন স্বপ্নের বীজ।