• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশের হাসি

প্রকাশ:  ২৫ মে ২০১৯, ২০:৪৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশের হাসি
প্রিন্ট

প্রথম ফাইনাল জিতল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। রোমাঞ্চকর সেই জয় একদম কাছ থেকে দেখেছেন আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় এই টুর্নামেন্টে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া প্রথম আলোর ক্রীড়া সাংবাদিক রাজীব হাসান। জানিয়েছেন সেই মুহূর্তের কথা।মাশরাফিও যে নখ কামড়ান, জানা ছিল না! বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যক্তিত্ব নন, সাংসদও নন, মাশরাফিকে তখন দেখাচ্ছিল টিভির শোরুমের স্বচ্ছ কাচের বাইরের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর দশটা কিশোর সমর্থকের মতোই! আমাদের নিজস্ব সুপারম্যান, তাঁরও সে কী টেনশন!ততক্ষণে বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা প্রায় সবাই ড্রেসিংরুমের আরামদায়ক উষ্ণতা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। কিন্তু ক্রিকেটাররা সেই ঠান্ডাই বেছে নিলেন। উত্তেজনার নিজস্ব একটা উত্তাপ আছে। তার কাছে হার মেনেছে ডাবলিনের ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা!

৩ ওভারে ২৭ রান লাগে। তিন নং সাতাশ! নামতায় সহজ, ব্যাটে কঠিন। কঠিন, আবার কঠিনও নয়। টি-টোয়েন্টির ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’ জমানায় এ আবার কোনো রান নাকি! একটা ওভারে ঝড় তুললেই তা হয়ে যায়। আবার ওই একটা ওভারে রান তুলতে না পারলেই সর্বনাশ। এ বড় দারুণ বাজি, যে পারে তারে কই বড় বাজিকর! বাংলাদেশের হয়ে বাজিকরটা কে হবেন? স্ট্রাইকিং প্রান্তে মোসাদ্দেক, সাকিব পুরো ফিট থাকলে এই ম্যাচে যাঁর খেলাই হতো না।তাঁবুমতন প্রেসবক্সের অসুবিধাই এত দিন পেয়ে এসেছি। এদিন পেলাম সুবিধা। সামনের দিকে উদোম প্রেসবক্সের কারণেই তো একই সঙ্গে উইকেট আর ড্রেসিংরুম—দুটোই নজরে রাখার সৌভাগ্য হচ্ছিল। বল করতে আসছেন ফাবিয়েন অ্যালেন। প্রস্তুত মোসাদ্দেক। স্ট্যান্স নিতে গিয়ে ব্যাটটা হালকা নাচালেনও। গদার মতো!বাংলাদেশের বাকি সব খেলোয়াড় ড্রেসিংরুমের পাশে উঠানমতো দেখতে ফাঁকা জায়গাটায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে। সবাইকে অভয় দিয়ে নিজেই পেছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।

মাশরাফির টেনশনের কারণটা বোঝা যাচ্ছিল। ফাইনাল শব্দটা জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এর আগে ছয়-ছয়টি ফাইনালে বাংলাদেশ পারেনি। পারেনি বলেই সেটি হয়ে উঠেছে একটা মানসিক বাধা। শিরোপা জেতার চেয়ে এই মানসিক বাধাটা ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলার জন্যই বেশি ব্যাকুল অধিনায়ক।অ্যালেন বল করলেন। মোসাদ্দেক শেষ মুহূর্তে সরে আসছেন দেখে ইচ্ছে করেই লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরে বলটা ফেললেন ক্যারিবীয় স্পিনার। উদ্দেশ্য মোসাদ্দেকের ভারসাম্য নষ্ট করা। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়, মোসাদ্দেক ওরই মধ্যে যেন সুপারসনিক গতিতে কত কিছু করে ফেললেন! স্ট্যান্স বদলালেন, ব্যাটের গ্রিপ অদল-বদল হলো, ডানহাতি মোসাদ্দেক হয়ে গেলেন বাঁহাতি, লাফিয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে অ্যালেনের বলে পয়েন্টকে স্কয়ার লেগ বানিয়ে মেরে দিলেন ছক্কা!ওই একটা শটে কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস থাকল, বোকা অক্ষরের সাধ্য নেই বোঝায়! ওই একটা শটেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল! নাকি ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ঢের আগে, সৌম্যের নিজের নামের আভিধানিক অর্থটাকে উল্টে দিয়ে রুদ্ররূপে হাজির হওয়াতেই!সত্যি বলতে কি, মোসাদ্দেকের ওই শটের পর ওভারের বাকি ৫টা বল আর দেখাই হলো না। এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, ওই ওভারের বাকি ৫ বল সত্যিই আমি দেখিনি। দেখার উপায়ই আসলে ছিল না।

