সেই মেসিকেই এখন ভালবাসায় ভাসাচ্ছে আর্জেন্টিনা
অবসর তো নিয়েই নিয়েছিলেন জাতীয় দল থেকে। নতুন কোচের অনুরোধেই আবার ফিরে এসেছেন। সবসময়ই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি নাকি শুধু ক্লাবের খেলোয়াড়। আর্জেন্টিনার হয়ে নাকি ভালো কিছু করতে পারেন না! পুরোটা দেন না দেশের জন্য! দেশবাসী কতো কথাই না শুনিয়েছেন মেসিকে! আরো অভিযোগ আছে। তিনি নাকি শুধু দলকে ফাইনালে নিয়ে যেতে পারেন, জেতাতে পারেন না শিরোপা। যে দলের সব দায়িত্বই তার একার! বুধবার অবশ্য দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া আর্জেন্টিনার দায়িত্ব একার কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। খাদের কিনারা থেকে একাই দুইবারের চ্যাম্পিয়নদের সরাসরি তুলে দিলেন ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের মূলপর্বে। আর তার এমন অবিস্মরণীয় কীর্তিতে দেশের ভক্ত-সমর্থকদের আগের সব রাগ ধুয়েমুছে জন্ম নিয়েছে মেসির প্রতি নতুন ভালবাসা।
৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মেসির উপর সবসময় থাকে হিমালয়ের সমান চাপ। তিনি এক ম্যাচে গোল না করলেই যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। দলের ১১ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে গোল করার দায়িত্ব শুধু তারই! তবুও মেসি হতাশ করেননি সচরাচর। এমনও হয়েছে একম্যাচ গোলশূন্য থেকে পরের ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেছেন ৫ বারের বিশ্বসেরা ফরোয়ার্ড। তার গোলেই ম্যাচ জিতেছে দল।
পরিসংখ্যানও মেসির হয়েই কথা বলে। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল (৫৭) করেছেন তিনি। ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে স্প্যানিশ ফুটবল লিগ 'লা লিগায়' খেলেন মেসি। সেখানেও ৩৬০ গোল করে শীর্ষে তিনিই। গোল সংক্রান্ত প্রায় সব রেকর্ডেই নিজেকে শীর্ষে নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ২৯টি শিরোপা, যার মধ্যে ৮টি লা লিগা শিরোপা, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ৪টি। এক মৌসুমে বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন ৬টি ট্রফি। ইউরোপিয়ান কোন ক্লাবের পক্ষে কোন মৌসুমে এর চেয়ে বেশি ট্রফি জেতা সম্ভব না। গোলের বন্যা ছুটিয়েছেন মেসি, এক মৌসুমে করেছেন সর্বোচ্চ ৭৩ গোল। বার্সা থেকে রোনালদিনহো বিদায় নেয়ার পর ক্লাবের সব ট্রফি জয়েই ছিল মেসির সরাসরি অবদান।
তবুও আর্জেন্টাইন ভক্তদের অনুযোগ, নিজের মান অনুযায়ী মেসি খেলতে পারেন না। বিশেষ করে প্রশ্নটা যখন দেশের হয়ে খেলার। ক্লাবের হয়ে তিনি যত উজ্জ্বল, দেশের হয়ে ততটাই অনুজ্জ্বল- আরও কত অভিযোগ। বিশ্বকাপ না জিতলে তিনি নাকি ডিয়েগো ম্যারাডোনার মত প্রতিভাবান নন। মেসি বিশ্বকাপে প্রথম খেলেন ২০০৬ সালে। ২০০৬, ২০১০ ও সর্বশেষ ২০১৪ তিনটি বিশ্বকাপেই তিনি আর্জেন্টিনার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ২০১৪ সালে তো অধিনায়কই ছিলেন। কাকতালীয়ভাবেই তিন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার স্বপ্ন ভেঙেছে জার্মানির কাছে হেরে। দুটি কোয়ার্টার ফাইনাল আর সর্বশেষ ফাইনাল! স্বপ্নের কত কাছে এসে ফিরে গেছেন মেসি।
ভিনগ্রহের ফুটবলার তকমা দেয়া হয় তাকে। এরপর সবাই ভুলে যায় মেসিও মানুষ। ব্যর্থতার গ্লানি তারও আছে। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলে এমন খেলোয়াড় ছিল না যারা মেসির পায়ে বল যুগিয়ে দিতে পারে। আর ২০১৪ সালে ছিল না মেসির তৈরি করা বলে গোল করতে পারে এমন কোন খেলোয়াড়। ৪ গোল করেছেন, জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বলও। তবুও ব্যর্থ শুধু মেসিই। ২০১৬ সালে কোপা আমেরিকা ফাইনালে চিলির বিপক্ষে টাইব্রেকারে মেসি পেনাল্টি মিস করেন। পেনাল্টি মিস করেছিলেন লুকাস বিগলিয়াও। কিন্তু কোপা আমেরিকা হারের দায় এসে পড়ে মেসির উপরই। সবাই ভুলে যায় ৫ গোল করে দলকে ফাইনালে তুলেছেন এই মানুষটাই।
তাই এবার হয়ত নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন একাই টেনে তুলবেন আর্জেন্টিনাকে। সেজন্য বেছে নিলেন মোক্ষম দিনটিই। ইকুয়েডরের বিপক্ষে বাঁচামরার ম্যাচ কিটোতে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৯০০০ ফুট উপরের এই মাঠে ২০০১ সালের পর থেকে জেতেনি আর্জেন্টিনা। প্রথম গোল করে আর্জেন্টাইন ভক্তদের মনে আগের ফলের পুনরাবৃত্তি হওয়ার ভয়ই ঢুকিয়ে দেয় ইকুয়েডর। সেখান থেকে নিজ প্রচেষ্টায় ৩টি গোল করে আর্জেন্টিনাকে সরাসরি বিশ্বকাপেই নিয়ে গেলেন মেসি। পেলেন আর্জেন্টিনা ভক্তদের ভালবাসা। কিছুদিন পর হয়ত আবার রব উঠবে একমাত্র মেসিই পারবেন আর্জেন্টিনার ৩২ বছরের বিশ্বকাপ খরা ঘুচাতে। নিজের চেয়ে এই ভক্তসমর্থকদের খুশি করতেই হয়ত একটি বিশ্বকাপ জিততে হবে মেসিকে।