প্রসঙ্গ : অজয় ভৌমিককে অব্যাহতি
জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা বিস্মিত ॥ ‘কার্যকরী কমিটির মিটিংই অবৈধ’
চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক, একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্ট সংগঠক অজয় কুমার ভৌমিককে গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে অবৈধভাবে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেছেন। প্রবীণ এ আওয়ামী লীগ নেতাকে যেভাবে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে তা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রবিরোধী বলে দলের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ মন্তব্য করেছেন। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক অনুমোদিত কমিটির একজন প্রবীণ নেতাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ এনে এভাবে অগঠনতান্ত্রিক ও অযৌক্তিভাবে দল থেকে অব্যাহতি চরম ধৃষ্টতা বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। সে সাথে দলীয় কার্যালয়কে বাদ দিয়ে কোনো নোটিস ছাড়াই রাতে একটি বাসায় কয়েকজনকে নিয়ে কথা বলে তা কার্যকরী কমিটির সভা এবং দলের সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দেয়াটাও অযৌক্তিক ও অসাংগঠনিক। এ অবস্থায় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা অজয় কুমার ভৌমিককে দল থেকে কথিত অব্যাহতির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা অজয় কুমার ভৌমিককে যে অভিযোগে অব্যাহতির সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে তা সঠিক নয়। তিনি এবং তার পূর্বপূরুষ জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তার হালনাগাদ পাসপোর্ট এবং বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, তিনি এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের নাগরিক এবং চাঁদপুর শহরের স্থায়ী বাসিন্দা। এছাড়া তিনি তার বর্তমান পাসপোর্ট দিয়েই কয়েকবার ভারত সফর করেছেন। অজয় ভৌমিক দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমি পাসপোর্ট করেছি ২০১৩ সালে। এর আগে আমার কোনো পাসপোর্টই ছিলোনা। এরপর আমি যতবার ভারত গিয়েছি সর্বোচ্চ ১০ দিনের বেশি একদিনও ছিলাম না।
জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, কার্যকরী কমিটির যে সভার কথা বলা হয়েছে সে সভাটিই অবৈধ। তা নিয়ম অনুযায়ী হয়নি। একইভাবে অজয় ভৌমিককে অব্যাহতির বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কোনো নিয়ম মেনে করা হয়নি।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিতে থাকা নেতৃবৃন্দের বক্তব্য নেয়া হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলহাজ¦ মোঃ ইউসুফ গাজী বলেন, এ মিটিংয়ের কোনো নোটিস আমি পাইনি। শুধু আমি কেনো অনেকেই পান নি। মিটিংয়েরই যেখানে বৈধতা নেই, কাউকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়াতো অনেক পরের ব্যাপার। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে পর্যালোচনা করে এজেন্ডায় এনে নোটিস দিতে হবে এবং তাকে শোকজ করতে হবে। এরপর সেটি কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। সিদ্ধান্ত নিবে সেন্ট্রাল। কাউকে এভাবে দল থেকে অব্যাহতি জেলা কমিটি দিতে পারে না। জেলা শুধু একটি রেজুলেশন নিতে পারে।
চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মঞ্জুর আহমেদ মঞ্জু বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের ওই মিটিংয়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারছি না।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাফাজ্জল হোসেন এসডু পাটওয়ারী বলেন, দলের কাউকে পদ পদবি থেকে অব্যাহতি দিতে হলে তাকে আগে শোকজ করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এরপর বিষয়গুলো কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। কেন্দ্র এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। তিনি আরও বলেন, তারা যে কাজটি করেছে তা দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থী এবং নিয়মবহির্ভূত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এ মিটিংটি কোথায় হয়েছে? আমি সাংগঠনিক সম্পাদক। অথচ মিটিংয়ের কোনো চিঠি পাইনি।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডঃ মজিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, এ মিটিংয়ের কোনো প্রকার নোটিস হয়নি এবং কোনো দাওয়াতও পাইনি। শুধু আমি একা নই, জেলা আওয়ামী লীগের অনেককেই তারা বলেননি। তিনি বলেন, কাউকে দল থেকে অব্যাহতি দিতে হলে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা এনে দলের মিটিং ডাকতে হয় এবং সেখানে গ্রুপ মেজরিটি লাগবে। এ ধরনের কোনো কিছুই এ ক্ষেত্রে মানা হয়নি। তিনি আরও বলেন, অজয় দার বিরুদ্ধে নাগরিকত্বের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোনো প্রমাণপত্র দিয়ে তাকে কোনো শোকজ করা হয়নি। যা করা হয়েছে তা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের বিরোধী। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কমিটির দায়িত্বশীল পদে থেকে একটি দায়িত্বহীন কাজ করেছেন। সবকিছু মিলে এটি একটি প্রতিহিংসামূলক এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচার বিবর্জিত কাজ। আমি এর প্রতিবাদ জানাই।
জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক ও চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র অ্যাডঃ জিল্লুর রহমান জুয়েল বলেন, যে মিটিংয়েরই কোনো বৈধতা নেই, সে মিটিংয়ের সকল সিদ্ধান্তই অবৈধ। আমি জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদকীয় পদে রয়েছি। অথচ আমি এমন কোনো মিটিংয়ের বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি এ সবের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। দলের মধ্যে বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যেই এসব করা হচ্ছে।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মাসুদ আলম মিল্টন বলেন, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত জেলা আওয়ামী লীগ নিতে পারে না। এটি সম্পূর্ণ দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুনির আহমেদ জানান, এ বিষয়টি সভায় আলোচনা হয়েছে। তবে সিদ্ধান্তের বিষয়টি আমার জানা নেই। একইভাবে এ বিষয়টি প্রেসে প্রকাশ করাটাও ঠিক হয়নি।
চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম রোমান বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তৃণমূলে নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াই হঠাৎ নেতা হয়েছেন। এ জন্যেই তারা এসব অসাংগঠনিক কাজ করছেন। তারা ছাত্রলীগ এবং যুবলীগসহ দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কোনো নেতৃত্বে কখনো ছিলেন না। তাই তারা সাংগঠনিক নিয়ম অনেক কিছুই জানেন না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে এজেন্ডাভিত্তিক সভা আহ্বান করতে হয়। যা তারা করেননি। এজেন্ডা বহির্ভূত এ ধরনের সভায় এ রকমের সিদ্ধান্ত এখতিয়ার বহির্ভূত।
সভায় উপস্থিত থাকা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডাঃ হারুনুর রশিদ সাগর বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আমাদেরকে ডেকেছেন তাই সেখানে গিয়েছি। আমি সেখানেও প্রশ্ন রেখেছি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বাসায় কেনো দলের মিটিং হবে। যেখানে জেলা আওয়ামী লীগের এতো সুন্দর একটি কার্যালয় রয়েছে। আমি রাত ১০টায় মিটিংস্থলে গিয়ে দেখি সাধারণ সম্পাদক দুলাল ভাই বক্তব্য দিচ্ছেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি অজয় দার দ্বৈত নাগরিকত্বের কথা বলে এ বিষয়ে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। আমি এটুক্ইু শুনেছি। এটি কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
সভায় উপস্থিত থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গাজী মোঃ মাঈনুদ্দিন প্রথমত বলেছেন, জেলা আওয়ামী লীগ এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এরপর যখন তার কাছে গঠনতন্ত্রের নিয়মের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তখন তিনি বলেন, এ সব ক্ষেত্রে জেলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করবে, কেন্দ্র এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবু সাহেদ সরকার বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে একটি বিষয় ছিল যারা দ্বৈত নাগরিক এবং যারা পর পর ৩টি মিটিংয়ে অনুপস্থিত তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলা হয়েছে। তবে এখানে কারো নাম উল্লেখ করা হয়নি এবং নির্দিষ্ট কাউকে দল থেকে অব্যাহতির কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সন্তোষ দাশ বলেছেন, আমি সে মিটিংয়ে ছিলাম। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে কাউকে অব্যাহতির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। আর এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা এনে নোটিস করতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম নাজিম দেওয়ান বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুদানে আমাদের অনেক সুন্দর একটি জেলা অফিস নির্মিত হয়েছে। সে অফিস বাদ দিয়ে কারো বাসায় কেনো কার্যকরী কমিটির সভা? এই মিটিংয়ের কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি, আমরা অবহিত নই। তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি দলের সভানেত্রীর অনুমোদিত কমিটি। এই কমিটির কাউকে অব্যাহতি দেয়ার এখতিয়ার জেলা কমিটির নেই। এর জন্যে দলের সভানেত্রীর সিদ্ধান্ত লাগবে। তিনি বলেন, পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম কথিত সে সভায় তৃণমূলের বিষয়ে আরো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর কোনো বৈধতা তো নেই-ই, উপরন্তু এসব তৃণমূলসহ দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিভেদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস। জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে আমি দলের সভানেত্রীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।