বাংলাদেশের চেয়ে আয়ারল্যান্ড সময়ে ৫ ঘণ্টায় পিছিয়ে। ছাপা পত্রিকার ডেডলাইনের সঙ্গে সফরের পুরোটা সময় পাল্লা দিতে হয়েছে। ফাইনালের দিন বৃষ্টি কাজটাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল সব দিক দিয়েই। বৃষ্টিবাধায় ৫ ঘণ্টার মতো বন্ধ ছিল খেলা। আয়ারল্যান্ডে আধা মাসের সফরে ওই দিনটার আবহাওয়া ছিল সবচেয়ে প্রতিকূল। ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতের আঙুলের ডগা যেন কি–বোর্ডে বসতেই চাইছিল না। এর সঙ্গে ম্যাচের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা তো আছেই। পেশাদার সাংবাদিকের খোলসের ভেতরে কেই–বা এই দলের সমর্থক নয়! এই দল জিতলে আর দশটা সমর্থকের মতোই তো আবেগ ছুঁয়ে যায়। কিন্তু এই পেশার যন্ত্রণাটাই হলো, রেললাইনে গর্দান পেতে রাখা অবস্থাতেও আপনাকে লিখে যেতে হবে! অফিস যে তাড়া দিচ্ছে, যা লিখেছেন, সেটাই দিয়ে দেন!মোসাদ্দেকের ওই সুইচ হিটের ছক্কার পরও বাংলাদেশের দরকার ১৭ বলে ২১। ম্যাচ বাংলাদেশ হারতেও পারে। কিন্তু অফিসের তাড়া, নাকি মোসাদ্দেকের ওই সুইচ হিটের প্রবল আত্মবিশ্বাসের ঢেউ প্রেসবক্সেও এসে আন্দোলিত করে গিয়েছিল—এখন আর বলতে পারব না। ১৭ বল বাকি থাকতেই ম্যাচ রিপোর্ট লেখা শুরু করে দিয়েছি। বাংলাদেশ জিতেছে ধরে নিয়েই। ইন্ট্রোর জায়গাটা ফাঁকা রেখে বাকিটা লেখা শুরু। বাংলাদেশের উদ্​যাপন ধরে সূচনা লিখব, পরিকল্পনা এমনই।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, বাংলাদেশের দরকার মাত্র ২ রান! ম্যাচ রিপোর্টের এক প্যারাও তখনো লেখা হয়নি! এক ওভারেই ২৫ তুলে মোসাদ্দেক ‘সর্বনাশ’ করে দিয়েছেন! ওয়েস্ট ইন্ডিজের শুধু নয়, বেচারা সাংবাদিকদেরও। অনেকেরই তখনো ইন্ট্রোই লেখা হয়নি। কেউ মাত্র একটা আবেগপ্রবণ শিরোনাম লিখেছেন কি লেখেননি! ওই একটা ওভার সর্বনাশ করে দিয়ে গেল অন্যভাবে। ম্যাচ ঘিরে যত উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, ওই ওভার দপ করে সেটা নিভিয়ে দিল। বাংলাদেশের উদ্​যাপন যেমনটা হবে বলে অনুমান করেছিলাম, অনেকে তো আগ বাড়িয়ে মুঠোফোনের ক্যামেরা পর্যন্ত তাক করে রেখেছিল, সব ভেস্তে গেল। কেউ দৌড়ে মাঠে ঢুকল না। স্টাম্প নিয়ে কাড়াকাড়ি পর্যন্ত হলো না! অথচ যেকোনো বিচারেই এটি বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক এক জয়!

বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরা অবশ্য ট্রফিটা হাতে পাওয়ার পর বেশ উচ্ছ্বসিতই ছিলেন। প্রেসবক্স থেকে মাশরাফির কথাটা স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল—‘অবশেষে! অবশেষে!’ মনে পড়ছিল, আগের দিন ফাইনাল শব্দটা নিয়ে অধিনায়কের সে কী টেনশন! আরও একবার ব্যর্থ হলে এর ক্ষতি যে হতো সুদূরপ্রসারী। তবে কি আমরা পারি না—এমন একটা ভয় স্থায়ী জায়গা করে নিত। সত্যি বলতে গিয়ে ম্যাচটা সেদিকেই যাচ্ছিল। বৃষ্টির আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান বিনা উইকেটে ১৩১। এরপর ৫ ঘণ্টার সেই দীর্ঘ বিরতি। ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে, বৃষ্টিতে ম্যাচ ভেসে গেলেই বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু যদি আবার খেলা শুরু হয়? ডাকওয়ার্থ-লুইসের হিসাব বলছে, একটা উইকেট ফেলতে না পারলে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া স্কোরেরও ঢের বেশি রান!

সর্বাধিক পঠিত