মহামারিতে নারীর প্রতি বৈষম্য আরও বেড়েছে
দুর্যোগে নারীর সংকট বেড়ে যায়। মহামারি, যুদ্ধ, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়ের সময় নারী ও পুরুষের অবস্থানগত পার্থক্য আরও প্রকট হয়। চলমান করোনা মহামারি তার ব্যতিক্রম নয়। এই মহামারির সময় বৈশ্বিকভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়তে দেখা গেছে, তেমনি এই মহামারিকালে নারীরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে আরও বেশি অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছেন। বাংলাদেশেও এই পরিস্থিতি দেখা গেছে।
করোনা মহামারি শুরুর এক বছর পর গত বছর মার্চে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২১’ বলেছিল, কোভিড–১৯ মহামারি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও সমাজ গড়ে তুলতে নতুন বাধার সৃষ্টি করেছে। আগে থেকে থাকা বা বিরাজমান নারী–পুরুষের বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এই মহামারি।
মহামারির কারণে মানুষ কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে থেকেছে, মানুষকে ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে। মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের অসহায়ত্ব যেমন বেড়েছে, একইভাবে সহায়তা বাড়েনি। কারণ, সমাজে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহায়তা ও সেবার যে ব্যবস্থা ছিল তা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে পড়েছে। এর চাপ বেশি পড়েছে নারীর ওপর।
মহামারির শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বলেছিল, রোগের প্রকোপ পুরুষ ও নারীর ওপর ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা খাতের বৈশ্বিক জনবলের ৭০ শতাংশ নারী। তাঁদের ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। দুশ্চিন্তা–উত্তেজনা বেড়ে গেলে সঙ্গীর হাতে নির্যাতন বা পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যেতে পারে। যৌন ও প্রজনন অধিকারের লঙ্ঘন হতে পারে। ইউএনএফপিএ তখন বেশ কিছু সুপারিশও করেছিল।
আন্তর্জাতিক একাধিক প্রতিষ্ঠান নারীর ঝুঁকির বিষয়গুলো নিয়ে সতর্ক করলেও নীতিনির্ধারকেরা যথাযথ মনোযোগ দেননি বলে অভিযোগ আছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারী সংখ্যালঘু। মহামারি মোকাবিলায় দেশে দেশে যে তৎপরতা দেখা গেছে, নারীর বিশেষ বিশেষ সমস্যার কথা তাতে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব পেয়েছে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে (২০২০) বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। রোগী শনাক্ত হওয়ার আগেই স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা মহামারিবিষয়ক জাতীয় নীতি ও কর্মকৌশল এবং পরবর্তী সময় জাতীয় করোনা টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করে। সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বলেন, ওই দুটি ও নীতিতে নারীদের ব্যাপারে পৃথক গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ কিছু বলা হয়নি।
সেবা কম পেয়েছেন নারী
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর ব্যবহার এবং প্রয়োজনের সময় তা না পাওয়া (অপূর্ণ চাহিদা) নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দুজন গবেষকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, মহামারির সময় বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর অপূর্ণ চাহিদা কোনো কোনো জেলায় বেড়ে ২৪–২৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনের সময় ওইসব জেলার ২৪–২৫ শতাংশ দম্পতি হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পাননি।
গত পাঁচ দশকে অপূর্ণ চাহিদার হার ক্রমাগতভাবে কমতে দেখা গেছে। মহামারি শুরুর আগে অপূর্ণ চাহিদার হার ছিল ১২। এখন তা বেড়েছে।
বাংলাদেশের দম্পতিদের মধ্যে পুরুষদের চেয়ে নারীদেরই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বেশি ব্যবহার করতে দেখা যায়। মহামারির সময় নারীরাই মূলত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পাননি।
আবু জামিল ফয়সালের আরেকটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সালের মে থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত এক বছরে একটি খাওয়ার বড়ির (সুখী) ব্যবহার কমেছে প্রায় ১ শতাংশ। এর অর্থ নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করতে হয়েছে।
নারীর গর্ভধারণকালে, প্রসবের আগে এবং প্রসব–পরবতী সেবার প্রয়োজন। সেই সেবাও নারীরা মহামারির সময় কম পেয়েছেন। বিধিনিষেধ বা চলাচলের বিধিনিষেধের কারণে নারীরা সেবাকেন্দ্রে যেতে পারেননি, সেবা নেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। অথবা সেবাকেন্দ্রে সেবাদান করা ব্যক্তি উপস্থিত থাকতে পারেননি। এতে নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, মহামারির শুরু থেকে নারীর ব্যাপারে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, জরুরি সরবরাহ ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় গুরুত্ব পায়নি।